ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

দিল্লি, কলকাতা, আগরতলা

বাংলানিউজের প্রতিনিধির চোখে সমুদ্র সুন্দরী দিঘা

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৩৩১ ঘণ্টা, মার্চ ২, ২০১৪
বাংলানিউজের প্রতিনিধির চোখে সমুদ্র সুন্দরী দিঘা ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

কলাকাতা: কলকাতায় বিশেষ কাজে হাজির বাংলানিউজের কয়েকজন প্রতিনিধি। ফিরে যাবার আগে হাতে সামান্য কিছুটা সময়।

আর সেই সামান্য সময়কে কাজে লাগিয়ে পরিকল্পনা দিঘা সফরের। গত সেপ্টেম্বর মাসে বাংলানিউজে কলকাতার কলমে প্রকাশিত হয় সমুদ্র সুন্দরী দিঘার উপর একটি ফিচার। আর তাই ফিরে যাওয়ার আগে একবার দীঘা ঘোরার পরিকল্পনা।   গাইডের ভুমিকায় কলকাতা প্রতিনিধি। বাংলানিউজ পরিবারের এই সদস্যদের দিঘা নিয়ে একটা আগ্রহ ছিলই। কিন্তু হাতে সময় খুব কম তাই ব্যস্ততাকে পাশ কাটিয়ে একটু  সময় বের করে একদিনের ঝটিকা সফরে হাজির দিঘায়।

বঙ্গোপসাগরের বুকে টুকরো টুকরো বেশ কয়েকটি উপকূল নিয়ে তৈরি এই অঞ্চল। এর মধ্যে দিঘার সমুদ্র সৈকত সব থেকে উল্লেখযোগ্য। কলকাতা থেকে ১৮৭ কিলোমিটার সড়ক পথে যাত্রা করে পৌঁছা যায় দিঘায়। কলকাতা থেকে আছে ট্রেনও।

যাত্রা পথের আড্ডায় বার বার উঠে আসছিল ভারতের অন্যান্য সমুদ্র সৈকত গুলির কথা, উঠে আসছিল কক্সবাজারের প্রসঙ্গও।

দিঘায় আছে দুটি সৈকত একটি পুরাণ দিঘা অপরটি নতুন দিঘা। এছাড়াও এখানে আছে  “দ্যা মেরিন অ্যাকুরিয়াম অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টার”। সমুদ্রে তলার গোটা জগৎ নিয়ে তৈরি এই মেরিন অ্যাকুরিয়াম। ভারতের সমুদ্র গবেষণার অন্যতম প্রধান কেন্দ্র। আছে অমরাবতী লেক ও পার্ক, ঐতিহাসিক চন্দনেশ্বর মন্দির।

পর্যটকদের নিরাপত্তার জন্য দিঘার সৈকতে সব সময় নজর দারি করে ১০০ জন সাদা পোশাকের পুলিশ। মহিলা পযর্টকরা জলপরীদের মত নিশ্চিন্তে জলে বিচরণ করতে পারে তার জন্য আছে বিশেষ নিরাপত্তার ব্যবস্থা। রাত ১১টার পরে সৈকতে কোনো ব্যক্তির থাকার অধিকার নেই। সৈকতে যে কোনো ধরনের নেশার দ্রব্য নিষিদ্ধ।

আছে পুলিশের স্পিড বোট। স্পিড বোটের কাজ পানিতে নজর দারি এবং পযর্টকদের উদ্ধারের প্রয়োজনে ব্যবহার করা হয়। পরিবেশ সচেতনতার জন্য চলে ব্যাপক সরকারি প্রচার।  

দিঘার সমুদ্র সৈকতে দাঁড়িয়ে সেই দিনের আলোচনায় উঠে এসেছিল পৃথিবীর বিখ্যাত বিভিন্ন সমুদ্র সৈকত গুলির কথা। এই বিষয়ে বলে রাখা ভাল দৈর্ঘ্য, সৌর্ন্দয, পযর্টকের আগমন ইত্যাদির বিচারে ভারতের প্রথম ৫০টি সমুদ্র সৈকতের মধ্যে দীঘা পড়ে না।

ভারতের প্রথম সারির সমুদ্র সৈকত গুলির মধ্যে অন্যতম গোয়া, লাক্ষাদ্বীপ, আন্দামান, দমন, পন্ডিচারী, কোভালাম,চেন্নাই, ম্যঙ্গালোর, টারকারলি, কোচি ইত্যাদি।   

