শিলিগুড়ি: পশ্চিমবঙ্গের উত্তরের জেলাগুলোতে সোমবার বন্যা পরিস্থিতি খতিয়ে দেখলেন সেচমন্ত্রী মানস ভুঁইঞা।
শিলিগুড়ি শহরের চম্পাসারির মিলনমোড় এলাকায় মহানন্দা নদীর বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয়েছে বিস্তীর্ণ এলাকা।
মানস ভূঁইঞা বাঁধের পরিস্থিতি খতিয়ে দেখেছেন। এরপর পূর্ব ও পশ্চিম ধানতলা এলাকাতাতেও যান তিনি।
মহানন্দা নদীর বাঁধ ভেঙে শিলিগুড়ি পুরসভার বেশ কয়েকটি ওয়ার্ড জলমগ্ন হয়ে পড়েছে। জলের তোড়ে পলাশগ্রামে পাকা সেতু ভেঙে পড়েছে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় শিলিগুড়ির পুরনিগমের তরফে কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে।
মিলন মোড়, দেবীডাঙার বানভাসি মানুষের জন্য স্থানীয় স্কুলে ত্রাণশিবির খোলা হয়েছে। প্রবল বৃষ্টিতে পানি বেড়েছে মহানন্দা, বালাসন, তোর্সা, তিস্তা নদীতে।
তোর্সা ও তিস্তায় লাল সতর্কতা জারি করা হয়েছে। জলঢাকা, রায়ঢাক, সঙ্কোশ নদীতে জারি রয়েছে হলুদ সংকেত।
অন্যদিকে, ভূটান পাহাড়ে অবিরাম বৃষ্টির কারণে জলপাইগুড়ির ধূপগুড়ি ব্লকের বন্যা পরিস্থিতিও আশঙ্কাজনক। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত বানারহাটের মরাঘাট, হাতিনালা এলাকা। জেলার ছ’টি স্থানে ত্রাণশিবির খুলেছে প্রশাসন। তাতে আশ্রয় নিয়েছে প্রায় দুই হাজার মানুষ।
কুচি ডায়না নদীর জলোচ্ছ্বাসে নাগরাকাটা ব্লকের খেরকেটা বস্তির সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষাকারী সেতু বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। জেলার নদীর তীরবর্তী এবং নীচু এলাকার বাসিন্দাদের সরে যেতে বলেছে প্রশাসন। জেলার তিস্তা, তোর্সা, রায়ডাক-১, রায়ডাক-২, কালজানি, জলঢাকা, চেল, মিস, লিস, ডায়না, কুঁজি ডায়না, রেতি, সুকৃতি, হাতিশালাসহ সবক’টি নদীতেই প্রবল জলস্ফীতি ঘটেছে।
এদিকে, কোচবিহার জেলার তিস্তাতে লান ও মানসাই নদীতে হলুদ সঙ্কেত দেওয়া হয়েছে। জলবন্দি হয়ে পড়েছে তিস্তাপাড়ের প্রায় ২৫ হাজার মানুষ। শনিবার রাত থেকেই জেলার নদীগুলির জল বাড়তে শুরু করেছে।
ভূটান পাহাড় থেকে নেমে আসা ডুয়ার্সের নদী এবং ঝোরাগুলির জল বিপদসীমার ওপর দিয়ে বয়ে চলেছে। সিকিম, গ্যাঙটক, সেবক পাহাড়ী এলাকাতেও ভারী বৃষ্টির ফলে তিস্তা, জলঢাকা নদীতে প্রবল জলস্ফীতি দেখা দিয়েছে।
তিস্তা-মহানন্দা লিঙ্ক ক্যানেল দিয়ে ৩ তিন হাজার ৩শ’ কিউসেক জল পাঠানোয় তিস্তা রীতিমতো ফুলে-ফেঁপে উঠেছে।
এছাড়াও ধরলা ও চেল নদীর জলও তিস্তায় এসে পড়ায় নদীর জল রোববার সকাল থেকে বিপদসীমার ওপর দিয়ে বইছে। বানারহাটে রেল লাইনের ওপর দিয়ে জল বইছে।
