চট্টগ্রাম: নগরের নন্দনকানন পাহাড়িকা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির এক ছাত্রী গত ১২ আগস্ট সন্ধ্যায় হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে যায়। এ ঘটনায় তার বাবা কোতোয়ালী থানায় জিডি করলে পুলিশ তদন্ত শুরু করে।
৯ আগস্ট ফটিকছড়িতে বাড়ির পাশে পূজার ফুল তোলার সময় এক কিশোরীকে অপহরণ করা হয়। এ ঘটনায় তার মা বাদী হয়ে ১০ আগস্ট থানায় মামলা করেন। এরপর মেয়েকে উদ্ধারে র্যাবের কাছে অভিযোগ দেন। ১১ আগস্ট নগরীর জিইসি মোড় এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয় ফটিকছড়ির হাইদচকিয়া গ্রামের মাহবুল আলমের ছেলে মিনহাজুল আলম রাহীকে (১৯)। তার স্বীকারোক্তি মোতাবেক বড় ভাই মিরাজুল আলমের (৩৩) বাসা থেকে উদ্ধার করা হয় অপহৃতাকে।
এই দুইজনের ভাগ্য ভালো হলেও তাজবীদ হোছাইন সাইমা (১৬) এখনও ফিরতে পারেনি মা-বাবার কাছে। ডা. খাস্তগীর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ১০ম শ্রেণির এই শিক্ষার্থী গত ১৩ জুলাই বিদ্যালয়ের সামনে থেকেই নিখোঁজ হয়ে গেছে। পরিবারের পক্ষ থেকে কোতয়ালী থানায় জিডি করা হয়েছে। বাবা আলতাজ আহমদ জানান, পশ্চিম ষোলশহর খতিবের হাট এলাকা থেকে মেয়ে প্রতিদিন একাই বিদ্যালয়ে যাওয়া-আসা করতো। সে খুড়িয়ে হাঁটতো। কারও সাথে আড্ডাও দিতো না। এক মাস পার হলেও মেয়ের সন্ধান মিলেনি।
চট্টগ্রামে হঠাৎ করে এভাবে একের পর এক শিক্ষার্থী নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার ঘটনায় অভিভাবকদের মধ্যে দেখা দিয়েছে আতঙ্ক। সন্তানকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পৌঁছে দিয়ে ছুটি না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করছেন অনেকে। পুলিশ বলছে, থানায় এ সংক্রান্ত জিডি হওয়ার পর প্রত্যেকটি ঘটনা অনুসন্ধান করা হচ্ছে। কখনও অপহরণকারীদের গ্রেফতার করা হচ্ছে, আবার কখনও নিখোঁজ শিক্ষার্থী পরিবারকে না জানিয়ে কোথাও ঘুরতে গিয়ে কয়েকদিন পর ফিরে আসছে।
১৭ বছরের কিশোর মোহাম্মদ ফারহান ইশরাক (ইনান) নাসিরাবাদ সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের ১০ম শ্রেণির ছাত্র। ১৬ আগস্ট বিদ্যালয়ে যাওয়ার নাম দিয়ে সে চলে গিয়েছিল কক্সবাজারে। সন্তানকে না পেয়ে বায়েজিদ বোস্তামী থানায় জিডি করা হয়। তিনদিন পর ১৯ আগস্ট রাতে সে বায়েজিদ নগর আবাসিক এলাকার বাসায় ফিরেছে বলে জানান বাবা মোহাম্মদ ইলিয়াছ খান।
১১ আগস্ট রাত সাড়ে ১১টার দিকে আন্দরকিল্লা ওয়ার্ডের তনজিমুল মোছলেমীন এতিমখানা থেকে বের হয়ে নিখোঁজ হয় খাইরুল আল ইসলাম রাফি নামের ১০ বছরের এক শিশু। এ ব্যাপারে কোতোয়ালী থানায় জিডি করা হয়েছে বলে জানান শিশুটির সন্ধানপ্রার্থী আব্দুর রশীদ। ওই শিশুর বাড়ি চকরিয়ার মাইজঘোনা উত্তর পাড়া ৫ নম্বর ওয়ার্ডে।
