চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়: মাথায় টুপি। মুখভর্তি সফেদ দাড়ি।
চবি মেরিন সায়েন্সেস ইনস্টিটিউটের ৫০ বছর পূর্তিতে আয়োজিত সুবর্ণজয়ন্তী উৎসবে অংশ নিতে এসেছেন তারা ৬ বন্ধু-আব্দুল কবির ভুইঞা, আবসার কামাল, কবির আহাম্মদ, ওবায়দুল কাদের, আবুল খায়ের ও বোরহানা বেগম। সবার বয়স সত্তরের বেশি। অবসরেও গেছেন বহু আগে। ছেলেমেয়েরা ইতিমধ্যে প্রতিষ্ঠিত- কেউ ডাক্তার, কেউ ইঞ্জিনিয়ার, আবার কারও পড়াশোনা শেষ পর্যায়ে। এমনকি সবার নাতি-নাতনিরাও বড় হয়ে গেছে। পড়ন্তবেলায় বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হওয়ার সুযোগটি তাই হয়তো হাতছাড়া করতে চাননি বলেই অসুস্থ শরীর নিয়ে সবাই ছুটে এসেছেন প্রাণের ক্যাম্পাসে।
আব্দুল কবির ভুইঞা জানান, তারা ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অষ্টম ব্যাচ। আর মেরিন বায়োলজি বিভাগের প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থী। ১৯৭৩-৭৪ শিক্ষাবর্ষে মাস্টার্সে ভর্তি হয়েছিলেন তারা। তখন চট্টগ্রামের সদরঘাটে ৩৩০ নম্বর ভবনটি ভাড়া নিয়ে চবির বিজ্ঞান অনুষদের অধীনে মেরিন বায়োলজি বিভাগটি পরিচালিত হতো। তবে সেসময় এই বিভাগ থেকে ক্যাবল দুই বছর মেয়াদী মাস্টার্স করা যেতো। বিভাগের কার্যক্রম ক্যাম্পাসের বাইরে পরিচালিত হওয়ায় তখন তেমন ক্যাম্পাসে আসা হতো না তাদের। প্রথম ব্যাচে এ বিভাগে শিক্ষার্থী ছিলো ২২ জন। যার মধ্যে ৮ জনই মারা গেছেন। আর বাকিরাও ভুগছেন বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন অসুস্থতায়।
আব্দুল কবির ভুইঞা সর্বশেষ ৫ বছর আগে ২০১৯ সালে একটি পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে ক্যাম্পাসে এসেছিলেন। তবে এর আগে ৪৩ বছর আসা হয়নি ক্যাম্পাসে। ক্যাম্পাসে সবচেয়ে কাছের বন্ধু আলী আজম খান ও ওয়াহেদুন নবী দু'জনেই মারা গেছেন। সুবর্ণজয়ন্তীতে তাদেরকে নিশ্চয়ই খুব মিস করছিলেন, সেটা একাকী বসে থাকা কবির ভুইঞাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছিলো। তবে মনখারাপের কথা বলতে নেই, তাই হয়তো বলেননি। বাকি বন্ধুদের দেখিয়ে বললেন, 'মন খারাপ না, বন্ধুরা তো আছেই'।
তবে কবির ভুইঞা ব্যক্তিগত জীবনে সফলই বলা যায়। কেননা ছেলে-মেয়ে দুজনেই এমবিবিএস ডাক্তার। ২২ বছর আগে ২০০২ সালে চাকরি থেকে অবসরে গিয়ে করেছেন ব্যবসাও।
একই ব্যাচের শিক্ষার্থী আবসার কামাল বলেন, আমাদের ব্যাচের সবার বয়স ৭০ এর বেশি। ক্যাম্পাসে এ ধরনের অনুষ্ঠানে আসার উদ্দেশ্য সবাইকে একসঙ্গে দেখতে পাওয়া। তবে বন্ধুদের অনেকেই মারা গেছে। সবাই বহু আগে চাকরি-বাকরি শেষে অবসরে এখন। সবার ছেলেমেয়েও বড় হয়ে গেছে। আমার ছেলেমেয়ে ৪ জনই ইতিমধ্যে পড়াশোনা শেষ করেছে। নাতি-নাতনিও ৫ম-৬ষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে এখন।
তাদের আরেক বান্ধবী বোরহানা বেগম। তিনি চট্টগ্রাম লেডিস ক্লাবের সেক্রেটারি দীর্ঘদিন। সন্দ্বীপ বাড়ি হলেও থাকেন চট্টগ্রামেই। ছেলেমেয়েরা সবাই প্রতিষ্ঠিত। সামাজিক বিভিন্ন কাজ আর নাতি-নাতনিদের সঙ্গেই কাটে এখন সময়। সুবর্ণজয়ন্তীতে ঢাকা থেকে আসা বন্ধুদের থাকার ব্যবস্থা নিজের বাসাতেই করেছিলেন। অবশ্য নাতি তাদের পরিচয় শুনে বলেছিল 'দাদু, তোমারও বন্ধু আছে নাকি?' কথাটি শুনেই সবাই একসঙ্গে হাসলেন।