রোববার দুপুরে সেচ দপ্তর তিস্তা নদীর সংরক্ষিত অঞ্চলের দোমহনী থেকে বাংলাদেশ সীমান্ত পর্যন্ত এলাকায় লাল সঙ্কেত জারি করেছে। সেবক করোনেশন এলাকাতে তিস্তায় হলুদ সঙ্কেত দেওয়া হয়েছে। নদীপাড়ে বসবাসকারী মানুষদের নিরাপদ স্থানে চলে যাবার নির্দেশও জারি করা হয়েছে। জেলা প্রশাসন বন্যার সতর্কতা জারি করেছে। ৩১নং জাতীয় সড়ক থেকে মাথাভাঙা পর্যন্ত এলাকায় জলঢাকা নদীতেও সেচ দপ্তর এদিন হলুদ সঙ্কেত জারি করে।
জেলার ১৩টি ব্লকের মধ্যে জলপাইগুড়ি সদর ব্লক, রাজগঞ্জ, ময়নাগুড়ি, ধূপগুড়ি, মালবাজার, নাগরাকাটা ব্লকের বিস্তীর্ণ এলাকা জলমগ্ন হয়ে পড়েছে। প্রায় ১৫ হাজার মানুষ জলবন্দি হয়ে পড়েছেন। জলপাইগুড়ি সদর ব্লকের বারোপেটিয়া, মণ্ডলঘাট, খড়িয়া, গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার বেশ কয়েকটি গ্রাম জলবন্দি হয়ে পড়েছে।
ময়নাগুড়ি ব্লকের ধর্মপুর, বাকালী, পদঘতী ১/২ গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকাতেও তিস্তার জল ঢুকে পড়েছে। রাজগঞ্জ ব্লকের টাকিমারি, মিলনপল্লী, বীরেনবস্তি, ধূপগুড়ি বস্তি, পূর্ব মিলনপল্লী, ফুলবাড়ি গ্রামপঞ্চায়েতসহ বিস্তীর্ণ এলাকায় তিস্তা নদীর জল ঢুকে পরে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
রাজগঞ্জের টাকিমারির বীরেনবস্তির তিনটি বাড়ি তিস্তা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। ধূপগুড়ি ব্লকের বানারহাট, গধেয়ার কুঠি, মাগুরমারি, কাঁঠালগুড়ি চা বাগান, চামুটি চা বাগান, চামুটি বস্তিসহ বেশ কিছু অঞ্চলে শনিবার রাত থেকেই জলঢাকা, রেডি, ডায়না, কুঁজি ডায়না, হাতিনালার জল ঢুকে পড়ায় বন্যাপরিস্থিতি দেখা দিয়েছে।
রোববার দুপুরে কাঁঠালগুড়ি চা বাগানের কাছে রেতীনদীর বাঁধের প্রায় ১৫০ মিটার অংশে ফাটল ধরায় পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। বানারহাটের সুভাষনগর এলাকায় হাতিনালার ধবি প্রায় ৫০ মিটার ভেঙে যাওয়ায় হুহু করে জল ঢুকছে সেখানে। বানারহাট প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে জল ঢুকে পড়েছে। রেললাইনের ওপর দিয়েও জল যাচ্ছে।
বানারহাট ১নং গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধান সুরজ দালাল ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলি পরিদর্শন করে জেলা প্রশাসনের কাছে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করার আবেদন জানিয়েছেন।
নাগরাকাটা ব্লকের খয়েরকাঠা, ঝাড়ুতুণ্ডু, বামনডাঙ্গা, শুখাপাড়াসহ বেশ কয়েকটি গ্রামে ডায়না এবং কুঁজি ডায়নার জল ঢুকে পড়েছে। খয়েরকাটা এলাকায় ডায়না নদীর কাঠের সেতুটি প্রবল জলের স্রোতে ভেঙে পড়ায় এই এলাকার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না।
