ঢাকা, মঙ্গলবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

দিল্লি, কলকাতা, আগরতলা

দিল্লি অভিমুখে সেনা ডিভিশন! বিব্রত মনমোহন সরকার

নয়াদিল্লি করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪০৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ৪, ২০১২
দিল্লি অভিমুখে সেনা ডিভিশন! বিব্রত মনমোহন সরকার

নয়াদিল্লি : ভারত সরকারকে কিছু না জানিয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনীর দুটি ডিভিশন রাজধানী দিল্লির দিকে রওনা দিয়েছিল বলে বুধবার সংবাদ প্রকাশ করেছে প্রভাবশালী ইংরেজি দৈনিক দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস। জানুয়ারির কোনো এক রাতে ভারতের ইতিহাসে অভূতপূর্ব এই  ঘটনা ঘটে বলে পত্রিকাটি দাবি করেছে।

ওই সংবাদের বরাত দিয়ে বিবিসি ও রয়টার্সসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের দেশ ভারতের জন্য চরম বিব্রতকর এ সংবাদটি প্রকাশ করেছে।

তবে ভারতের প্রধ‍ানমন্ত্রী মনমোহন সিং ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের ওই রিপোর্ট সত্য নয় বলে দাবি করে একে ‘আতঙ্কসৃষ্টিকারী’ রিপোর্ট বলে উল্লেখ করেছেন।

তিনি সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘প্রতিরক্ষ‍া মন্ত্রণালয় এরই মধ্যে তাদের অবস্থান পরিষ্কার করেছে। এটা আতঙ্কসৃষ্টিকারী একটি রিপোর্ট। এটাকে পাত্তা দেওয়া মোটেও উচিত হবে না। ’

প্রকাশের পরপরই ভারত সরকারের উচ্চ মহলে এ রিপোর্ট নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। নড়ে উঠেছে দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট বিভাগ। সেনাপ্রধানের সঙ্গে প্রতিরক্ষামন্ত্রীর সংঘাতের আবহের মধ্যেই ফের সামনে চলে এল এই নতুন বিতর্ক। সেই সঙ্গে এই প্রশ্নও সামনে চলে এল: বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র আসলে কতটা নিরাপদ। তাছাড়া এই ঘটনা এমন এক সময়ে ঘটলো যখন  নিরাপত্তা পরিষদের ৬ষ্ঠ স্থায়ী সদস্য হিসেবে নাম লেখানোটা ভারতের জন্য প্রায় নিশ্চিত। এই ঘটনায় সে আশাবাদও কিছুটা হোচট খেল।

প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়কে পুরোপুরি অন্ধকারে রেখেই হিসার এবং আগ্রা থেকে দিল্লি পর্যন্ত সেনাবাহিনীর সন্দেহজনক ত‍ৎপরতার খবর ঘিরে প্রবল চাঞ্চল্য তৈরি হয়েছে রাজনৈতিক মহলেও। বুধবার সকালেই প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ও প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে পুরো ঘটনার সত্যতা অস্বীকার করা হলেও সরকার ও সেনাবাহিনীর মধ্যে সমন্বয়ের অভাব ও চলমান টানাপোড়েন এখন প্রকাশ্য হয়ে উঠলো। আর `` ভারতীয় সেনাবাহিনী সব সময়ই ক্ষমতা থেকে একশো হাত দূরে থাকে`` মর্মে  দীর্ঘদিন ধরে চালু প্রচলিত মিথটাও চুরমার হয়ে গেল।

দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকার দাবি, ১৬ ও ১৭ জানুয়ারি ভারত সরকারকে সম্পূর্ণ অন্ধকারে রেখে হিসার ও আগ্রা থেকে দুটি সেনা ডিভিশন রাজধানী নয়াদিল্লি অভিমুখে মার্চ করেছিল।

