চট্টগ্রাম: সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে দেওয়া পোস্টকে কেন্দ্র করে কবি, শিক্ষক ও সংস্কৃতি সংগঠক সেলিনা আক্তার শেলীকে হয়রানির প্রতিবাদে মানববন্ধন ও সমাবেশ করেছে সর্বস্তরের সংস্কৃতিকর্মী ও সচেতন নাগরিক সমাজ।
বুধবার (১৯ এপ্রিল) বিকেলে নগরের চেরাগি চত্বরে অনুষ্ঠিত সমাবেশ থেকে সেলিনা শেলীকে অবিলম্বে চট্টগ্রাম বন্দর মহিলা কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ পদে পুনর্বহাল এবং তাকে হয়রানি বন্ধের জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানানো হয়েছে।
সমাবেশে চট্টগ্রামের বিশিষ্ট নাগরিকেরা বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আমরা যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছি।
সমাবেশে সভাপতির বক্তব্যে মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা কেন্দ্রের চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. মাহফুজুর রহমান বলেন, মুক্তিযুদ্ধ বাঙালি করেছে। কোনো ধর্মীয় পরিচয়ে কেউ মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেননি। একাত্তরে মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান আমরা সবাই এক থালায় ভাত খেয়ে মুক্তিযুদ্ধ করে স্বাধীন বাংলাদেশ অর্জন করেছিলাম। এখন হিন্দু-মুসলিম যে বিভাজন, এটি মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী। চট্টগ্রাম বন্দরে আমি একবার গিয়েছিলাম মুক্তিযুদ্ধের গণকবর দেখতে। একটি গণকবরের ওপর রাস্তা হয়ে গেছে, তার কোনো চিহ্ন নেই। বন্দর কর্তৃপক্ষ মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন সংরক্ষণে কোনো ভূমিকা রাখেনি। এই বন্দর কর্তৃপক্ষ অহেতুক মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে সরকারকে বিরুদ্ধে লাগানোর চেষ্টা করছে।
ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন চট্টগ্রাম কেন্দ্রের সাবেক সভাপতি প্রকৌশলী দেলোয়ার মজুমদার বলেন, আজ হতাশা নিয়ে আমি বলতে চাই, আমরা জীবন বাজি রেখে কি এই দেশটি অর্জন করেছিলাম? এদেশে একটি শব্দ উচ্চারণের পর আমাকে দ্বিধায় থাকতে হয় যে, আমি কোনো ষড়যন্ত্রে পড়ে যায় কি না। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া দলের সরকার ক্ষমতায়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আমরা দেশ স্বাধীন করেছিলাম। আমরা কথা বলতে পারবো না, আমরা নিশ্বাস নিতে পারবো না, এমন বাংলাদেশ তো বঙ্গবন্ধু আমাদের উপহার দেননি। আপনারা বঙ্গবন্ধুর উত্তরসূরি হিসেবে নিজেদের দাবি করেন। আমরা প্রমাণ চাই যে, আপনারা বঙ্গবন্ধুর উত্তরসূরি। বন্দরের যে কুলাঙ্গাররা স্বাধীন মতপ্রকাশের জন্য সেলিনা শেলীর গলা কাটার চেষ্টা করছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিন। আমাদের কণ্ঠ কেউ থামাতে পারবে না। আমরা কথা বলে যাবো।
চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান বলেন, আমরা ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে এদেশ পেয়েছি। সেই রক্ত শুধু মুসলমানের নয়, হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান সবার রক্তে আমরা এই স্বাধীনতা পেয়েছি। স্বাধীন দেশে ধর্মের নামে বিভাজন, ধর্মীয় উন্মাদনা তৈরির চেষ্টা কাম্য নয়। যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাস করে না, যারা এখনো অখণ্ড পাকিস্তানে বিশ্বাস করে, তারাই সরকারকে বিপদে ফেলতে ধর্মীয় উন্মাদনা ছড়িয়ে দেশকে অস্থিতিশীল করার পাঁয়তারা করছে। এদের বিরুদ্ধে আমাদের নিরন্তর সংগ্রাম করে যেতে হবে। স্বাধীন বাংলাদেশ আমরা ধর্মান্ধ, মৌলবাদী গোষ্ঠীর হাতে তুলে দিতে পারি না। সামনে নির্বাচন, সেজন্য ধর্মান্ধ জামায়াতি, রাজাকার-আলবদররা আবার মাথা তোলার চেষ্টা করছে। তাদের প্রতিরোধ করতে হবে।