মালবাজার ব্লকের বাগরাকোট, তুরীবাড়ি, তেসিমনা, কুমলাই এলাকার গ্রামগুলিতেও চেল নদীর জল ঢুকে পড়ায় বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
জেলার ক্ষতিগ্রস্ত ব্লকগুলিতে এখনও সেভাবে ত্রাণ ও উদ্ধার কার্যে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তেমন উদ্যোগ নজরে না পড়ায় বানভাসি মানুষেরা ক্ষোভে ফেটে পড়েছেন।
তিস্তা, জলঢাকাসহ জেলার গুরুত্বপূর্ণ নদীবাঁধগুলোর অবস্থাও বেহাল হয়ে পড়েছে। নদীপাড়ে বসবাসকারী গরিব কৃষক, মৎস্যজীবীদের কৃষি জমি ও বসত ভিটা নদীগর্ভে তলিয়ে গেলেও জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সহায়সম্বলহীন পরিবারগুলোর সাহায্যে কোনো উদ্যোগ নজরে পড়েনি।
এদিন সকাল পর্যন্ত সেবকে ২৩৬.০ মিলিমিটার, গাজলডোবায় ২৮৮.০ মিলিমিটার, প্যাওড়ায় ১৫৩.৬ মি.মি., মূর্তিতে ১৯১.৯ মি.মি., হাসিমারায় ১৫৪.০ মি.মি., বাগ্রাকোটে ১৭৬.৪ মি.মি., কুমারগ্রামে ৮৯.০ মি.মি., বানারহাট ২২০.০ মি.মি., মালবাজারে ১৪৭.৮ মি.মি., গ্যাঙটকে ৬৪.৭ মি.মি., পেজয়ে ১৩০.০ মি.মি., চৈতংয়ে ৫৪.০ মি.মি., চম্পাসারিতে ১৯১.২ মি.মি. এবং শিলিগুড়িতে ১৪৪.৮ মি.মি. বৃষ্টি হয়েছে।
আগামী ২৪ ঘণ্টায় সিকিমসহ বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে ভারী থেকে অতিভারী বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে বলে জলপাইগুড়ি কেন্দ্রীয় আবহাওয়া দপ্তর সূত্রে জানা গেছে।
মালবাজার ব্লকের চাপাডাঙা গ্রাম পঞ্চায়েতের পশ্চিম সাঙ্গোপাড়া ও প্রেমগঞ্জ এলাকায় তিস্তা নদীর বাঁধ ভেঙে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। জলমগ্ন হয়ে পড়েছে টাকিমারি এলাকাও। যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।
খবর পেয়েই দুর্গত এলাকায় পৌঁছে যান পঞ্চায়েত সমিতির ত্রাণ কর্মাধ্যক্ষ মেনকা রায়, পূর্ত কর্মাধ্যক্ষ মিন্টু রায়, গ্রামপ্রধান লজেন রায়। পরে বি ডি ও প্রেম বিভাস কাঁসারি জলমগ্ন এলাকায় যান।
এদিকে তিস্তা ব্যারেজে নির্ধারিত মাত্রায় জলস্তর ওঠায়, ব্যারেজ থেকে কিছু জল ছাড়া হয়। এই জল ছাড়ার ফলে টাকিমারি ও সংলগ্ন নিচু এলাকা জলমগ্ন হয়ে পড়ে।
অবিশ্রান্ত বৃষ্টির দরুণ মুচি ও ডায়না নদীতে জল বেড়েছে। জলের তোড়ে আঙরাভাষা ২নং গ্রাম পঞ্চায়েতের খেরবাড়ি অঞ্চলে যাবার রাস্তায় খইলাডোবা কাঠের সেতুটি ভেঙে পড়েছে। খেরবাড়ি গ্রামে প্রায় ৩শ’ বাড়ি জলমগ্ন হয়ে পড়েছে। অসহায় হয়ে পড়েছে স্থানীয় মানুষ।