পত্রিকাটির অভিযোগ যথারীতি খারিজ করে দিয়েছে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়। তাদের দাবি, এটি ছিল নেহাতই রুটিন মহড়া। রাজধানীর আপদকালীন সুরক্ষা নিশ্চিত করা যায় কিনা, তা পরীক্ষা করতেই এই মহড়া। কিন্তু খোদ ভারতসহ বিশ্বের অনুসন্ধানী গণমাধ্যম তাদের এই ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট নয়। তারা এর তত্ত্ব-তালাশে নেমে পড়েছে।

বুধবার সকালে সর্বভারতীয় এই ইংরেজি দৈনিকটির খবরে দাবি করা হয়, গত ১৬ জানুয়ারি রাতে আগ্রা এবং হিসারের ক্যান্টনমেন্ট থেকে দিল্লি যায় সেনাবাহিনীর মেকানাইজ্‌ড ইনফ্যান্ট্রিও প্যারাট্রুপার রেজিমেন্টের দু`টি ইউনিট। অত্যাধুনিক সাঁজোয়া গাড়ি, অস্ত্রশস্ত্র এবং রাত্রিকালীন যুদ্ধের সরঞ্জাম নিয়ে রাজধানী দিল্লির উপকণ্ঠে হাজির হন ফৌজের এলিট স্ট্রাইকিং গ্রুপের অফিসার ও জওয়ানরা। গোটা ঘটনা সম্পর্কে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছে কোনও তথ্যই ছিল না। অন্ধকারে ছিল গোয়েন্দা বিভাগও।

প্রকাশিত সংবাদটিতে জানান হয়েছে, রাজধানীর দিকে দুই বাহিনীর অগ্রসর হওয়ার খবরে চরম সতর্কতা গ্রহণ করা হয় কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে। খবর দেওয়া হয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রকে। রাইসিনা হিলের রাষ্ট্রপতি ভবনেও শুরু হয় ত‍ৎপরতা। দিল্লিজুড়ে চূড়ান্ত সতর্কতা জারি করে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়।

দিল্লিমুখি সমস্ত গাড়িকে বিশেষভাবে পরীক্ষা করার নির্দেশ দেওয়া হয়। পরে সেনা সদর দফতরের তরফে আগুয়ান সেনা ইউনিট দু`টিকে ছাউনিতে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। ততক্ষণে অবশ্য হিসারের ৩৩ নম্বর আর্মার্ড ডিভিশনের মেকানাইজ্‌ড ইনফ্যান্ট্রি বাহিনী দিল্লির নজফগড় পর্যন্ত এসে পৌঁছেছিল। আগ্রার ৫০ নম্বর প্যারাট্রুপার ব্রিগেডের ইউনিটটি এসে পৌঁছেছিল পালম বিমানবন্দরের কাছে।

সেনা ইউনিটগুলি ফিরে যাওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই বিদেশ সফররত প্রতিরক্ষা সচিব শশীকান্ত শর্মাকে দ্রুত দেশে ফেরার নির্দেশ দেয় প্রতিরক্ষামন্ত্রক। ১৭ তারিখ সকালে গোটা বিষয়টি জানানো হয় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহকে। পুরো ঘটনা সম্পর্কে ডিরেক্টর জেনারেল অফ মিলিটারি অপারেশনস (ডিজিএমও), লেফটেন্যান্ট জেনারেল এ কে চৌধুরির কৈফিয়ত তলব করা হয়। প্রসঙ্গত, আগ্রার ৫০ নম্বর প্যারা ব্রিগেড সরাসরি ডিজিএমওর নিয়ন্ত্রণাধীন।

অন্যদিকে হিসারের ৩৩ আর্মার্ড কোরের কমান্ড রয়েছে মথুরা-স্থিত ১ নম্বর কোর-এর কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল একে সিংয়ের হাতে। দুই ফৈজি কর্তাই সেনাপ্রধান ভিকে সিংয়ের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ অফিসার হিসেবে পরিচিত।

সেনাবাহিনীর বক্তব্য, কুয়াশায় সেনা অভিযানের মহড়া দিতেই রাশিয়ায় নির্মিত অত্যাধুনিক সাঁজোয়া গাড়ি (ইনফ্যান্ট্রি কমব্যাট ভেহিকল্‍) এবং প্যারাট্রুপার ইউনিট নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। অথচ এ ধরনের তৎপরতার কথা জানতো না বায়ুসেনাও।

