চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়: সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে অন্য বিভাগের শ্রেণিকক্ষ এবং শিক্ষকদের জন্য বরাদ্দকৃত কক্ষ দখলের অভিযোগ উঠেছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি) মেরিন সায়েন্স ইনস্টিটিউটের পরিচালকের বিরুদ্ধে। যদিও কক্ষ দখলের কয়েকদিন পরেই হজের উদ্দেশে দেশ ছাড়েন ওই ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ড. শেখ আফতাব উদ্দিন।
সম্প্রতি উদ্বোধন করা হয় চবির মেরিন সায়েন্সেস এন্ড ফিশারিজ অনুষদের নতুন অ্যাকাডেমিক ভবন। ওই অনুষদের অধীনে রয়েছে দুইটি বিভাগ ও একটি ইনস্টিটিউট।
যদিও এ সিদ্ধান্তে দ্বিমত পোষণ করে ওই বছর ২৬ নভেম্বর পরিকল্পনা ও উন্নয়ন দফতরের পরিচালক বরাবর চিঠি দেন মেরিন সায়েন্স ইনস্টিটিউটের তৎকালীন পরিচালক অধ্যাপক ড. মো. শফিকুল ইসলাম।
তবে একই বছর ১৪ ডিসেম্বর চবি উপাচার্য রুম বণ্টনের এ সিদ্ধান্ত পরিকল্পনা ও উন্নয়ন দফতর এবং সিন্ডিকেট সভায় রিপোর্টের জন্য অনুমোদন করেন। এরপর ২০২০ সালের ৩০ ডিসেম্বর পরিকল্পনা ও উন্নয়ন কমিটির ৩১৫তম সভায় এবং ২০২১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত চবির ৫২৯তম জরুরী সিন্ডিকেট সভায় কক্ষ বণ্টনের সিদ্ধান্তটি চূড়ান্ত অনুমোদন করা হয়।
সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী- নবনির্মিত অ্যাকাডেমিক ভবনের নীচতলা অনুষদ কার্যালয়ের জন্য নির্ধারিত থাকবে। অনুষদ কার্যালয়ের আওতায় কনফারেন্স রুম, মিউজিয়াম, এবাদতখানা, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের জন্য ক্যান্টিনসহ সকল রুম ও সুবিধাসমূহ ডিনের তত্ত্বাবধানে থাকবে।
দোতলায় মেরিন সায়েন্স ইনস্টিটিউট, তৃতীয় তলায় ওশানোগ্রাফি বিভাগ এবং চতুর্থ তলা ফিশারিজ বিভাগের জন্য নির্ধারণ করা হয়। পঞ্চম তলায় ক্রমানুসারে মেরিন সায়েন্স ইনস্টিটিউটকে ৪টি কক্ষ, ওশানোগ্রাফি বিভাগকে ২টি কক্ষ এবং ফিশারিজ বিভাগকে ২টি করে শ্রেণিকক্ষ বরাদ্দ দেওয়া হয়।
এছাড়া শিক্ষকদের জন্য নীচতলা থেকে ক্রমানুসারে কক্ষ বন্টন করা হয়। এক্ষেত্রে প্রথম ১৭টি কক্ষ মেরিন সায়েন্স ইনস্টিটিউটের, পরের ৯টি রুম ওশানোগ্রাফি বিভাগের এবং শেষের ৯টি রুম ফিশারিজ বিভাগের শিক্ষকদের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়। পাশাপাশি ওই ভবনের গোলাকার রুমগুলোর মধ্যে প্রথম তলায় মেরিন সায়েন্স ইনস্টিটিউট, দ্বিতীয় তলায় ওশানোগ্রাফি বিভাগ এবং তৃতীয় তলায় ফিশারিজ বিভাগের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়।
এদিকে সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্ত অমান্য করে ওশানোগ্রাফি বিভাগের জন্য বরাদ্দকৃত একাধিক রুম দখলে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে মেরিন সায়েন্স ইনস্টিটিউট পরিচালকের বিরুদ্ধে।
অবশ্য এরপর ওশানোগ্রাফি বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মোসলেম উদ্দিন এ ঘটনার প্রতিবাদ জানান। পরে বিভাগের একাডেমিক কমিটির সিদ্ধান্তে ওশানোগ্রাফির শিক্ষকরা তাৎক্ষনিক এ ঘটনার সমাধানে অনুষদের ডিনকে জানান। এ সময় অনুষদ কার্যালয়ে শিক্ষকরা ৫ ঘণ্টা অবস্থানের পাশাপাশি উপাচার্য ও উপ-উপাচার্যকে বিষয়টি অবহিত করেন। তবে ওইদিন বিকেল পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিষয়টি সমাধানে কোনো উদ্যোগ না নেয়ায় মূল ফটকে তালা দেন ওশানোগ্রাফি বিভাগের শিক্ষকরা। এছাড়া একাডেমিক কমিটির জরুরী সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এ বিষয়ে অভিযোগ জানিয়ে গত ১১ জুন চবি উপাচার্য বরাবর চিঠি দেন ওশানোগ্রাফি বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মোসলেম উদ্দিন।
