চট্টগ্রাম: চট্টগ্রাম মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের বর্তমান সচিব ও সাবেক পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক প্রফেসর নারায়ণ চন্দ্র নাথের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের তদন্তের অংশ হিসেবে বোর্ডের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সাক্ষাৎকার নিয়েছে তদন্ত কমিটি। সেই কমিটির গুরুত্বপূর্ণ ও গোপনীয় এ বৈঠকে বোর্ডের উপসচিব মোহাম্মদ বেলাল হোসেনের উপস্থিতিকে বিব্রত হয়েছেন বোর্ডের কর্মকর্তারা।
তারা বলেন, চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের সচিব অধ্যাপক নারায়ণ চন্দ্র নাথের বিষয়ে তদন্ত করতে ঢাকা থেকে কর্মকর্তারা এসেছেন।
সোমবার (৩ জুন) সকাল ১০টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যানের সম্মেলন কক্ষে বোর্ডের বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ডেকে কথা বলেন তদন্ত কমিটির দুই সদস্য।
নারায়ণ চন্দ্র নাথের ছেলে নক্ষত্র দেব নাথ ২০২৩ সালের এইচএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হন। তবে তিনি একটি বিষয়ে জিপিএ-৫ পাননি। সেজন্য সচিবের পরিবার পুনর্নিরীক্ষণের জন্য আবেদন করতে চায়।
কিন্তু পুনর্নিরীক্ষণের আবেদন করতে গিয়ে দেখতে পায়, কে বা কারা আগেই নক্ষত্র দেব নাথের ছয় বিষয়ের ১২টি পত্রের আবেদন করে ফেলেছেন।
বিষয়টি সন্দেহজনক মনে হওয়ায় সচিবের স্ত্রী বনশ্রী নাথ পুনর্নিরীক্ষণের আবেদনকারীকে শনাক্ত ও আইনি প্রতিকার চেয়ে গত ৪ ডিসেম্বর পাঁচলাইশ থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। পরে এ নিয়ে তদন্তে নামে পুলিশ।
তদন্তে নেমে পুলিশ জানতে পারে, চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের সাবেক সচিব অধ্যাপক আবদুল আলীমের মোবাইল ফোন নম্বর রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করে নক্ষত্র দেব নাথের নামে পুনর্নিরীক্ষণের আবেদনটি করা হয়েছিল।
বিষয়টি উল্লেখ করে গত ১৫ জানুয়ারি আদালতে প্রতিবেদন জমা দেয় পাঁচলাইশ থানা পুলিশ।
এই ঘটনায় শিক্ষা বোর্ডের সাবেক সচিব আবদুল আলীম ও চট্টগ্রাম কলেজের সাবেক অধ্যাপক মুহাম্মদ ইদ্রিস আলীর বিরুদ্ধে সাইবার নিরাপত্তা আইনে মামলা করেন বোর্ডের বর্তমান সচিব নারায়ণ চন্দ্র নাথের স্ত্রী বনশ্রী দেবনাথ।
এতে ইদ্রিসকেও আসামি করা হয়েছে। কারণ, তিনি অধ্যাপক নারায়ণ চন্দ্র নাথকে নিয়ে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বক্তব্য দিয়েছিলেন। সেই বক্তব্যগুলো বিভ্রান্তিকর ও মানহানিকর বলে অভিযোগ করেন নারায়ণ চন্দ্র নাথ।
এদিকে, সচিবের ছেলের ফলাফল সংক্রান্ত বিষয়ে তদন্ত করছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ও অর্থাৎ একই বিষয়ে একটি সাইবার ট্রাইব্যুনাল মামলার ফৌজদারি মামলার তদন্ত এবং অন্যটি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আদেশক্রমে তদন্ত চলছে।
এদিকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আদেশে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) করা তদন্ত কমিটির তিন সদস্যের দুইজন সোমবার (৩ জুন) সকালে চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডে আসেন। তারা হলেন, কমিটির আহ্বায়ক মাউশির মনিটরিং ও ইভ্যালুয়েশন উইংয়ের পরিচালক অধ্যাপক মো. আমির হোসেন এবং সদস্য মাউশির ইএমআইএস সেলের সিনিয়র সিস্টেম অ্যানালিস্ট খন্দকার আজিজুর রহমান।