যদিও আগ্রা-স্থিত ৫০ নম্বর আর্মি প্যারা-ব্রিগেড মূলত বিমানবাহিনীর সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমেই যুদ্ধাভ্যাস করে থাকে। প্রকাশিত খবরে দাবি করা হয়েছে, ইতিমধ্যেই পুরো ঘটনার তদন্ত করে কেন্দ্রের কাছে রিপোর্ট জমা দিয়েছে আইবি।

১৫ জানুয়ারি দিল্লিতে সেনাদিবস অনুষ্ঠান পালনের পর ক্যান্টনমেন্টে ফিরে গিয়েছিল সেনার সংশ্লিষ্ট ইউনিটগুলি। পরদিন, ১৬ জানুয়ারি বয়স বিতর্ক মামলায় সুপ্রিম কোর্টে প্রথম শুনানি ছিল সেনাপ্রধান ভি কে সিংয়ের।

সেদিন রাতেই সেনাবাহিনীর এই নজিরবিহীন তত্পরতায় নতুন করে বিতর্ক উস্কে দিয়েছে। এই ঘটনার জন্য সমন্বয়ের অভাবকেই দায়ী করেছে সেনা অফিসারদের একাংশ। সরকার-সেনাপ্রধান সাম্প্রতিক সংঘাতের পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টি অন্য মাত্রা পেয়েছে।

যদিও মেকানাইজ্‌ড ইনফ্যান্টি ও প্যারাট্রুপার রেজিমেন্টের দু`টি ইউনিটের এই নজিরবিহীন তৎপরতার খবর প্রকাশিত হওয়ার পরই দ্রুত ড্যামেজ কন্ট্রোল-এ নামে সাউথ ব্লক।

সাংবাদিক বৈঠক করে প্রতিরক্ষা সচিব শশীকান্ত শর্মা জানান, সেনাবাহিনীর রুটিন মহড়ার জন্য প্রতিরক্ষা মন্ত্রককে অবহিত করার বিধি নেই।

তার অভিযোগ, পুরো ঘটনা বিকৃত করেছে মিডিয়া।

প্রতিরক্ষামন্ত্রী একে অ্যান্টনিও সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত রিপোর্টেকে `ভিত্তিহীন` বলে বণর্না করেছেন।

এদিন বিশাখাপত্তনমে নৌবাহিনীর একটি অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ভারতীয় সেনা এমন কোনও পদক্ষেপ করবে না যা তার ঐতিহ্য ও মর্যাদার পরিপন্থী। জাতীয় নিরাপত্তার মতো স্পর্শকাতর বিষয়ে খবর প্রচারের ক্ষেত্রে সতর্কতা ও দায়িত্ববোধ থাকা প্রয়োজন বলেও মন্তব্য করেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী।

অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং তার সচিবালয়ের তরফে জারি করা এক প্রেস বিবৃতিতে কেন্দ্রকে না জানিয়ে দিল্লির উপকণ্ঠে দু`টি এলিট আর্মি ইউনিটের হাজির হওয়ার খবর উড়িয়ে দিয়ে জানিয়েছেন সেনাবাহিনী ও সরকারের মধ্যে কোনও সমন্বয়ের অভাব বা ভুল বোঝাবুঝি নেই।

রাজনৈতিক বিতর্ক কিন্তু তাতে থেমে থাকছে না। গোটা ঘটনার জন্য ইউপিএ সরকারের কর্তৃত্বের অভাবকে দায়ী করার পাশাপাশি, গোটা ঘটনার যথাযথ ও বিশ্বাসযোগ্য ব্যাখ্যা না দিতে পারায় প্রতিরক্ষামন্ত্রী এ কে অ্যান্টনির পদত্যাগ চেয়েছে বিজেপি।

 বাংলাদেশ সময় : ১৪০৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ০৪, ২০১২

 আরডি

সম্পাদনা: অশোকেশ রায় ও আহমেদ জুয়েল, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর;

জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর।  

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।