কিন্তু জেলা প্রশাসনের তরফ থেকে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের সাহায্য করার কোন উদ্যোগ নেই। ফলে প্রশাসনের বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফেটে পড়েছেন মানুষ। ২ কিলোমিটার রাস্তা নদীর জলের স্রোত উড়ে গেছে।
ক্ষুব্ধ মানুষের অভিযোগ, বর্ষার মুখে সেতুটির দেখভাল করা হয়নি। প্রশাসন সেতুটির বিষয়ে উদাসীন ছিল। এলাকার মানুষের ক্ষোভের আঁচ পেয়ে পরে মালবাজারের মহকুমা শাসক দেবযানী ভট্টাচার্য ঘটনাস্থলে যান।
জলঢাকা নদীতে লাল সঙ্কেত দেওয়া হয়েছে। রোববার বিকেলে মাগুরমারি ২নং গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় জলঢাকা বাজারের আশপাশ অঞ্চল দিয়ে নদীর পাড় ভাঙছে। এর ফলে মানুষের মধ্যে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে। বহু বাড়ি জলমগ্ন হয়ে পড়েছে। ধান ও পাটের খেত জলের তলায়। ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
এখানেও ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের ত্রাণ দেওয়ার বিষয়ে জেলা প্রশাসন উদাসীন। জলঢাকা ছাড়াও ডুডুয়া, গিলাণ্ডি, বামনি ও কুমলাই নদীর জল বেড়েছে। ভুটান পাহাড়ে প্রবল বৃষ্টির দরুণ এই সব এলাকার নদীগুলোতে জল বেড়েছে।
এদিকে, ডায়না নদীর পানিতে এদিন একটি বার্কিং ডিয়ার (হরিণ) ভেসে আসে। স্থানীয় মানুষজন হরিণটিকে উদ্ধার করে বনদপ্তরের হাতে তুলে দেয়। বনকর্মীরা হরিণটিকে চিকিৎসার জন্য নাটাগুড়িতে পাঠিয়ে দেয়।
কোচবিহার জেলায় তিস্তা নদীতে লাল ও মানসাই নদীতে হলুদ সঙ্কেত দেওয়া হয়েছে। নিচু এলাকা থেকে মানুষজনকে সরে যেতে বলা হয়েছে। বিএসএফ-কে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে।
তিস্তা পাড়ের প্রায় ২৫ হাজার মানুষ জলবন্দি হয়ে রয়েছে। ছোট ছোট নৌকায় করে দুর্গত মানুষদের বাঁধের উপর নিয়ে আসা হচ্ছে। ময়নাগুড়ি থেকে সেটি ঠিকমতো চলছে না বলে মানুষের অভিযোগ। অন্ধকার নেমে আসাতে উদ্ধার কাজে বিঘ্ন ঘটছে। গ্রাম পঞ্চায়েত থেকে শুকনো খাবার দেওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে।
এদিকে পিঠারবাড়ি থেকে মেখলিগঞ্জের বাংলাদেশ সীমান্ত পর্যন্ত ১২৮ বর্গকিলোমিটার এলাকার ২৮টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। প্লাবিত এলাকার মধ্যে লক্ষ্মীরচর, সম্যাসীর জোত, মতিয়ারের চর প্রভৃতি এলাকা রয়েছে।
এদিন কোচবিহারের জেলাশাসক মোহন গান্ধী ও অতিরিক্ত জেলাশাসক সুদীপ্ত মিত্র এলাকা পরিদর্শন করেন।
বাংলাদেশ সময়: ০১১২ ঘণ্টা, জুলাই ১৭, ২০১২
আরডি/সম্পাদনা: জাহাঙ্গীর আলম, নিউজরুম এডিটর