তবে এই পরিসংখ্যান পশ্চিমবঙ্গের বাঙালির সপ্তাহ শেষের ছুটিতে দিঘার আকষর্ণ কমাতে পারেনি। বরং দিঘার সৈকতের তীরে আছড়ে পড়া ঢেউ, ভোরের সূযোর্দয় আর সন্ধ্যার সূযার্স্ত যেন দিঘা নিজেই নিজের একমাত্র উপমা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ভোরের দিঘায় সমুদ্র সৈকত ধরে হাটতে থাকলে আপনার পা ছুঁয়ে যাবে ঢেউ ভাঙা জল আর চোখে পড়বে পায়ে হেটে চলা ছোট ছোট শামুক, শঙ্খ সহ নানাধরনের সামুদ্রিক প্রাণী। দিঘার আশেপাশে যে বিভিন্ন সৈকত ঘিরে রেখেছে দিঘাকে সেগুলিতেও বাঙালির উৎসাহ বাড়ছে।

শঙ্করপুর সৈকত
দিঘা থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে এই সৈকত। সমুদ্র যদি গভীরতার প্রতীক হয় তবে শঙ্করপুর সেই সেই গভীরতার সঙ্গে যুক্ত করেছে আত্মমগ্নতাকে। যে মগ্নতা সাহায্য করে সমুদ্রের বালিয়াড়িতে দীর্ঘ সময় একা হাঁটতে হাঁটতে নিজের মধ্যে নিজেকে খুঁজে পাওয়ার। এখানে তৈরি হয়েছে বেশ কিছু রিসোর্ট। দিঘার থেকে কিছুটা কম পযর্টকের আনাগোনা হয় এখানে। কিছুটা সময় যদি একান্তে নিজের সঙ্গে কাটাতে চান তবে শঙ্করপুর আপনাকে সেই সুযোগ করে দেবে। একদিকে দিগন্ত জোড়া জল আর নির্জন বালিয়াড়ি অন্যদিকে আধুনিক সমস্ত রকমের সুবিধা নিয়ে অতিথিদের সেবায় নিয়োজিত বিলাস বহুল রিসোর্ট, যা পযর্টকদের প্রতিটি সুযোগ সুবিধার নজর রাখে। শঙ্করপুরে আছে মাছ ধরার জন্য তৈরি হওয়া বিশেষ প্রকল্প যা না দেখলে শঙ্করপুর আসার উদ্দেশ্য পূর্ণ হবে না।

জুনপুট সৈকত
দিঘার থেকে মাত্র ৪০ কিলোমিটার দূরে জুনপুট সমুদ্র সৈকত। প্রকৃতি প্রতিদিন এক অদ্ভুত খেলা করে এই সৈকতে। প্রকৃতির এই খেলার দিকে নজর রাখলে মনে হয় যেন ঠিক যেন মানব জীবনে সুখ দুঃখের আনাগোনা। এই সৈকতের সব থকে বড় বৈশিষ্ট্য  হোল একমাত্র ভাটার সময়ই এই সৈকত সমুদ্রের বুকে ভেসে ওঠে। জোয়ার চলে গেলে ধীরে ধীরে সমুদ্রের বুকে ফুটে ওঠে এই সৈকত আবার জোয়ার আসলে জলের গভীরে মিলিয়ে যায় জুনপুট সমুদ্র সৈকত।

পযর্টকের ভিড় এড়িয়ে যদি সমুদ্রের অজানা একটি চেহারা দেখতে চান তবে জুনপুট সমুদ্র সৈকত আপনাকে সেই সুযোগ করে দেবে। ভারতের সমুদ্র গবেষণার এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান এই জুনপুট সৈকত। এই সৈকতে সমুদের মাছ, সমুদ্রের তলার প্রাণী জগৎ নিয়ে গবেষণা চালাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা। হাঙরের তেল নিয়ে গবেষণার বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য কাজ হয় এই গবেষণাগারে।

মন্দারমুনি সৈকত
দিঘার কাছেই ১৩ কিলোমিটার লম্বা এই সমুদ্র সৈকত। এখানে আছে অনেক গুলি আধুনিক রিসোর্ট।   মাথা উঁচু করে থাকা ঝাউয়ের অগভীর জঙ্গল আর তার ফাঁক দিয়ে দেখা জায় সমুদ্রের ঢেউ। সেই ঝাউবন পেরিয়ে চোখ মেলে তাকালে দেখা যাবে সমুদ্রের বুকে ভাসতে থাকা সারিবদ্ধ ছোট ছোট মাছ ধরার নৌকা। দিঘা থেকে মাত্র ১৫ কিলোমিটার দূরে এই সমুদ্রে তট বাঙালির  সপ্তাহ শেষের এক ফালি ছুটির আমেজের নতুন সংস্করণ। এখানে আপনার ইচ্ছা হলে ভাড়া করে বিচে গাড়ি চালাতে পারেন। অথবা স্পিডবোট বা কিছুক্ষণের জন্য আকাশে ভাসতেও পারেন। যাকে বলে প্যারাগ্লাইড।

