ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

দিল্লি, কলকাতা, আগরতলা

৫৫ বছর পর দুই বাংলার তিন বন্ধুকে মিলিয়ে দিল কলকাতা বইমেলা

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৩৭ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২১, ২০২৪
৫৫ বছর পর দুই বাংলার তিন বন্ধুকে মিলিয়ে দিল কলকাতা বইমেলা তিন বন্ধু: সফি, গৌতম ও দীপক

কলকাতা: গত ১৮ জানুয়ারি বইমেলার উদ্বোধন লগ্নে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, এবারে কলকাতা বইমেলা এসে মিলেছে বিশ্ব মেলায়, এ যেন এক মিলনমেলা। আক্ষরিক অর্থে যেন সেটা শনিবার (২০ জানুয়ারি) মিলে গেল।

 

দিনটিতে যখন বইমেলায় দিনভর উদযাপিত হচ্ছিল 'বাংলাদেশ দিবস', ঠিক সেই সন্ধিক্ষণে দীর্ঘ ৫৫ বছর পর কৈশোরের বন্ধুদের ফিরে পেলেন বাংলাদেশি সফিউদ্দিন আহমেদ। ফিরে পেলেন তার পশ্চিমবঙ্গের দুই বন্ধু গৌতম রায় এবং দীপক চৌধুরীকে। তাদের মিলে যাওয়ায় যেন দুই বাংলার বন্ধুত্বের সেতুবন্ধন রচিত হল ৪৭তম আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলায়।

একসময় তিনজনেরই জন্মস্থান ছিল পশ্চিমবঙ্গের মাটি। সফিউদ্দিনের জন্ম পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া জেলার মৌড়িগ্রামে। বন্ধুদের কাছে সফি নামেই পরিচিত তিনি। দীপক চৌধুরী থাকেন হাওড়ার রামরাজাতলায়। আর গৌতম রায় বর্তমানে কলকাতার টালিগঞ্জের বাসিন্দা। ১৯৬৪ সালে কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজে একসঙ্গে তাদের লেখাপড়া শুরু। সেখানেই বন্ধুত্ব, পরে আরও গাঢ় হতে থাকে বন্ধুত্বের সম্পর্ক। এরপর ১৯৬৭ পর্যন্ত ইংরেজি অনার্স। স্নাতককালে তিনজনই হয়ে ওঠেন আত্মার আত্মীয়। ১৯৬৯ সালে স্নাতকোত্তর পরীক্ষা দেওয়ার পর থেকেই কার্যত বন্ধুত্বের ছেদ পড়ে তাদের।

সফি পাড়ি দিলেন বাংলাদেশে। বাকিরা থেকে গেলেন পশ্চিমবঙ্গে। সফিউদ্দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনায় যোগ দেন। তারপর সেখানেই থেকে গিয়েছেন।  

অন্যদিকে দীপক ভারতের কেন্দ্রীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে কাজ করতেন। আর গৌতম, কলকাতার একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিন বন্ধুই এখন কর্মক্ষেত্র থেকে অবসর নিয়েছেন। তিনজনেরই বয়স ৭৫ এর কাছাকাছি। অবশেষে বেড়াজাল ভেদ করে, দীর্ঘ প্রায় ৫৫ বছর পাড়ি দিয়ে বইমেলা মিলিয়ে দিল তিন বন্ধুকে। আর তাদের মধ্যস্থতা করেছে হ্যাম রেডিও।

শনিবার (২০ জানুয়ারি) বিকেলে কলকাতা বইমেলা প্রাঙ্গণে নিজেদের মধ্যে দেখা হতেই উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়লেন তিন বন্ধু। তিন বন্ধুই উল্লাসে যেন ফিরে গেলেন কৈশোরের স্মৃতিতে। একে অপরকে জড়িয়ে ধরা, উল্লাস আর সফির কণ্ঠে শুধু একটাই শব্দ, দোস্ত তোরা কেমন আছিস। দীর্ঘদিন ধরে জমে থাকা না বলা কথার ফুলঝুড়ি ফুটতে থাকে তাদের মুখে। সেই মুহূর্তের সাক্ষী তখন কিছু গণমাধ্যমের কর্মীরাও। এ দৃশ্য তখন যেন নিঃশব্দে কানের ভেতর বাজছে, কবীর সুমনের কণ্ঠ, 'বন্ধু কি খবর বল, কতদিন দেখা হয়নি'। ততক্ষণে মাটির ভাড়ে চায়ের চুমুক দিতেও দেখা যায় তিন বন্ধুকে।