নগরের বাকলিয়ায় সীতাকুণ্ডের সাংবাদিক সৈয়দ ফোরকান আবু’র ছেলে সৈয়দ মো. আমিরুল ইসলাম ইলহামকে গত ২২ জুলাই ও ২৩ জুলাই দুই দফায় কিশোর গ্যাং এর সদস্যরা অপহরণের চেষ্টা চালায়। তবে ভাগ্যক্রমে রক্ষা পায় সে। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট থানায় অভিযোগ দিতে গেলে পুলিশ তা গ্রহণ করেনি বলে অভিযোগ করেন ফোরকান আবু।
শুধু নগর নয়, বিভিন্ন উপজেলায়ও নিখোঁজ থাকার ঘটনায় থানায় প্রায়ই জিডি হচ্ছে। ১৫ জুলাই হালিমাতুছ সাদিয়া (২৫) নামের এক তরুণী সন্ধ্যা ৬টার দিকে পটিয়ার চরকানাই গ্রামের বাড়ি থেকে বের হওয়ার পর নিখোঁজ থাকায় থানায় জিডি করেছেন তার অভিভাবক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান।
এভাবে একের পর এক নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার ঘটনা অনুসন্ধানে মিলেছে অপহরণকারী চক্রের অপতৎপরতার প্রমাণও। সানসাইন গ্রামার স্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্র রিয়াসাত রশীদ এমন অবস্থার শিকার হয়েছে গত ২৬ জুলাই।
জানা গেছে, এদিন সকাল ৮টায় স্কুলের উদ্দেশ্যে ডিওএইচএস এর বাসা থেকে বের হয়ে রিয়াসাত ১৩০ টাকায় সিএনজি অটোরিকশা ভাড়া করে। চালক বায়েজিদ সড়ক দিয়ে না গিয়ে অন্য সড়ক হয়ে ফ্লাইওভারের ওপর দিয়ে জিইসি ঘুরে ডান দিকে চলতে থাকে এবং লর্ডস ইন হোটেলের বাম পাশের সড়কে প্রবেশ করে। ভুল পথে যাওয়ার রাস্তা দেখে চালককে জানালেও তার ধমকে ভয় পেয়ে যায় রিয়াসাত। চট্টগ্রাম সরকারি মহিলা কলেজের আগে তিন রাস্তার মোড়ে যানজটে পড়লে কৌশলে অটোরিকশা থেকে নেমে দৌড়ে রিকশায় উঠে সে মেহেদীবাগে নানার বাসায় চলে আসে।
রিয়াসাতের বাবা ডা. মো.হারুন আল রশীদ অভিযোগ করেন, এ ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করে বায়েজিদ থানায় অভিযোগ দায়ের করার জন্য কয়েক দফায় যোগাযোগ করেও তিনি ব্যর্থ হয়েছেন। ২৮ জুলাই থেকে ১০ আগস্ট পর্যন্ত অনেক চেষ্টায় এসব ফুটেজ সংগ্রহ করেছেন। চট্টগ্রাম-থ ১৪-০৪৬৯ নামের যে সিএনজি অটোরিকশার চালক এ ঘটনায় জড়িত, সেটির ফুটেজ দেওয়ার পরও থানা পুলিশ ঘটনাস্থল খুলশী থানা এলাকা বলে দায় এড়াচ্ছে। একটি গ্রাম সিরিয়ালের গাড়ি গ্রিল লাগিয়ে কিভাবে মেট্রো এলাকায় প্রবেশ করে এমন ঘটনা ঘটায়, সেটা তদন্ত করতেও তাদের অনীহা।
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন) আ স ম মাহতাব উদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, ঘটনাস্থল যদি খুলশী থানা এলাকায় হয় তাহলে ওই অভিভাবককে অবশ্যই সেখানে অভিযোগ দায়ের করতে হবে। এক থানা এলাকার ঘটনা অন্য থানা এলাকার পুলিশ কিভাবে তদন্ত করবে?
তিনি বলেন, টিনএজ শিক্ষার্থীরা ফেসবুকে সুন্দর ছবি-চেহারা দেখে বন্ধুত্ব করে। পরিচিত হতে গিয়ে দেখে নায়ক সালমান খানের জায়গায় নাপিত খানকে। এসময়ই তারা অপহরণের শিকার হয়। আবার কেউ অসৎ বন্ধুর পাল্লায় পড়ে আত্মগোপনে যাচ্ছে। এজন্য সবার আগে মা-বাবাকে সতর্ক থাকতে হবে। সন্তান অস্বাভাবিক আচরণ করলে তাকে বোঝাতে হবে। পারিবারিক শিক্ষাটাই এখানে জরুরি।
বাংলাদেশ সময়: ১৫৩০ ঘণ্টা, আগস্ট ২১, ২০২৩
এসি/টিসি