চট্টগ্রাম: বয়স আট ছুঁই ছুঁই অনিকের ওজন ১৯ কেজি। জামালখান সেন্ট মেরীস্ স্কুলে ১ম শ্রেণিতে পড়ুয়া এই শিক্ষার্থীর বোর্ড অনুমোদিত বই বাংলা, ইংরেজি, গণিতের সঙ্গে যোগ করা হয়েছে আরও ৫টি।
সব মিলিয়ে ব্যাগের ওজন দাঁড়ায় ১ কেজি ৪শ গ্রাম। সপ্তাহে পাঁচদিন স্কুলে যাওয়া-আসার সময় দুইবার কাঁধে তুলতে হয় ব্যাগের ভার। তার মতো অবস্থা প্রায় সব শিশুরই। অভিভাবকরা বলছেন, কেজি শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের কথিত স্কুলগুলোর কারণেই এই বাড়তি বোঝা বহন করতে হচ্ছে।
নগরের বেশ কয়েকটি স্কুলের শিশু শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রুটিন অনুযায়ী সব বই-খাতা না আনলে শ্রেণি শিক্ষকরা বকা দেন। তাই প্রতিদিন ৫-৬টি বই এবং সবগুলোর আলাদা খাতা নিয়ে আসতে হয়।
তৃতীয় শ্রেণির বইয়ের লিস্ট থেকে জানা যায়, বোর্ড অনুমোদিত তিনটি বইয়ের বাইরে বিভিন্ন বেসরকারি কিন্ডারগার্ডেন ও স্কুলে রয়েছে ছয়-সাতটি বই। বাংলা নীতিকথা, বাংলা পঠন, ইংরেজি স্পেলিং বুক, ইংরেজি পঠন, সাধারণ জ্ঞান, চারুকারু, গল্পের বই। আছে হরেক নামের খাতাও। সব মিলিয়ে ব্যাগের ওজন দাঁড়ায় আড়াই থেকে তিন কেজি।
আগ্রাবাদ মোল্লাপাড়ার বাসিন্দা ৫ম শ্রেণির শিক্ষার্থী সাজিয়া আফরিন। তার বাবা ব্যাংক কর্মকর্তা জয়নুল আবেদীন বাংলানিউজকে বলেন, সেই কেজি থেকে দেখে আসছি বই-খাতার ভার। এখনও ভার কমেনি। বছর যেতেই ভার শুধু বেড়েছে। বোর্ড অনুমোদিত বইয়ের বাইরে অপ্রয়োজনীয় বই কিনতে হয়। ভালো করে বাংলা পড়তে না পারলেও আরেক সন্তানের জন্য বাংলা ব্যাকরণ, ইংরেজি ব্যাকরণ, সাধারণ জ্ঞান, অঙ্কন শিক্ষা, জ্যামিতি শিক্ষা, লেখা শেখার বইসহ নানান রঙের বই কিনতে হয়েছে। এটা জোর করেই চাপিয়ে দেওয়ার মতো। কিন্তু প্রতিবাদ করার সাহস কারও নেই।
চট্টগ্রামে জেলা ও মহানগর মিলিয়ে কিন্ডারগার্টেন স্কুল পরিচালকদের কয়েকটি সংগঠন রয়েছে। বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ঐক্য পরিষদের চেয়ারম্যান এম ইকবাল বাহার চৌধুরী জানান, জেলা ও মহানগরে ২২শ এর বেশি কিন্ডারগার্টেন স্কুল রয়েছে। মহানগরে ১২শ কিন্ডারগার্টেন রয়েছে। আর এক হাজার কিন্ডারগার্টেন রয়েছে জেলায়। এসব প্রতিষ্ঠানে নির্ধারিত সিলেবাস মেনেই পাঠ্যবই নির্ধারণ করা হয়। সেখানে শিশুদের সরকারি স্কুলের চেয়ে একটু বাড়তি শেখানো হয়।
শিশুরোগ বিশেষজ্ঞদের মতে, পাঁচ বছরের ছেলেশিশুর আদর্শ ওজন ১৮ দশমিক ৭ কেজি, মেয়ের ১৭ দশমিক ৭ কেজি। ছয় বছরের ছেলেশিশুর আদর্শ ওজন ২০ দশমিক ৬৯ কেজি, মেয়ের ১৯ দশমিক ৯৫ কেজি। শিশুর শরীরের ওজনের ১০ শতাংশের বেশি ভার বহন করা উচিত নয়। এতে পিঠ ও পায়ে ব্যথাসহ বিভিন্ন রকমের সমস্যা দেখা দেয়। চেম্বারে প্রায় এ ধরনের রোগী আসে, যারা বইয়ের ভারে শারীরিক জটিলতায় পড়ছে।
