ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

দিল্লি, কলকাতা, আগরতলা

বীরভূমের কীর্ণাহার গ্রাম থেকে ভারতের রাষ্ট্রপতি

রক্তিম দাশ, ব্যুরো চিফ, কলকাতা | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮৩২ ঘণ্টা, জুন ১৬, ২০১২
বীরভূমের কীর্ণাহার গ্রাম থেকে ভারতের রাষ্ট্রপতি

কলকাতা: মাত্র সময়ের অপেক্ষা, এরপরই ভারতের রাষ্ট্রপতি পদে শপথ নিতে যাচ্ছেন প্রণব মুখার্জি। সবকিছু ঠিক থাকলে তিনিই স্বাধীনতার ৬৫ বছর পর প্রথম বঙ্গ সন্তান হিসেবে ভারতের সর্বোচ্চপদে আসীন হতে যাচ্ছেন।



তার রাষ্ট্রপতি হওয়ার মধ্য দিয়ে বাঙালি অন্তত প্রয়াত জননেতা জ্যোতি বসুর প্রধানমন্ত্রী না হওয়ার মনবেদনা এবার হয়তো ভুলতে পারবে।

তার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবন সম্বন্ধে অনেক ভাষ্যকারই বলে এসেছেন, প্রাপ্য মর্যাদা পাননি তিনি। রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচিত হলে সেই আখ্যা থেকে মুক্তি পাবেন তিনি।

পাঁচ দশকেরও বেশি দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবন প্রণব মুখার্জির। বীরভূমের কীর্ণাহারে মুখুজ্যে পরিবার কংগ্রেস রাজনীতিতে স্বাধীনতার আগে থেকেই বিশেষ সক্রিয় ছিল।

বাবা কামদাকিঙ্কর মুখার্জি ছিলেন অধুনালুপ্ত পশ্চিমবঙ্গের বিধান পরিষদের সদস্য এবং কংগ্রেসের বীরভূম জেলা সভাপতি। বাবার আদর্শ অনুসরণ করেই রাজনীতিতে পদার্পণ করেন তিনি। শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে নিলেও সাংবাদিকতাও করেছেন।

আদ্যপান্ত বাঙালি এই মানুষটি, পোশাকে, মানসিকতায় বাঙালিয়ানা বজায় রাখার চেষ্টা করেন সবসময়। এখনো তিনি গ্রামীণ বাংলার পোশাক ধুতি, পাঞ্জাবি আর চাদরে স্বাচ্ছন্দ বোধ করেন বেশি। তার স্ত্রী শুভ্রা মুখার্জি। দিল্লি রাজনীতিমহলে বৌদি বলে পরিচিত। তার বাসভবনে কেউ গেলে তাকে ভাত না খাইয়ে কাউকে আসতে দেন না। প্রণব মুখার্জির কঠোর নির্দেশ এবিষয়ে তিনি পালন করেন। আর খাওয়া মানে অবশ্যই বাড়ির কর্তার বাঙালি খাবার, অন্য কিছু একদম নয়।

কলকাতা আসলেই নিয়ম করে যান তার জন্মস্থান গ্রামের বাড়ি বীরভূমের কীর্নাহারে। বাড়ির উঠোনে বসে সকালে মুড়ি দিয়ে চা খেতে গ্রামবাসীদের সুখদুঃখের খবর নেন পল্টুদা (প্রণব মুখার্জির ডাক নাম, গ্রামে সবাই এই নামে ডাকে তাকে)। তখন তিনি জাতীয় রাজনীতি থেকে অনেক দূরে।

প্রতি বছর দুর্গাপূজায় দিল্লিতে যতই কাজ থাকুক না কেন, তিনি ফিরে আসেন তার গ্রামে। বাড়ির দুর্গাপূজায় তিনিই পুরোহিত। এই সাতদিন পূজার সব কাজ তিনি নিজ হাতে করেন। সন্ধ্যায় করেন চণ্ডি পাঠ। যা শুনতে জড়ো হন গ্রামের মানুষ। প্রতিমা বিসর্জনের পর ফিরে যান কলকাতা হয়ে দিল্লি।

