চট্টগ্রাম: নগরের বিভিন্ন সড়ক ও অলি-গলির পুরনো নাম ধীরে ধীরে পাল্টে যাচ্ছে। দলিল-দস্তাবেজ থেকে মুছে যাচ্ছে বিশিষ্টজনদের নাম।
নগরের দক্ষিণ কাট্টলীর জমিদার প্রাণহরি দাশ জীবদ্দশায় ১১ নম্বর দক্ষিণ কাট্টলী ও ১২ নম্বর সরাইপাড়া ওয়ার্ডের জনগণের চলাচলের সুবিধার্থে নিজ উদ্যোগে যে সড়কটি তৈরি করেন, সেটি প্রাণহরি দাশ সড়ক নামে পরিচিত।
এ ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়ে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত বলেন, সড়ক উন্নয়নের নামে দক্ষিণ কাট্টলীর শত বছরের ঐতিহ্যবাহী প্রাণহরি দাশ সড়কের নাম পরিবর্তন করে এলাকাবাসীর অজান্তে লোহারপুল মেইন রোডের নামে উদ্বোধনী ফলক স্থাপন করা নিন্দনীয়। তিনি এই ফলক সরিয়ে নিতে পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য চসিক মেয়র ও স্থানীয় সংসদ সদস্য মহিউদ্দিন বাচ্চুর প্রতি দাবি জানিয়েছেন।
এর আগে ২০১৯ সালে কাজীর দেউড়ি মোড়, আলমাস সিনেমা হলের মোড়, মেহেদীবাগ মোড়, জেমস ফিনলে, মেডিক্যাল হোস্টেলের সামনে ও চকবাজার মোড়ে থাকা চট্টেশ্বরী সড়কের ছয়টি নামফলক রাতের অন্ধকারে সরিয়ে নেওয়া হয়।
এ ঘটনায়ও সরব হয়েছিলেন চট্টগ্রামের বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় সংগঠনের নেতারা। সংবাদ সম্মেলন করে তারা বলেন, ‘এই সড়কের নাম মুছে ফেলার কাজ গত চার দশক ধরে ধীরে ধীরে হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে ইতিহাস-ঐতিহ্যকে মুছে ফেলার চেষ্টা হয়েছে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা বাংলাদেশে বহু এলাকার নাম পরিবর্তন করেছে। তখনো ৫০০ বছরের পুরনো চট্টেশ্বরী মন্দিরের নামে এ সড়কের নাম পরিবর্তন করেনি’। জনপ্রতিনিধিদের আশ্বাসে চট্টেশ্বরী সড়কের ওইসব মোড়ে পুনরায় নামফলক বসানোর দাবি বাস্তবায়ন হয়নি গত চার বছরেও।
একই সময়ে নগরীর ‘প্রবর্তক মোড়’ নাম পরিবর্তন করে আইয়ুব বাচ্চু চত্বর করার ঘোষণা দিয়ে সমালোচনার মুখে পড়ে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক)।
১৯৩৩ সালের ৭ জুলাই প্রবর্তক সংঘের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক হেমচন্দ্র রক্ষিতের প্রয়াণের পর বীরেন্দ্রলাল চৌধুরী প্রবর্তক সংঘের সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৭১ এর ১৫ মার্চ মুক্তিযোদ্ধারা প্রবর্তক সংঘের পাহাড়ে অবস্থান নেন। ২৯ মার্চ তাদের সেবায় নিয়োজিত থাকাকালে ৭ জন ছাত্র পাকসেনার গুলিতে আহত হন। ৩০ মার্চ দুপুর দুইটায় পাকসেনারা প্রবর্তক সংঘ দখল করে বীরেন্দ্রলাল চৌধুরী, শিক্ষক তারাশঙ্কর কর, কর্মী স্বপন সরকার এবং দারোয়ান দুর্গাচরণ সহ পাঁচজনকে হত্যা করেছিল। এই ইতিহাস নিয়ে সবাই সরব হলে আইয়ুব বাচ্চু চত্বর করার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে চসিক।
প্রবীণ সাংবাদিক, বীর মুক্তিযোদ্ধা নাসিরুদ্দিন চৌধুরী বলেন, চট্টগ্রামে ভাষা আন্দোলন গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন শ্রমিকনেতা ননী সেনগুপ্ত, গোপাল বিশ্বাস, সুধাংশু সরকার প্রমুখ। পুলিশ রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সদস্য কৃষ্ণ গোপাল সেনকে গ্রেপ্তার করেছিল। তাদের নামেও সড়ক নেই শহরে। চট্টগ্রামের রেনেসাঁর অগ্রদূত ডা. অন্নদাচরণ খাস্তগীর। বিদ্যালয় ছাড়া ডা. খাস্তগীরের নামে আর কিছুই নেই। খাস্তগীর স্কুল থেকে একটু দক্ষিণে প্রেসক্লাবের সম্মুখে রাস্তার পূর্ব পাশে শাহ ওয়ালীউল্লাহ ইনস্টিটিউট নামের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি ছিল চট্টগ্রামের আরেক মহামনীষী, বাংলায় স্বাদেশিকতার উদগাতা, পলাশীর যুদ্ধকাব্যের রচয়িতা মহাকবি নবীন চন্দ্র সেনের বাসভবন। পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকা এই ভবনটি চট্টগ্রামের সাবেক জেলা প্রশাসক ওমর ফারুক জামায়াতপন্থীদের ইজারা দিয়েছেন। ইজারা বাতিল করে নবীন সেনের প্রথম বাসভবন উদ্ধার করা আদৌ সম্ভব কি না, আমি জানি না। এমনিভাবে যাত্রা মোহন সেন ও জে এম সেনগুপ্তের বাসভবনও বেহাত হয়ে গেছে।