সে হিসাবে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীর ব্যাগের ওজন তার শরীরের ওজনের ১০ শতাংশ, অর্থাৎ সর্বোচ্চ ২ কেজি হওয়ার কথা। সেখানে চট্টগ্রামের খ্যাতনামা বিভিন্ন স্কুলে ৪র্থ-৫ম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ব্যাগের ওজন পাওয়া গেছে সর্বনিম্ন ৩ থেকে সর্বোচ্চ সাড়ে ৪ কেজি। একই অবস্থা ইংরেজিমাধ্যম স্কুলগুলোতেও।
এক রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রাথমিক স্কুলের শিশুদের শরীরের ওজনের ১০ শতাংশের বেশি ভারী স্কুলব্যাগ বহন নিষেধ করে ২০১৬ সালে রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট। বিষয়টি তদারকি করতে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরকে সার্কুলার জারি করার নির্দেশ দেওয়া হয়। সার্কুলারে মনিটরিং সেল গঠন, শিশুদের ১০ শতাংশের বেশি ওজন বহন করানো হলে শাস্তিমূলক কী ব্যবস্থা থাকবে, তা উল্লেখ করে ওই পরিপত্র জারি করতে বলা হয়। কিন্তু এরপর এ বিষয়ে আর কোনো তদারকি হয়নি।
এনায়েতবাজার এলাকার বাসিন্দা মোস্তাফিজুর রহমান। ব্যবসা সামলে সন্তানকে প্রতিদিন স্কুলে দিয়ে আসেন এবং নিয়েও আসেন। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, বইয়ের এত বোঝা ৩য় শ্রেণি পড়ুয়া ছেলে টানতে পারে না। এ জন্য বাবার পিঠে তুলে দেয়। স্কুলে বাচ্চাদের জন্য শেলফ রাখা দরকার। যেটা শ্রেণি শিক্ষক নিয়ন্ত্রণ করবেন। সেখানে সহপাঠের বইগুলো রাখলে ব্যাগের ভার কমবে।
২য় শ্রেণির ছাত্রী সাইমাকে চকবাজার থেকে জামালখানের স্কুলে নিয়ে আসেন গৃহিণী খাদিজা আক্তার। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এতটুকু বাচ্চার জন্য বই-খাতা অনেক বেশি, তার ওপর পড়ালেখার চাপ। মেয়ের স্কুল ব্যাগ আমিই বহন করি গেইট পর্যন্ত। কিন্তু এরপর সিঁড়ি বেয়ে ওঠানামা করতেই ওর কষ্ট হয়।
সন্তানদের দৈহিক গড়নের তুলনায় বইয়ের বাড়তি বোঝা বয়ে স্কুলে আসা-যাওয়ার এমন চিত্র দেখা যায় নগরের স্কুল ও কোচিং সেন্টারে। বাজারের অখ্যাত প্রকাশনা সংস্থা নিম্নমানের বই প্রতিষ্ঠানগুলোতে পাঠ্য করিয়ে শিশুদের পিঠে অতিরিক্ত বোঝা চাপিয়ে দিচ্ছে। এতে লাভবান হচ্ছেন স্কুল কর্তৃপক্ষ ও বই ব্যবসায়ীরা।
প্রবীণ শিক্ষক হরপ্রসাদ দে এর মতে, শহরের বিদ্যালয়গুলোতে আগে শেখানো বা পড়ানোর প্রবণতা বেশি। কেজি শ্রেণিতে পড়ানো হয় ১ম শ্রেণির সিলেবাস। অথচ সেটা ১ম শ্রেণিতে পড়ালে শিশুর কোনো ক্ষতি নেই। ব্যাগের বোঝার কারণে শিশুর মনে পাঠভীতি ভর করে। শিক্ষকদের উচিত হবে, শিশুদের আগে শেখানোর প্রবণতা বাদ দেওয়া। তাহলে হয়তো বইয়ের বোঝা কমবে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়কে আরও সক্রিয় হতে হবে।