চবি মেরিন সায়েন্সেস ইনস্টিটিউটের প্রথম ব্যাচের ৮ জনই মারা গেছেন। মৃত গিয়াস উদ্দিন খান, আলী আজম খান, ওয়াহেদুন নবী, ফরিদুল আলম, অনিমা পোদ্দার, আব্দুল মান্নান, মাঈন উদ্দিনের নাম বলতে পারলেও আরেকজনের নাম বহু চেষ্টা করেও মনে করতে পারেননি তারা। হয়তো ছয় বন্ধুর একসঙ্গে এটাই শেষ ছবি। পরের কোনো মিলনমেলায় সেই বন্ধুকেও হয়তো মিস করবেন তারা।
এভাবে কত গল্পই না লুকিয়ে ছিল মেরিন সায়েন্সেস ইনস্টিটিউটের সুবর্ণজয়ন্তী উৎসবে। ১১ জানুয়ারি দিনব্যাপী আয়োজিত এ উৎসব ছিলো প্রাক্তন ও বর্তমান শিক্ষার্থীদের মিলনমেলা। অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছেন ৩০তম ব্যাচের ৩৮ জনই। পুরো আয়োজন জমিয়ে রেখেছিলেন তারা। বন্ধুদের পেয়ে সবাই যেন হারিয়ে গেছে ফেলে আসা দিনে। ফিরে এসেছে সেই তারুণ্য।
সুবর্ণজয়ন্তীর আলোচনা সভা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ড. শেখ আফতাব উদ্দিনের শুভেচ্ছা বক্তব্যের মধ্য দিয়ে শুরু হয়। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন চবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. ইয়াহ্ইয়া আখতার। বিশেষ অতিথি ছিলেন চবি উপ-উপাচার্য (অ্যাকাডেমিক) অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ শামীম উদ্দিন খান। উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. মো. কামাল উদ্দিন। এছাড়াও বক্তব্য দেন মেরিন সায়েন্সেস অ্যান্ড ফিশারিজ অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মো. শাহাদাত হোসেন এবং ইনস্টিটিউটের অ্যালামনাই সোহেল ইবনে সাত্তার।
অনুষ্ঠানের শুরুতে সমুদ্রবিজ্ঞান চর্চার ৫৪ বছরের সাফল্যের ওপর নির্মিত ভিডিও ডকুমেন্টারি প্রদর্শন করা হয়। এরপর একটি র্যালি ইনস্টিটিউট চত্ত্বর থেকে শহীদ মিনার হয়ে পুনারায় ইনস্টিটিউটে এসে শেষ হয়। দিনব্যাপী আয়োজনে আরও ছিল কেক কাটা, বেলুন উড়ানো, প্রাক্তন অ্যালামনাইদের স্মৃতি চারণ, ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, ক্যাম্পাস ট্যুর, রাফেল ড্র ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। দুই হাজারের বেশি প্রাক্তন-বর্তমানের আয়োজনটি শেষ হয় আর্ক ব্যান্ডের পরিবেশনার মধ্য দিয়ে।
১৯৭১ সালে যাত্রা শুরু করা চবির মেরিন বায়োলজি বিভাগটি পরবর্তীতে মেরিন সায়েন্সেস ইনস্টিটিউট হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। দীর্ঘদিন ধরে সুনীল অর্থনীতির বিকাশ এবং সমুদ্র সম্পর্কিত জ্ঞান চর্চায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছে ইনস্টিটিউটটি। সমুদ্র বিজ্ঞান এবং পরিবেশ রক্ষায় ধারাবাহিক গবেষণার পাশাপাশি ব্লু ইকোনমি, জলবায়ু পরিবর্তন এবং সমুদ্র সম্পদের টেকসই ব্যবহারের ক্ষেত্রে ইনস্টিটিউটটি গত কয়েক দশকে অর্জন করেছে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি। এ ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা দেশ-বিদেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সেক্টরে রাখছেন ভুমিকা।
বাংলাদেশ সময়: ১৮৪০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১২, ২০২৪
এমএ/পিডি/টিসি