চট্টগ্রাম: অপরিকল্পিত নগরায়ণের কারণে জলাশয়ে ভরা একসময়ের সবুজ নগরী চট্টগ্রাম তার বেশিরভাগ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যই হারিয়েছে। গত ৩০ বছরে ১৮ হাজারের অধিক জলাশয় হারিয়ে গেছে।
১৯৯১ সালে জেলা মৎস্য বিভাগের জরিপে চট্টগ্রামে ১৯ হাজার ২৫০টি জলাশয় চিহ্নিত করা হয়।
জানা যায়, চট্টগ্রামে মূল ও শাখা-প্রশাখা মিলে ১৮২.২৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের মোট ১১৮টি খাল ছিলো। ২০১৬ সালে পানি উন্নয়ন বোর্ড বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া ৭৮টি খালের অস্তিত্ব পায়নি। ফলে মোট খালের সংখ্যা দাঁড়ায় ৪০টি। চসিক, চউক ও ওয়াসার হিসেবে নগরে ৩৬টি খাল থাকার কথা উল্লেখ করা হয়। কিন্তু ২০১৯ সালের জরিপে খালের সংখ্যা দাঁড়ায় ২২টিতে। আবার এসব খালের অধিকাংশ দখল হয়ে আছে।
চৌধুরী শ্রীপূর্ণচন্দ্র দেববর্ম্মা তত্ত্বনিধি’র চট্টগ্রামের ইতিহাস বইয়ে চট্টগ্রাম নগর ও আশপাশের এলাকায় বিভিন্ন ব্যক্তি, বংশ ও এলাকার নামে ৩৭৬টি দিঘি খনন করা হয় বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বর্তমানে এসব দিঘির অধিকাংশই ভরাট হয়ে গেছে।
নন্দনকানন এলাকার রথের পুকুর, আন্দরকিল্লার রাজা পুকুর, দেওয়ানবাজারের দেওয়ানজি পুকুর, ফিরিঙ্গীবাজারের দাম্মো পুকুর, চান্দগাঁওয়ের মৌলভী পুকুর, বহদ্দারহাটের মাইল্যার পুকুর, খতিবের হাট পুকুর, চকবাজারের কমলদহ দিঘি, কাট্টলীর পদ্মপুকুর ও উত্তর কাট্টলীর চৌধুরীর দিঘি, ষোলোশহর হামজারবাগ এলাকার হামজা খাঁ দিঘি, মোহাম্মদ খান দীঘি ভরাট হয়ে গেছে এক যুগ আগেই। দখল-দূষণে বিপর্যস্ত এনায়েত বাজার রানীর দিঘি, আসকার দিঘি, কর্নেল দিঘি, কর্নেল হাট দিঘি, হাজারীর দিঘি, কারবালা পুকুর, ভেলুয়া সুন্দরীর দিঘি, বড় মিয়ার মসজিদ পুকুর, হালিশহরের খাজা দিঘি, চান্দগাঁওয়ের মুন্সি পুকুর, বাকলিয়ার আবদুল্লাহ সওদাগর পুকুর, অক্সিজেনের জোহুরা পুকুর, ইপিজেড সল্টগোলা ক্রসিং এলাকার হাজী অছি মিয়া সওদাগর মসজিদ পুকুর, আগ্রাবাদ ঢেবার দিঘি, মিনার মা’র দীঘি, কাজীর দিঘি সহ অনেক জলাশয়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জলাশয় রক্ষা সংক্রান্ত আইন থাকলেও কারও তা মানার গরজ নেই। নগরবাসীর ব্যবহারের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি ফায়ার সার্ভিসের প্রয়োজনীয় পানির যোগানও মিলতো এসব জলাশয় থেকে। নগরজুড়ে থাকা পুকুর ও জলাশয়ে বর্ষায় সহজে পানি নিষ্কাশন হতো। জনসংখ্যার আধিক্য, অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও শিল্পায়নসহ অবকাঠামোগত উন্নয়ন, জমির মূল্যবৃদ্ধি, নতুন আবাসিক ও বাণিজ্যিক এলাকা নির্মাণ, পরিবেশ বিষয়ে সচেতনতার অভাবই এসব জলাশয় ভরাটের কারণ। এক্ষেত্রে প্রশাসনের ওপর নির্ভর করা ছাড়া উপায় নেই।
জলাশয় সংরক্ষণ আইন-২০০০ অনুসারে, পুকুর-দীঘি ভরাট নিষিদ্ধ। ভূমির রেকর্ডে আরএস (রয়েল সার্ভে) ও বিএস (বাংলাদেশ সার্ভে)-এ জলাশয় থাকলে তা কোনভাবেই ভরাট করা যাবে না। চউক’র ডিটেইলড এরিয়া প্ল্যানে (ডিএপি) ১৫ কাঠা আয়তনের বড় জলাশয় ভরাট না করার নির্দেশনা রয়েছে। পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ২০১০ (সংশোধিত) অনুযায়ী যেকোনো ধরনের জলাশয় ভরাট করা নিষিদ্ধ। ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা বলছেন, জলাশয় ভরাটের আগে ফায়ার সার্ভিস থেকে অনাপত্তি পত্র নেওয়ার নিয়ম থাকলেও কেউ তা মানছে না। এভাবে জলাশয় ভরাট করে যেসব বহুতল ভবন গড়ে উঠছে, সেগুলো ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে।
চট্টগ্রাম নদী ও খাল রক্ষা আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক সাংবাদিক আলীউর রহমান বলেন, পরিবেশ বিপর্যয় বিবেচনায় নদ-নদী, জলাশয় রক্ষায় নাগরিক সচেতনতা গড়ে তোলার উদ্যোগসহ এ ব্যাপারে সরকারের আইন ও দিকনির্দেশনা থাকার পরও অসুস্থ প্রতিযোগিতা, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা-নীরবতায় জলাশয়গুলোর দখল-ভরাট কার্যক্রম বন্ধ করা যাচ্ছে না। এসব অবৈধ কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে পরিবেশবাদী ও এলাকাবাসী সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোয় অভিযোগ করেও অনেক সময় প্রতিকার পাচ্ছেন না। ফলে সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ দখলদারদের দৌরাত্ম্যে নস্যাৎ হয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৪০০ ঘণ্টা, আগস্ট ১৯, ২০২৩
এসি/টিসি