ঢাকা, বুধবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

দিল্লি, কলকাতা, আগরতলা

জন্মদিনে কমরেড মুজাফ্ফর আহমেদকে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন সিপিএমের

কলকাতা ব্যুরো | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২১৭ ঘণ্টা, আগস্ট ৫, ২০১২
জন্মদিনে কমরেড মুজাফ্ফর আহমেদকে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন সিপিএমের

কলকাতা: গভীর শ্রদ্ধায়, স্মরণে রোববার পালন করা হল উপমহাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃত্‍ মুজাফ্ফর আহমেদের ১২৪তম জন্মদিন। কলকাতার আলিমুদ্দিনে সিপিআইএমের রাজ্য সদর দফতরে তাঁর প্রতিকৃতিতে মালা দিয়ে শ্রদ্ধা জানান দলের রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু সহ শীর্ষস্থানীয় নেতানেত্রীরা।



দলে ‘কাকাবাবু’ নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন মুজাফ্ফর আহমেদ। আলিমুদ্দিনের পাশাপাশি দৈনিক গণশক্তির কার্যালয়েও তার জন্মদিবস পালন করা হয়। তাঁর ছবিতে মালা দিয়ে শ্রদ্ধা জানান দলের শীর্ষ নেতৃত্ব।

তাঁর জন্মদিন উপলক্ষে গণশক্তি ভবনে মুজাফ্ফর আহমেদ পাঠাগারে পি সুন্দরাইয়ার জীবনের বিভিন্ন মুহূর্ত নিয়ে একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। প্রদর্শনীটির উদ্বোধন করেন বিমান বসু।

বিকেলে মহাজাতি সদনেও একটি সভার আয়োজন করা হয়। সেখানে বক্তব্য রাখেন বিমান বসু, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। উপস্থিত ছিলেন দলের প্রথম সারির নেতানেত্রীরা।     

মুজফ্‌ফর আহমদ ১৮৮৯ সালের ৫ আগস্ট বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে অবস্থিত সন্দ্বীপের মুসাপুর গ্রামে এক দরিদ্র অথচ অভিজাত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম মনসুর আলি এবং মা`র নাম চুনাবিবি। চুনাবিবি তার বাবার দ্বিতীয় স্ত্রী ছিলেন।

মনসুর আলি সন্দ্বীপের এক স্বল্প আয়ের মোক্তার ছিলেন। তার দাদা আর নানার নাম ছিল যথাক্রমে মুহম্মদ কায়েম ও রেশাদ আলী ঠাকুর। পরিবারের আর্থিক অবস্থা ভাল না থাকায় কৈশোরে মুজফফর আহমদকে চাষাবাদের কাজেও সাহায্য করতে হয়েছিল।

বহির্মুখি স্বভাবের মুজফ্‌রর আহমদকে গৃহমুখী করার উদ্দেশ্যে পারিবারিক চাপে ১৯০৭ সালে বিয়ে দেওয়া হয়। তাঁর স্ত্রীর নাম হাফেজা খাতুন। নিয়মিত সাংসারিক জীবন তিনি পালন করেননি। ১৯৩৫ সালে বৃটিশ সরকারের নজরবন্দি থাকার সময় ১৪ বছর পর পরিবারের সাথে দেখা হয়। এসময় তিনি সন্দ্বীপে তার একমাত্র কন্যা আফিকা খাতুনের বিয়ে দেন কবি আবদুল কাদিরের সঙ্গে।

১৮৯৭ সালে তিনি গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ১৮৯৯ সালে তিনি হরিশপুর মিডল ইংলিশ স্কুলে (পরে কাগিল হাইস্কুল) ভর্তি হন। পিতার মোক্তারি ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর বেতন দিতে না পারায় স্কুল থেকে তার নাম কেটে দেওয়া হয়।

সেসময় মাদ্রাসা শিক্ষা অবৈতনিক হওয়ায় তিনি মাদ্রাসায় লেখাপড়া শুরু করেন। ১৯০৫ সালে পিতার মৃত্যুর সময় তিনি নোয়াখালীর বামনী মাদ্রাসায় পড়ছিলেন। পিতার মৃত্যুর পর মুজাফ্‌ফর আহমদ কিছুকাল বরিশালে গৃহশিক্ষকতা করেন। এরপর তিনি আবার নিজ গ্রামে ফিরে স্কুলে ভর্তি হন।