তিনি বলেন, বিপ্লবের সূতিকাগার চট্টগ্রামের দেওয়ানজি পুকুরের পূর্ব পাড়ে অনুশীলন সমিতির চারু বাবুসহ মেস করে থাকতেন মাস্টারদা সূর্য সেন। পরে একাও থেকেছেন এবং বিয়ের পর স্ত্রী পুষ্প কুন্তলা দেবীকেও এখানে রাখেন। দেওয়ানজি পুকুরপাড়ে শহীদ বেদি আছে, ধর্মীয় স্থাপনা আছে। কিন্তু মাস্টারদার কোনো স্মারক নেই। বীরকন্যা প্রীতিলতার পৈতৃক বাসভবন ছিল আসকার দীঘির দক্ষিণে। প্রীতিলতার ডাকনাম ‘রানী’, সেই নামেই তাঁর পিতা চট্টগ্রাম পৌরসভার হেডক্লার্ক জগদ্বন্ধু ওয়াদ্দেদার মাটির ঘরটি নির্মাণ করে নাম দিয়েছিলেন ‘রানী কুটির’। সেই কুটির এখনো আছে, তবে বিক্রি হয়ে গেছে।
‘চট্টগ্রামের শ্রেষ্ঠ জমিদার পরৈকোড়ার প্রসন্ন কুমার রায় ও যোগেশ চন্দ্র রায়। দেওয়ানজি পুকুরপাড়ের উত্তর পাশে পাহাড়ি অঞ্চল দেওয়ানবাড়ি হিল নামে পরিচিত। প্রসন্ন বাবুর পূর্বপুরুষের নামেই এই নামকরণ। গুড সাহেব লেনের দক্ষিণ পাশে ছিল প্রসন্ন বাবুর বাসভবন। দিদার মার্কেটের সম্মুখে সিরাজদ্দৌলা রোডের পশ্চিম পাশে উঁচু টিলা, যেখানে পানি উন্নয়ন বোর্ডের অফিস এবং রহমতগঞ্জ রোডের পূর্ব পাশে যেখানে সওজ ও গণপূর্ত বিভাগের স্থাপনাগুলো আছে, সেগুলোসহ পূর্ব পার্শ্বস্থিত পাহাড়ি অঞ্চলটি যোগেশ বাবুর মালিকানাধীন ছিল। এই জমিদারদের স্মৃতিও সংরক্ষণ করা হয়নি’।
তবে চলতি বছরের ২২ জানুয়ারি সদরঘাট এলাকায় প্রয়াত চিকিৎসক, বীর মুক্তিযোদ্ধা ললিত কুমার দত্তের নামে দক্ষিণ নালাপাড়া সড়কের নামকরণ করেছে চসিক। নাক, কান-গলা বিশেষজ্ঞ ৭৭ বছর বয়সী ডা. ললিত কুমার দত্ত চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের দ্বিতীয় ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন। ১৯৭১ সালে ভারতের গোকুল নগর ক্যাম্পে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসায় নিয়োজিত ছিলেন তিনি।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক) এর হিসাবে, নগরে মোট সড়ক সংখ্যা ৩ হাজার ৪৫৯টি। সড়কের নামকরণ, পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও সংশোধনের ক্ষেত্রে নামকরণ উপ-কমিটি বিষয়টি পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও যাচাই-বাচাই করে। সুপারিশকৃত সিদ্ধান্ত মেয়রের অনুমোদনের পর সিটি করপোরেশনের সাধারণ সভায় উপস্থাপন করে সুপারিশক্রমে অনুমোদন করতে হয়। এরপর অনুমোদনকৃত সিদ্ধান্ত সরকারের অনুমতির জন্য স্থানীয় সরকার বিভাগে পাঠাতে হয়। তারপরই সড়ক বা স্থাপনার নামকরণ চূড়ান্ত করে সিটি করপোরেশন।
চসিক মেয়র এম রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, ‘কয়েক বছর পর আমি বা কোনো মুক্তিযোদ্ধাই বেঁচে থাকবো না। তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি- যাদের আত্মত্যাগে দেশ স্বাধীন হয়েছে তাদের স্মৃতি চিরঞ্জীব রাখতে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সড়ক ও স্থাপনার নাম মুক্তিযোদ্ধাদের নামে নামকরণ করবো’।
বাংলাদেশ সময়: ১১২৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০২৪
এসি/টিসি