চট্টগ্রাম: চট্টগ্রামে ২৬টি পাহাড়ে প্রায় ৬ হাজার ৫৫৮টি পরিবার ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় বসবাস করছে। এই ২৬ পাহাড়ের মধ্যে সরকারি বিভিন্ন সংস্থার মালিকানাধীন ১৬টি এবং ব্যক্তি মালিকানাধীন ১০টি।
অভিযোগ রয়েছে, সরকারি-বেসরকারি মালিকানাধীন পাহাড়গুলোতে অবৈধভাবে দেওয়া হয় বিদ্যুৎ ও পানির সংযোগ।
প্রতিবছরই পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটে এসব বসতঘরে। প্রাণ হারানো পর প্রশাসনের নড়েচড়ে বসে প্রশাসন। শুরু হয় মাইকিং। ডাকা হয় পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির সভা। এরপর পাহাড় থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় অবৈধ বসবাসকারীদের। কিন্তু বৃষ্টি থামলে আবারও পাহাড়ে বসতি গড়েন তারা।
জেলা প্রশাসনের হিসাবে, চট্টগ্রামের ২৬টি পাহাড়ে ঝুঁকি নিয়ে ৬ হাজার ৫৫৮টি পরিবারের প্রায় ৩০ হাজার মানুষের বসবাস। ২৬টি পাহাড়ের মধ্যে সাতটি পাহাড় রেলওয়ে (পূর্বাঞ্চল) চট্টগ্রামের মালিকানাধীন। সেই পাহাড়গুলোর মধ্যে পলিটেকনিক হল্ট স্টেশন সংলগ্ন পাহাড়ের পাদদেশে ১২টি, ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় ফৌজি ফ্লাওয়ার মিল সংলগ্ন পাহাড়ের পাদদেশে ৫টি, ষোলশহর স্টেশন সংলগ্ন পাহাড়ের পাদদেশে ৭৪টি, ফয়’স লেক এলাকার ১, ২, ৩ নম্বর ঝিলসংলগ্ন পাহাড়ে ৪ হাজার ৪৭৬টি, মতিঝর্ণা ও বাটালী হিল সংলগ্ন পাহাড়ে ৪৩১টি, পরিবেশ অধিদপ্তর সংলগ্ন পাহাড়ে ৪৬টি, লেকসিটি আবাসিক এলাকা সংলগ্ন বিজয় নগর পাহাড়ে ২৮৮টি পরিবার বসবাস করছে।
গণপূর্ত বিভাগ-৩ এর মালিকানাধীন বাটালী হিল ও মতিঝর্ণা অংশের পাহাড়ে বাস করছে ৮৮টি পরিবার। জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের মালিকানাধীন ফিরোজ শাহ হাউজিং এস্টেট সংলগ্ন পাহাড় ও কৈবল্যধাম হাউজিং এস্টেট সংলগ্ন পাহাড়ের পাদদেশে বাস করছে যথাক্রমে ৪৯ ও ১৪৬টি পরিবার।
১ নম্বর খাস খতিয়ানভুক্ত তিন পাহাড়ের উত্তর পাহাড়তলী মৌজার ১৫০ দাগের পাহাড়ে (জয়ন্তিকা আবাসিক সংলগ্ন) ২৮টি, বিএস ২১২ ও ২১৩ দাগের পাহাড়ে (মুরগি ফার্ম হয়ে গার্ডেন ভিউ সোসাইটি সংলগ্ন) ১২টি এবং আকবর শাহ বেলতলী পাহাড়ে ৮৯টি পরিবার ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে।
অন্যদিকে, এপিভুক্ত (পরিত্যক্ত সম্পত্তি) পলিটেকনিক কলেজ সংলগ্ন পাহাড়ে ৪৩টি এবং ভিপিভুক্ত (অর্পিত সম্পত্তি) লালখানবাজার জামেয়াতুল উলুম মাদ্রাসা সংলগ্ন পাহাড়ে ৩২৩টি পরিবার বসবাস করছে।
বাকি ১০টি ব্যক্তি মালিকানাধীন পাহাড়ের মধ্যে হারুন খান সাহেবের পাহাড়ে ১৪৪টি, নাছিয়াঘোনা এলাকার পাহাড়ে ১২টি, চিড়িয়াখানার পেছনের পাহাড়ে ২৮টি, মধুশাহ পাহাড়ে ২৯টি, জালালাবাদ সংলগ্ন পাহাড়ে ৫টি, নাগিন পাহাড়ে ২৫টি, ফরেস্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট সংলগ্ন মীর মোহাম্মদ হাসানের পাহাড়ে ৩৮টি, এমআর সিদ্দিকীর পাহাড়ে ৪২টি, মিয়ার পাহাড়ে ৪৯টি এবং ভেড়া ফকিরের পাহাড়ে (রৌফাবাদ, অক্সিজেন) ১১টি পরিবারের সদস্যরা ঝুঁকি নিয়ে বাস করছেন।
চট্টগ্রাম নগরে ২০০৭ সালের ১১ জুন ভয়াবহ পাহাড়ধসে মারা যান ১২৭ জন। এর মধ্যে লালখানবাজার ওয়ার্ডের মতিঝর্না এলাকায় মারা গিয়েছিলেন ১১ জন। সেই ভয়াল ঘটনার পর জন্ম হয় পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির। কমিটির দায়িত্ব ছিল- বিশেষজ্ঞ কমিটির দেওয়া ৩৬ দফা সুপারিশ বাস্তবায়নে কাজ করা। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল- পাহাড় কাটা বন্ধ করে ঝুঁকিপূর্ণ বসতি উচ্ছেদ করা। তবে পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটি কেবল বর্ষা এলেই সভা করে দায় সারে।
২০০৭ সালের পর থেকে প্রতিবছর বর্ষার আগে পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির সভায় বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাসের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে উচ্ছেদ ও পাহাড় কাটা বন্ধ করার সিদ্ধান্ত হয়। সেই সিদ্ধান্ত অনুসারে কিছু কাজও হয়। কিন্তু এরপর দীর্ঘ ঘুমে চলে যায় পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটি! আর এই সুযোগে পাহাড়ে নতুন করে বসতি স্থাপন চলে।
সেই কাজে স্বয়ং সহযোগিতা করে সরকারি তিন সংস্থা চট্টগ্রাম ওয়াসা, চট্টগ্রাম বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড এবং কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন করপোরেশনের কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী। তারাই ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে ঘুষের বিনিময়ে পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংযোগ পৌঁছে দেন। আর এই পাহাড়গুলোর বেশিরভাগই নিয়ন্ত্রণ করেন কাউন্সিলরসহ স্থানীয় প্রভাবশালীরা। ফলে, প্রশাসন চাইলেও ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসকারীদের সরাতে পারে না।
বৃহস্পতিবার (২০ জুন) অনুষ্ঠিত পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির সভায় এসব পাহাড়ে ১৫ দিনের মধ্যে পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের যেসব অবৈধ সংযোগ রয়েছে, সবগুলো বিচ্ছিন্ন করার নির্দেশ দেওয়া হয়। এছাড়াও এসব সেবা সংস্থার প্রধানদের ১৫ দিন পরপর কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটিকে জানাতে নির্দেশনা দেন বিভাগীয় কমিশনার।
বাংলাদেশ সময়: ১৪২০ ঘণ্টা, জুন ২১, ২০২৪
বিই/টিসি