তদন্ত কমিটির দুই সদস্য সকাল থেকে বোর্ডের বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বক্তব্য নেওয়া শুরু করেন। সেই কার্যক্রমে শুরু থেকে উপস্থিত ছিলেন বোর্ডের উপসচিব বেলাল হোসেন। বিকেল সাড়ে তিনটার সময় শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যানের দপ্তরে গেলে পাশের সম্মেলন কক্ষে বেলাল হোসেনকে তদন্ত কমিটির সদস্যদের পাশে বসে থাকতে দেখা যায়। অবশ্য সাংবাদিকদের উপস্থিতি টের পেয়ে বেলাল হোসেন সেখান থেকে বেরিয়ে যান। পরে আধাঘণ্টা পর সাংবাদিকেরা শিক্ষা বোর্ড ছাড়লে তিনি ফের সাক্ষাৎকার নেওয়ার কক্ষে প্রবেশ করেন বলে জানা গেছে।
তদন্ত কমিটি শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক প্রফেসর এ এম এম মুজিবুর রহমানের বক্তব্যও নিয়েছে। এই কর্মকর্তা উপসচিব উপস্থিত থাকায় বিব্রত হয়েছেন বলে জানিয়েছেন।
তিনি বাংলানিউজকে বলেন, বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক হিসেবে আমি সেখানে উপস্থিত হয়ে তদন্ত কমিটির জানতে চাওয়া বিষয়গুলোর উত্তর দিয়েছি। সেখানে বোর্ডের আরেকজন কর্মকর্তা থাকা তো আমার জন্য বিব্রতকর! তিনি বাইরে থাকতে পারতেন। আর উনি তদন্ত কমিটির সদস্য না। তারপরও কীভাবে তিনি সেখানে থেকেছেন সেটি আমি জানি না’।
বোর্ডের উপপরীক্ষা নিয়ন্ত্রক (উচ্চ মাধ্যমিক) মোহাম্মদ দিদারুল আলমও তদন্ত কমিটির ডাকে কথা বলতে গিয়ে উপসচিব বেলাল হোসেনকে দেখে বিব্রত হয়েছেন।
তিনি বাংলানিউজকে বলেন, তিনি (বেলাল হোসেন) থাকলে আমি কথা বলতে পারবো না। পরে তিনি কক্ষের বাইরে চলে যান। এরপর আমি তদন্ত কমিটির সঙ্গে কথা বলি।
বোর্ডের সচিব নারায়ণ চন্দ্র নাথও তদন্ত কমিটির সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময় উপসচিব বেলাল হোসেনের উপস্থিত থাকা নিয়ে প্রশ্ন তুলে ন্যায়বিচার পাওয়া নিয়ে আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, ‘আমি শুনেছি, তদন্তকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে চেয়ারম্যান ও উপসচিব নানাভাবে চাপ দিয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাছ থেকে আগে বক্তব্য নিয়েছিলেন। সংবাদমাধ্যমেও এই বিষয়টি আলোচিত হয়েছে। সেখানে তদন্ত কমিটির সদস্যরা সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময় যদি উপসচিব উপস্থিত থাকেন, তাহলে তো কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সত্য কথা বলতে সাহস করবেন না। সেজন্য আমি মনে করি, তদন্ত কার্যক্রমে এটি নেতিবাচক প্রভাব পড়বে আর তদন্ত কমিটির সদস্যের বাইরের কেউ সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময় উপস্থিত থাকা ন্যায়বিচারের পরিপন্থী বলে মনে করি। ’
তবে বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেজাউল করিম বলেন, তদন্ত কমিটিকে সহযোগিতা করার জন্য বোর্ডের চার কর্মকর্তাকে আমি দায়িত্ব দিয়েছিলাম। সেই চারজনের একজন উপসচিব বেলাল হোসেন। তিনি তদন্ত কমিটিকে সহযোগিতা করছেন। ’
যদিও তদন্ত কমিটির সদস্যদের গ্রহণ করা, থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা করার জন্য ওই কমিটি গঠন করা হয়েছিল।
তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক মাউশির মনিটরিং ও ইভ্যালুয়েশন উইংয়ের পরিচালক অধ্যাপক মো. আমির হোসেনের সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে পারবেন না বলে জানান।
উপসচিব মো. বেলাল হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, তদন্ত কমিটিকে সার্বিক সহযোগিতার জন্য কমিটি গঠন করা হয়েছে। তিনি কমিটির সদস্য। সহযোগিতা করার জন্য তাঁকে ডাকা হয়েছিল।
এব্যাপারে মাউশি চট্টগ্রামের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক গাজী গোলাম মাওলা বাংলানিউজকে বলেন, তদন্ত চলাকালীন সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময় তদন্ত কমিটির সদস্য ছাড়া অন্য কেউ থাকা সমীচীন নয়।
বাংলাদেশ সময়: ২৩৩০ ঘণ্টা, জুন ৩, ২০২৪
বিই/পিডি/টিসি