১৯৬৯ সালে রাজ্যসভার সদস্য হিসেবে প্রাতিষ্ঠানিক রাজনীতিতে তার ক্যারিয়ার শুরু। তারপরেও চারবার রাজ্যসভার সদস্য হয়েছেন। মন্ত্রী হিসেবে প্রথম দায়িত্বভার পান ১৯৭৩ সালে। ইন্দিরা গান্ধীর মন্ত্রিসভায় শিল্পমন্ত্রকের উপমন্ত্রী ছিলেন তিনি। ১৯৮২ থেকে ১৯৮৪ পর্যন্ত পালন করেছেন অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব।

১৯৮৪ সালে ইন্দিরা গান্ধীর হত্যার পর মন্ত্রিসভার দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসাবে প্রণব মুখার্জি প্রধানমন্ত্রী হবেন বলে তখনই তার সমর্থকরা আশা করেছিলেন।

কিন্তু কংগ্রেস রাজনীতিতে নেহরু-গান্ধী পরিবারের একাধিপত্যের কারণেই মায়ের মৃত্যুর রাতেই প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শপথ নেন মন্ত্রী হিসাবে কোনো অভিজ্ঞতা না থাকা রাজীব গান্ধী।

কিছুদিনের মধ্যেই তার সঙ্গে মতপার্থক্যের জেরে কংগ্রেস ছেড়ে পৃথক দল গঠন করেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। তার প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রীয় সমাজবাদী কংগ্রেস অবশ্য বিশেষ সাফল্য পায়নি। পৃথক রাজনৈতিক সত্তাও বেশিদিন বজায় ছিল না তার।

রাজীব গান্ধীর সঙ্গে মতপার্থক্য মিটিয়ে কংগ্রেসে ফেরেন ১৯৮৯ সালে। পি ভি নরসিমা রাওয়ের সরকারের আমলে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হন প্রণব মুখার্জি। পেয়েছিলেন যোজনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারপারসনের দায়িত্বভার।

ভারতের লোকসভায় তিনি প্রথম নির্বাচিত হন ২০০৪ সালে, মুর্শিদাবাদের জঙ্গীপুর থেকে। এখনও তিনি সেখানকারই সাংসদ।

বিভিন্ন সময়ে প্রতিরক্ষা, অর্থ, বিদেশ,রাজস্ব, শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মতো বিভিন্ন গুরুদায়িত্ব সামলেছেন। ইন্দিরা গান্ধী থেকে শুরু করে নরসিংহ রাও হয়ে মনমোহন সিংহ সবসময় তিনি ছিলেন মন্ত্রিসভার দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। প্রধানমন্ত্রীর অনুপস্থিতিতে মন্ত্রিসভার নেতৃত্ব দিয়েছেন, কিন্তু দ্বিতীয় থেকে প্রথম আর তার হয়ে ওঠা হয়নি।

সরকারের মতো দলেও দীর্ঘদিন ধরে গুরুদায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। বিশেষ করে, গত দুই দশক ধরে জাতীয় স্তরে জোট রাজনীতির প্রেক্ষাপটে আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল তার ভূমিকা। আর এইভাবেই তিনি হয়ে ওঠেছিলেন সরকার ও কংগ্রেসের ক্রাইসিস ম্যানেজার।

তেলেঙ্গানা থেকে পাঞ্জাব সমস্যা, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় অন্তর্ভুক্তি থেকে সারা দেশে অভিন্ন পণ্য ও পরিষেবা কর চালু করাসহ নানা ক্ষেত্রে তার উপরই চূড়ান্ত ভরসা করেছে কংগ্রেস দল ও সরকার।

কিছুদিন ধরেই ঘনিষ্ঠ মহলে তিনি বলে আসছিলেন প্রতিদিনের কাজের চাপের থেকে বয়সজনিত কারণে একটু নিষ্কৃতি চান।

তার সম্পর্কে বলা হয়, প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব সামলানোর যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও সুযোগ পাননি তিনি। দেশের সর্বোচ্চ সাংবিধানিক পদের জন্য তাকে নির্বাচন করে কংগ্রেস নেতৃত্ব হয়তো তার সমর্থকদের সেই আক্ষেপ মিটিয়ে দিল।

আর অবশ্যই উপেক্ষিত বাঙালি দেরিতে হলেও ভারতের রাজনীতিতে পেল যোগ্য সম্মান।

বাংলাদেশ সময়: ০৯৩৭ ঘণ্টা, জুন ১৬, ২০১২
আরডি/সম্পাদনা: রানা রায়হান, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।