১৯১০ সালে তিনি নোয়াখালী জেলা স্কুলে চলে যান। ১৯১৩ সালে সেখান থেকে মেট্রিকুলেশন পাশ করেন। ১৯১৩ সালে তিনি পশ্চিমবঙ্গের হুগলি কলেজে ভর্তি হন, কিন্তু সেখানে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হওয়ায় তিনি সে বৎসরই চলে যান বঙ্গবাসী কলেজে। এ কলেজ থেকে আই এ পরীক্ষা দিয়ে অকৃতকার্য হন এবং সেখানেই তার লেখাপড়ার ইতি ঘটে।

১৯১৩ থেকেই তিনি কলকাতার অধিবাসী। সন্দ্বীপের কাগিল হাইস্কুলে পড়ার সময়ই মুজফ্‌ফর আহমদের সাংবাদিকতায় হাতে খড়ি হয়। মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামবাদী সম্পাদিত `সাপ্তাহিক সুলতান` পত্রিকায় সন্দীপের স্থানীয় খবর পাঠাতেন। ১৯১১ সালে কলকাতায় অবস্থানরত বিভিন্ন মুসলিম ছাত্রের উদ্যোগে বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতি গঠিত হয়। কলকাতার ৩২ কলেজ স্ট্রিটে এ সাহিত্য সমিতির অফিস ছিল।

১৯১৮ সালে সমিতির উদ্যোগে বের হয় "বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য পত্রিকা"। ১৯১৮ সালে সমিতির সব সময়ের কর্মী হিসেবে তিনি এর অফিসেই থাকা শুরু করেন। তিনি ছিলেন সমিতির সহকারী সম্পাদক। পত্রিকার কাজ পরিচালনার সময় চিঠিপত্রের মাধ্যমে কবি কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে তার পরিচয় হয়।

১৯২০ সালের শুরুর দিকে ৪৯ নম্বর বেঙ্গল রেজিমেন্ট ভেঙ্গে দেওয়া হলে নজরুলের সৈনিক জীবনের অবসান ঘটে এবং তিনি কলকাতায় মুজফ্‌ফর আহমদের সঙ্গে সাহিত্য সমিতির অফিসে থাকতে শুরু করলেন।

সক্রিয় রাজনীতিতে যোগদানের আগে মুজফ্‌ফর আহমদ কিছুদিন চাকরিতে নিয়োজিত ছিলেন। বাংলা সরকারের ছাপাখানায় মাসিক ত্রিশটাকা বেতনে তিনি চাকরি করেছিলেন। বাংলা সরকারের অনুবাদ বিভাগেও তিনি মাসিক পঞ্চাশ টাকা বেতনে একমাস উর্দু থেকে বাংলায় অনুবাদ করার চাকরি করেন।

একমাস তিনি প্রেসিডেন্সি বিভাগের স্কুলসমূহের ইনস্পেক্টর হিসেবেও কাজ করেন। কলেজে পড়ার সময় খিদিরপুর জুনিয়র মাদ্রাসায় তিনি শিক্ষকতা করেন আর একমাস ছুটিতে তিনি কলকাতা সিটি কর্পোরেশনেও কাজ করেন। ১৯০৬ সাল থেকে ১৯০৮ সালের অধিকাংশ সময় তিনি কোনো না কোনো লোকের বাড়িতে গৃহশিক্ষকতা করে থাকা-খাওয়া অথবা অর্থ রোজগার করতেন।

কৈশোরে সক্রিয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ না করলেও ১৯১৬ সাল থেকে মুজফ্‌ফর আহমদ বন্ধুদের সঙ্গে বিভিন্ন রাজনৈতিক আলোচনা, সভা-সেমিনার-মিছিলে যোগদান করে রাজনৈতিকভাবে সচেতন হয়ে ওঠেন। ১৯১৯ সালে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে কলকাতায় অনুষ্ঠিত আন্দোলনে তিনি অংশগ্রহণ করেন।