বাংলাদেশ কলেজ -বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যক্ষ মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর বলেন, সেলিনা শেলী বিশাল সময়ের শিক্ষকতা জীবনে তার বিরুদ্ধে কখনো কেউ কোনো অভিযোগ আনতে পারেনি। ঠুনকো একটি বিষয়, ফেসবুক পোস্ট নিয়ে তার বিরুদ্ধে বন্দর কর্তৃপক্ষ যে ব্যবস্থা নিয়েছে, সেটা অত্যন্ত ন্যক্কারজনক। তাকে স্বপদে বহাল করতে হবে। তার যে সম্মানহানি হয়েছে, সেটা যাতে পুনরুদ্ধার হয় সেই ব্যবস্থা নিতে হবে। যারা উসকানি দিয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। উসকানিদাতারাও কিন্তু ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বরখেলাপ করেছেন। কারণ তারাও ডিজিটাল মাধ্যমে সেলিনা শেলীকে হেনস্তা করছে।
কবি ও সাংবাদিক কামরুল হাসান বাদল বলেন, সেলিনা শেলী রামাদান শব্দ উল্লেখ করে কেন ফেসবুকে লিখেছিলেন, এটার একটা পটভূমি আছে। পহেলা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রাকে যেভাবে আক্রমণ করা হচ্ছিল হিন্দুয়ানি বলে, এই শব্দ হিন্দুয়ানি শব্দ, এই কথা হিন্দুয়ানি কথা, এই কালচার হিন্দুয়ানি কালচার- তাতে আমাদের সন্তানরা ভাবতে পারেন হিন্দুয়ানি বোধহয় ঘৃণ্য, পরিত্যক্ত কোনো বিষয়। সেই পটভূমিতে সেলিনা শেলীর বক্তব্যের কারণে তার বাড়ির চারপাশে এখন অসংখ্য হায়েনার আনাগোনা, পেলেই যেন তার কল্লা কেটে নেবে। এই অসহায় নারী আজ কোথায় আছেন, কী দুর্বিষহ অবস্থায় তিনি প্রতিটি মুহূর্ত পার করছেন, সেটা আমরা কেউ জানি না। এমন অনিরাপদ বাংলাদেশ আমরা চাই না। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন দিয়ে মানুষের মুক্তচিন্তাকে রুদ্ধ করা হচ্ছে। এই আইন এখন ব্লাসফেমি আইনে পরিণত হয়েছে। আমরা এই আইন অবিলম্বে বাতিল চাই।
কথাসাহিত্যিক বিশ্বজিৎ চৌধুরী বলেন, রমজান এবং রামাদানের ভাষাগত যে তফাৎ কিংবা আমরা যে রমজানুল মুবারক বলে থাকি, সেই কথাটিই সেলিনা শেলী বলেছিলেন। এই পোস্টটি তিনি আবার প্রত্যাহারও করে নিয়েছেন। কিন্তু কোনোভাবেই তাকে হয়রানি, হুমকিধমকি বন্ধ হচ্ছে না। অথচ ইউটিউব কিংবা ফেসবুক উল্টান, ধর্মীয় বয়ানের নামে কতরকমের আস্ফালন, কৌতুক, ঠাট্টা- মশকরা চলছে। কিন্তু এগুলোর জন্য বিচার দাবি করার কেউ নেই। সেলিনা শেলী বলার সঙ্গে সঙ্গে এটা বিরাট একটা ঘটনা হয়ে গেল। সবাই বিচার চাইতে লাগল। অন্ধকারের শক্তি ধর্মান্ধ গোষ্ঠী আড়ালে ষড়যন্ত্র শুরু করে দিয়েছে, এর বিরুদ্ধে আমাদের সবার রুখে দাঁড়াতে হবে।
আবৃত্তিশিল্পী রাশেদ হাসানের সঞ্চালনায় সমাবেশে বক্তব্য দেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির চট্টগ্রাম জেলা কমিটির সভাপতি অধ্যাপক অশোক সাহা, শিক্ষক হোসাইন কবির, নাট্যজন প্রদীপ দেওয়ানজী, কবি রাশেদ রউফ, সাংস্কৃতিক সংগঠক অধ্যাপিকা শীলা দাশগুপ্ত, সাহিত্যিক আলম খোরশেদ, কবি ও সাংবাদিক ওমর কায়সার, কবি অভীক ওসমান, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের যুগ্ম মহাসচিব মহসীন কাজী, খেলাঘর চট্টগ্রাম মহানগরের সহ-সভাপতি কবি আশীষ সেন, চট্টগ্রাম জেলা ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক শরীফ চৌহান, বোধন আবৃত্তি পরিষদের সভাপতি প্রণব চৌধুরী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ ও প্রাণীবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ওমর ফারুক রাসেল, শিল্পী শ্রেয়সী রায়, উদীচী চট্টগ্রামের সাধারণ সম্পাদক অসীম বিকাশ দাশ, সাংবাদিক সুমি খান এবং আবৃত্তিশিল্পী সুবর্ণা চৌধুরী।
সমাবেশে একাত্মতা প্রকাশ করে বোধন আবৃত্তি পরিষদ, প্রমা আবৃত্তি শিল্পীগোষ্ঠী, অদিতি সঙ্গীত নিকেতন, ছাত্র ইউনিয়ন, সুচয়ন ললিতকলা কেন্দ্র, নরেন আবৃত্তি একাডেমি, খেলাঘর চট্টগ্রাম মহানগরী, খেলাঘর চট্টগ্রাম মহানগর, যুব ইউনিয়ন এবং উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীসহ বিভিন্ন সংগঠন।
বাংলাদেশ সময়: ১৯৩০ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৯, ২০২৩
এআর/পিডি/টিসি