পাথরঘাটা এলাকার একটি বেসরকারি স্কুলের সহকারী শিক্ষক জামাল উদ্দীন বলেন, প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার নামে শিশু শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হচ্ছে। ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলে এই প্রতিযোগিতা বেশি। শিশুদের বইয়ের ব্যাগ বহনের কষ্ট বুঝতে বিশেষজ্ঞ হতে হয় না। এই হয়রানি বন্ধে সরকারকে উদ্যোগী হতে হবে।
ফিজিওথেরাপিস্ট মেহেরুন নেসা জানান, শিশুদের কাঁধে স্কুলের ভারী ব্যাগ নানা রকমের স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করছে। দীর্ঘদিন কাঁধে ব্যাগ বহনের কারণে মাংসপেশি শক্ত হয়ে যায়। ফলে রক্ত চলাচল ব্যাহত হয়ে ঘাড়, কাঁধ, কোমর ও হাঁটুতে ব্যথা, এমনকি মাথাব্যথাও হয়। এক কাঁধে ভারী ব্যাগ বহনের ফলে দুই কাঁধের ভারসাম্য নষ্ট হয়, মেরুদণ্ডের বিন্যাসের ক্ষতি হয় এবং শিশু কিছুটা বাঁকা হয়ে সামনের দিকে ঝুঁকে হাঁটতে শুরু করে। এছাড়া ঘাড় ও কাঁধের মাংসপেশিতে আঘাত লাগতে পারে। মানসিক অবসাদ, বিষণ্নতা, এমনকি অনেক সময় শরীরের ভেতর কোনো অঙ্গের ক্ষতিও হতে পারে।
চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, দেশে প্রায় ৫০ লাখ মানুষ এই সমস্যায় ভুগছেন। রোগের অন্যতম কারণ হিসেবে উঠে এসেছে ভারী স্কুলব্যাগ। দশম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা ভারী স্কুলব্যাগ বহন করে। দীর্ঘসময় এই ভারী ব্যাগ বহনের কারণে অনেকের মেরুদণ্ড বাঁকা হয়ে যায়, পিঠে-ঘাড়ে চাপ পড়ে। অল্প বয়স থেকেই তারা মেরুদণ্ডের সমস্যা নিয়ে বেড়ে ওঠে। শিশুদের জন্য স্কুলে ব্যবহৃত বেঞ্চ বা চেয়ারগুলো স্বাস্থ্যসম্মত নয়। এরাই ৪০ থেকে ৫০ বছরে পৌঁছালে অনেকে মেরুদণ্ডজনিত সমস্যায় আক্রান্ত হন।
চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের কমিউনিটি মেডিসিনের প্রভাষক ডা. মনোজ চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, ভারী স্কুল ব্যাগ বহনের কারণে শিশুদের পিঠে ও ঘাড়ে চাপ পড়ছে। হাসপাতাল ও চেম্বারে এ ধরনের শিশুরা আসে ঘাড় এবং পিঠের ব্যথা নিয়ে। শুধু ঘাড় ও পিঠ নয়, যেহেতু পুরো শরীরের ভার পায়ের ওপর পরে, তাই হাঁটুতে চাপও পরে বেশি। এভাবে শিশুরা যদি ছোটবেলা থেকেই ভার বহন করে, তাহলে তাদের বাঁকা হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
বাংলাদেশ সময়: ১২০০ ঘণ্টা, মে ২৪, ২০২৪
এসি/টিসি