স্মৃতি স্মরণ করে সফি বলেন, আমার নানাবাড়ি (মায়ের বাড়ি) পশ্চিমবঙ্গে, আর দাদাবাড়ি (বাবার বাড়ি) বাংলাদেশে। তাই দুই বাংলার মাটিই আমার। বছরে চারবারের মত কলকাতায় আসা হয়। কিন্তু, কোনোভাবেই দেখা মেলেনি বন্ধুদের। তবে একবার উদ্যোগী হয়ে বন্ধুর খোঁজে টালিগঞ্জ পর্যন্ত চলে গিয়েছিলাম। কিন্তু খালি হাতে ফিরে আসতে হয়। আগামী ২৯ জানুয়ারি পর্যন্ত কলকাতায় থাকবেন সফি। ততদিন বন্ধুদের সঙ্গে চুটিয়ে মজা করা, খাওয়া-দাওয়া, দর্শনীয় স্থান ঘুরে দেখা হবে। এমনকি হারানো স্মৃতি রোমন্থন করতে কলকাতার কফি হাউজেও যাবেন তিনজনে।

অপরদিকে সফিকে কাছে পেয়ে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন গৌতম। তিনি বলেন, পুরোনো বন্ধুকে ফিরে পাবো আশা ছেড়েই দিয়েছিলাম। বারেবারে তাদের সঙ্গে দেখা হয় মনের মনিকোঠায়। এরপর গত ২৪ ডিসেম্বর হ্যাম রেডিও এর সঙ্গে যোগাযোগ করি। তাদের কাছে সফির ৫৫ বছর আগেকার একটি সাদাকালো ছবি ও ডিটেইলস পাঠাই। এরপর অসাধ্য সাধন হয়। বাংলাদেশ থেকে সফির একটা ছবি পাঠানো হয় এবং সেই হাসি দেখেই তাকে চিনতে কোনো অসুবিধা হয়নি। এরপর ভিডিও কলে আমি সফির নাম ধরে চিৎকার করে উঠি, সেও আমার নাম ধরে চিৎকার করে ওঠে।

সফিও মনে করেন কলকাতার দুই বন্ধুর সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়ার বিষয়ে বড় অবদান রয়েছে দুই বাংলার হ্যাম রেডিওর। একথা স্বীকার করে নিয়েছেন তিন বন্ধুই।  

প্রসঙ্গত, হ্যাম রেডিও আসলে ওয়াকিটকির মতো এক বিশেষ ওয়্যারলেস ব্যবস্থা। জরুরি ভিত্তিতে যোগাযোগের জন্য এই রেডিও কোনো বিশেষ এলাকাতেই কাজ করে। সেই রেডিওর সম্প্রচারের মাধ্যমে খুঁজে দেয় একে অপরকে। এক কথায় হারিয়ে যাওয়া মানুষ মিলিয়ে দেয় এই হ্যাম রেডিও। বাংলাদেশে এর দায়িত্বে আছেন ৭১ টিভির চিফ ক্যামেরা পারসন শামসুল হুদা। কলকাতার দায়িত্বে আছেন অম্বরিশ নাগ বিশ্বাস।

অম্বরিশ জানান, গৌতম রায় আমায় ফোন করেন। বললেন তার বন্ধু সফিকে ফিরে পেতে পয়সা খরচ করতেও রাজি। এরপর বন্ধুকে খুঁজে পেতে বাংলাদেশে যোগাযোগ করি। এরপরে সফল হই। ঠিক হয় বইমেলাতেই তাদের দেখা করানোর। ৫৫ বছর পর বন্ধুদের মিলিয়ে দিতে পেরে আমরাও খুশি।  

শামসুল জানান, আমি যখন জানতে পারলাম যে তিন বন্ধু বইমেলাতে মিলিত হচ্ছেন, তখন আমিও ঠিক করলাম ওই সন্ধিক্ষণে আমিও থাকবো। আর তাই কলকাতায় চলে আসা। শামসুল এও জানান যে, গৌতম রায় মোবাইলে লিখেছিলেন, জীবনের শেষ বেলায় আমি আমার বন্ধুকে দেখতে চাই। ওই টেক্সট পাওয়ার তিন ঘণ্টার মধ্যে আমি তার বন্ধু সফিউদ্দিনকে খুঁজে বের করি।

মূলত, কলকাতা বইমেলা শুধু বইপ্রেমীদের আড্ডা নয়। এক মিলনমেলা। এ মেলা যেমন লেখক পাঠকের মনের আদান প্রদানে এক মিলের সাক্ষী থাকে, তেমন কত শত প্রেম তৈরি করে এই মেলার আড্ডায়। জন্ম দেয় কত নতুন বন্ধুত্বের। কত কিছু মিলে যায় এই মিলনমেলায়। তেমনি যেন মিলে গেলেন সফি-গৌতমরা। যে সম্পর্ক রক্তের চেয়েও বেশি। তাই যেন আবারও জানান দিল শনিবারে বইমেলায়।

বাংলাদেশ সময়: ১০৩০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২১, ২০২৪
ভিএস/আরএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।