অভিযোগপত্রে বলা হয়, মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী ডা. দিপু মনি গত ৪ জুন 'চবি ইনস্টিটিউট অব মেরিন সায়েন্সেস অ্যান্ড ফিশারিজ এর গবেষণা ও সক্ষমতা বৃদ্ধি' প্রকল্পের আওতায় নির্মিত চবি মেরিন সায়েন্সেস অ্যান্ড ফিশারিজ অনুষদের নবনির্মিত একাডেমিক ভবন উদ্বোধন করেন। এরপর ৬ জুন ওশানোগ্রাফি বিভাগের একাডেমিক কমিটির সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিভাগের শিক্ষকরা অনুষদের ডিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ১৬ জুনের মধ্যে নবনির্মিত ভবনে ওশানোগ্রাফি বিভাগের জন্য বরাদ্দকৃত শিক্ষক রুম, ক্লাসরুম এবং ল্যাবরুমগুলো বুঝিয়ে দেওয়ার অনুরোধ জানান।
অথচ পরদিন ৭ জুন মেরিন সায়েন্স ইনস্টিটিউটের পরিচালকের নেতৃত্বে ইনস্টিটিউটের শিক্ষকদের জন্য বরাদ্দকৃত ১৭টি কক্ষের পাশাপাশি ওশানোগ্রাফি বিভাগের শিক্ষকদের জন্য বরাদ্দকৃত ৪টি কক্ষ এবং একাডেমিক ভবনের ৫ম তলায় মেরিন সায়েন্স ইনস্টিটিউটের জন্য বরাদ্দকৃত ০৪টি শ্রেণিকক্ষ ছাড়াও অতিরিক্ত ২টি কক্ষে তালা দিয়ে দখলে নেন। এ ঘটনায় প্রশাসনের হস্তক্ষেপে ওশানোগ্রাফি বিভাগের জন্য নির্ধারিত কক্ষ বুঝিয়ে দেওয়ার অনুরোধ জানান বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক মোসলেম উদ্দিন। পাশাপাশি ওশানোগ্রাফি বিভাগের অতিরিক্ত ৩ জন শিক্ষকের জন্য কক্ষের ব্যবস্থা করার অনুরোধ জানানো হয় ওই চিঠিতে।
জানা গেছে, গত ৭ জুন অন্য বিভাগের জন্য বরাদ্দকৃত একাধিক শ্রেণিকক্ষ ও শিক্ষকদের একাধিক কক্ষ দখলের কিছুদিন পর হজের ফ্লাইট ধরেন মেরিন সায়েন্স ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ড. শেখ আফতাব উদ্দিন। এরপর থেকে ইনস্টিটিউটের ভারপ্রাপ্ত পরিচালকের দায়িত্বে আছেন অধ্যাপক ড. এসএম শরীফুজ্জামান।
অবশ্য অনুষদের বিভাগগুলোর মধ্যে সর্বপ্রথম গত ৬ জুন ফিশারিজ বিভাগ শিক্ষক ব্লকে তাদের জন্য বরাদ্দকৃত ৯টি রুম এবং অ্যাকাডেমিক ভবনের পঞ্চম তলায় বিভাগের জন্য বরাদ্দকৃত ২টি রুমে তালা দেন।
জানা গেছে, শিক্ষকদের অভিযোগের প্রেক্ষিতে গত ১৫ জুন মেরিন সায়ন্সেস এন্ড ফিশারিজ অনুষদের ডিন, মেরিন সায়েন্স ইনস্টিটিউটের পরিচালক এবং ওশানোগ্রাফি ও ফিশারিজ বিভাগের সভাপতিকে নিয়ে আলোচনায় বসেন চবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. শিরীণ আখতার ও উপ উপাচার্য অধ্যাপক বেনু কুমার দে। এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন কলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মাহবুবুল হক ও সিন্ডিকেট সদস্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আবুল মনছুর।
ওই সভায় সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্ত মেনে চলতে বলা হয়। এছাড়া মেরিন সায়েন্স ইনস্টিটিউটের ৩জন এবং ওশানোগ্রাফি বিভাগের ৩ জন শিক্ষকের (বরাদ্দকৃত শিক্ষক রুম যাদের জন্য সংকুলান হচ্ছে না) জন্য শিক্ষক ব্লকের চতুর্থ ও পঞ্চম তলার মধ্যকার ২টি গোলাকার কক্ষে শিক্ষকদের জন্য ৪টি করে ৮টি কক্ষ তৈরি করতে অনুষদের ডিনকে নির্দেশ ও প্রধান প্রকৌশলীকে অবহিত করা হয়। মিটিংয়ের সিদ্ধান্ত মেনে ওশানোগ্রাফি বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মোসলেম উদ্দিন এ ঘটনার প্রতিবাদে মূল ফটকে লাগানো তালা সেদিনই খুলে দেন। তবে জানা গেছে এখনও অতিরিক্ত দখলকৃত কক্ষগুলো ছাড়েননি মেরিন সায়েন্স ইনস্টিটিউটের পরিচালক।