১৯২০ সালে বঙ্গীয় খেলাফত কমিটির সদস্য মনোনিত হলেও তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। ১৯২০ সালের শুরুতে তিনি সিদ্ধান্ত নেন যে রাজনীতিই হবে তার জীবনের মূল পেশা। তিনি কাজী নজরুলের সাথে ঠিক করেন একটি ভিন্ন ধর্মী বাংলা দৈনিক বের করার। এ বিষয়ে তারা ফজলুল হক সাহেবের (শেরে বাংলা) সাথে দেখা করেন। হক সাহেব তার নিজের টাকায় পত্রিকা বের করার প্রস্তাব করেন।

১৯২০ সালের ১২ জুলাই মুজফ্‌ফর আহমদ ও কাজী নজুরল ইসলামের যুগ্ম সম্পাদনায় "নবযুগ" নামক সান্ধ্য পত্রিকা বের হয়।

মুজফ্‌ফর আহমদের ছাত্রাবস্থায় বাংলায় সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের শুরু হয়। এ সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন শুধু হিন্দু আন্দোলন ছিল না, আসলে তা ছিল বর্ণ হিন্দুদের আন্দোলন। তার মতে, একধরনের রোমাঞ্চের জন্য শিক্ষিত যুবকেরা এতে অংশ নিলেও এর পিছনে ছিল একটা গভীর নৈরাশ্য। যদিও তিনি এই আন্দোলনের জন্য জীবন উৎসর্গকারীদের শ্রদ্ধা করতেন।

অন্যদিকে মুসলীম লীগ ও কংগ্রেসকে তিনি ধনীক শ্রেণীর স্বার্থে ধনীক শ্রেণীর রাজনৈতিক দল বলে মনে করতেন। কংগ্রেসের ঘোষণাপত্রে ধর্ম নিরপেক্ষতার কথা বলা থাকলেও এ দল ধীরে ধীরে হিন্দু জাতীয়তাবাদের বিশ্বাসী নেতাদের কর্তৃত্বাধীন হয়ে পড়ে।

মুসলিম লীগের অনেকেই ব্যক্তিগতভাবে অসাম্প্রদায়িক হলেও ধর্মকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করতেন। মূলতঃ ভারতীয় উপ-মহাদেশের রাজনীতিতে হিন্দু সুবিধাভোগী শ্রেণীর একাধিপত্যকে রোধ করার জন্যই মুসলিম সুবিধাভোগী ও ভোগেচ্ছুদের রাজনৈতিক দল মুসলিম লীগের জন্ম হয়।

তার পিতার পেশা মোক্তারি হলেও তার পরিবার ছিল মূলতঃ কৃষক পরিবার। তাছাড়া তাদের গ্রামের অর্থনীতিও ছিল কৃষিভিত্তিক। কলকাতা জীবনের শুরু থেকেই নাবিকদের সাথে তার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের কারণে শ্রমিক শ্রেণীর দুঃখ-দুর্দশার সঙ্গে তিনি পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন। সেসময় সন্দ্বীপের অনেক লোক কলকাতা বন্দরে কাজ করতেন।

আধুনিক শিক্ষা, সাহিত্য ও সাংবাদিকার আকর্ষণ এবং বুদ্ধিজীবিদের সাহচার্য লাভ কাতে ধর্মনিরপেক্ষতা ও কৃষক-শ্রমিক শ্রেণীর মুক্তির রাজনীতিতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন তিনি। ১৯১৭ সালে রুশ বিপ্লবের সাফল্য তাকে উদ্দীপ্ত করে। ১৯২১ সাল থেকে তিনি মার্কসবাদ চর্চা ও মার্কসবাদী রাজনীতিতে আত্মনিয়োগ করেন।

১৯৭৩ সালের ১৮ ডিসেম্বর কলকাতায় প্রয়াত হন তিনি।

বাংলাদেশ সময়: ১৬৩৯ ঘণ্টা, ০৫ আগস্ট, ২০১২
আরডি/সম্পাদনা: আহ্‌সান কবীর, আউটপুট এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।