জানতে চাইলে মেরিন সায়েন্স ইনস্টিটিউটের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক ড. এসএম শরীফুজ্জামান বাংলানিউজকে বলেন, তালা দেওয়ার মতো কিছু ঘটেনি। মোট ৩৫টি শিক্ষকদের কক্ষ রয়েছে। এর মধ্যে ২১টি কক্ষে আমাদের ২১ জন শিক্ষক বসেছেন। আপনি যদি সরাসরি দেখা করেন, তাহলে আমরা আমাদের অ্যাভিডেন্সগুলো দেখাতে পারবো। মুঠোফোনে এর চেয়ে বেশি কিছু বলতে পারছি না।
সর্বপ্রথম নিজ বিভাগের শিক্ষকদের জন্য বরাদ্দকৃত কক্ষগুলোতে তালা দেওয়া ফিশারিজ বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক ড. মো. রাশেদ উন নবী বাংলানিউজকে বলেন, আমরা সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী যে কক্ষগুলো পেয়েছি, সেগুলো বুঝে নিয়েছি। যখন কক্ষ বণ্টন করা হয়েছিল, তখন মেরিন সায়েন্স ইনস্টিটিউটের শিক্ষক ছিলেন ১৩ জন, ওশানোগ্রাফির এবং ফিশারিজ বিভাগে ৪ জন করে শিক্ষক ছিলেন। সব বিভাগেই যেহেতু ভবিষ্যতে শিক্ষক বাড়বে, তাই সেসময় মেরিন সায়েন্সকে ১৩ জন শিক্ষকের বিপরীতে ১৭টি কক্ষ, ওশানোগ্রাফি এবং ফিশারিজকে ৯টি করে কক্ষ দেওয়া হয়েছে। এখন কক্ষ সংকুলান না হওয়ায় দুইটি বড় কক্ষ শিক্ষকদের বসার উপযুক্ত করে নিতে বলা হয়েছে। এছাড়া সিন্ডিকেটের পূর্বের সিদ্ধান্ত সবাইকে মেনে নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন উপাচার্য মহোদয়।
ওশানোগ্রাফি বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মোসলেম উদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, নতুন ভবনের কাজ যখন শুরু হয়েছিলো, ফ্লোর এবং কক্ষ বণ্টন নিয়ে তখন থেকেই দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিলো। তাই ২০২০ সালে ফ্লোর বণ্টন সংক্রান্ত একটি কমিটি করা হয়। পর্যায়ক্রমে পরিকল্পনা ও উন্নয়ন দফতর এবং বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেটে কোনো বিভাগ কয়টি কক্ষ পাবে, অনুষদের অধীনে কোন কক্ষগুলো থাকবে, সার্বিক বিষয়ে সিদ্ধান্ত এবং সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী পর্ষদে অনুমোদন হয়। এরপরও মেরিন সায়েন্স ইনস্টিটিউটের পরিচালকের নেতৃত্বে ওশানোগ্রাফি বিভাগের জন্য বরাদ্দকৃত একাধিক কক্ষ দখলে নিতে তালা দেওয়া হয়েছে। এগুলো কি তালা দিয়ে বা চর দখলের মতো কোনো বিষয়?
তিনি বলেন, আমরা বিভাগের পক্ষ থেকে লিখিত অভিযোগ দিয়েছি উপাচার্য বরাবর। আশাকরি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে সুষ্ঠু সমাধান দিবে।
সার্বিক বিষয়ে জানতে ওই অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মো. শফিকুল ইসলামের সঙ্গে একাধিক যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও সাড়া দেননি তিনি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সিন্ডিকেট সদস্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আবুল মনছুর বাংলানিউজকে বলেন, গত ১৫ জুন ওই অনুষদের সবগুলো বিভাগ প্রধানদের সঙ্গে বসেছিলেন উপাচার্য মহোদয়। সিন্ডিকেট সদস্য হিসেবে আমাকেও সেখানে ডাকা হয়েছিল। সবার বক্তব্য শুনেছি আমরা। উনারা তো নিজেদের মধ্যে বিষয়টি মিমাংসা করে নিবে বলেছিল। তবে সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্ত অমান্য করার সুযোগ নেই। কক্ষগুলো আগেই বণ্টন করে দেওয়া হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, সরকার ব্লু ইকোনোমিকে সামনে রেখে এ প্রকল্পের পেছনে কোটি কোটি টাকা ইনভেস্ট করছে। কাজেই আমি মনে করি ছোটোখাটো বিষয়গুলো নিয়ে নিজেদের মধ্যে ঝামেলায় না জড়িয়ে তাদের উচিত গবেষণায় মনোনিবেশ করা। সবগুলো বিভাগেই শিক্ষকের সংখ্যা ভবিষ্যতে বাড়বে, তখন আরও কক্ষ প্রয়োজন হবে। এবং প্রয়োজন অনুসারে কক্ষের ব্যবস্থাও করতে হবে। আমরা চাই উনারা নিজেদের মধ্যে বিষয়টি সমাধান করে নিবেন।
বাংলাদেশ সময়: ২০১০ ঘণ্টা, জুন ৩০, ২০২৩
এমএ/পিডি/টিসি