তালসারি
দিঘার নয় কিলোমিটার দূরে এই তালসারি সমুদ্র সৈকত। সারিবদ্ধ তালগাছ দিয়ে ঘিরে থাকার জন্য এই নির্জন সৈকতে নাম তালসারি। এটি মূলত একটি ছোট মাছ ধরার গ্রাম। লাল কাঁকড়া এই সৈকতের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। সূর্যোদয়ের ঠিক পরেই সৈকতের বালিয়াড়ি থেকে বেড়িয়ে আসে হাজারে হাজারে লাল কাঁকড়া। উদয় হওয়া সূর্যের রক্তিম রঙ মেখে ছড়িয়ে যেতে থাকে দিগন্ত জোড়া সৈকতে।   তবে কাছে গেলেই খুব দ্রুত বালির ভেতর ঢুকে যায় এই কাঁকড়ার দল। আবার সন্ধে নামার আগে সারিবদ্ধ ভাবে কাঁকড়ার দল ফিরে আসে তাদের বাসায়, বালির গভীরে।

এছাড়াও ভাটার সময়ে আরো বিভিন্ন সামুদ্রিক প্রাণী দেখা মেলে তালসারির সমুদ্র সৈকতে। কিছুটা দুরেই দেখা যাবে সুবর্ণ রেখা নদী। পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় তালসারি সমুদ্র সৈকত দেখলে মনে হয় চাঁদ যেন তার সমস্ত জ্যোৎস্না নিয়ে হাজির হয়েছে সমুদ্রের বুকে আর সমুদ্র যেন তার ঢেউয়ে ঢেউয়ে ভিজিয়ে দিচ্ছে জ্যোৎস্নার সমস্ত শরীর। প্রকৃতির এক অদ্ভুত জলছবি।

চান্দিপুর
দিঘার থেকে ২৬৯ কিলোমিটার দূরে চান্দিপুর সমুদ্র সৈকত। বাংলা-উড়িষ্যা সীমান্ত। উড়িষা রাজ্যে পরছে এই সমুদ্র সৈকতটি। সমুদ্রে সৈকত ধরে যারা ‘ট্রেকিং” করতে আগ্রহী তাদের জন্য দীঘা থকে চান্দিপুর ‘ট্রেকিং’ একটি পরিচিত যাত্রা পথ। পথে দেখতে পাবেন নানা ধরনের সামুদ্রিক প্রাণী। চোখে পড়বে বেশ কয়েকটি ছোট ছোট গ্রাম যাদের বেশির ভাগের মুল পেশা সমুদ্রে মাছ ধরা। বেশ কিছু ধরনের কাঁকড়া আর কচ্ছপের দেখা পাওয়া যাবে চান্দিপুরের সমুদ্র সৈকতে। আরও একটি বিশেষ কারণে চান্দিপুর বিখ্যাত। ভারতীয় সেনাবাহিনীর অন্যতম মিসাইল পরীক্ষার কেন্দ্র এই চান্দিপুর।

উদয়পুর সমুদ্র সৈকত
দিঘা থেকে মাত্র দুই কিলোমিটার দূরে উদয়পুর সমুদ্র সৈকত। এই সমুদ্র সৈকতটি এখন খুব একটা পরিচিতি লাভ করেনি। তবে যারা নিজর্ন সমুদ্র সৈকতের সন্ধান করছেন তাদের জন্য উদয়পুর একটি প্রিয় জায়গা হয়ে উঠবে সে কথা নিশ্চিত ভাবে বলা যায়। এখানেও সূর্যোদয় আর সূর্যাস্তের দৃশ্য মনের মণিকোঠায় চির স্মরণীয় হয়ে থাকবে। সঙ্গে আছে নানা ধরনের সামুদ্রিক প্রাণীদের অবাধ বিচরণ। তাই যারা প্রকৃতিকে পেতে চান শান্ত নিবিড় এবং নীরব কিছু মুহুর্তের মধ্যে অথবা ডুব দিতে চান নির্জন নৈসর্গিক গভীরে তাদের জন্য দিঘার আশে পাশের এই সৈকত গুলি আদর্শ হয়ে উঠতে পারে।

তবে সবশেষে বলা যায় একদিনের জন্য যদি দীঘা ভ্রমন করতে চান, তাহলে তাদের জন্য পুরানো দীঘা ও নতুন দিঘার সৈকতই যথেষ্ট। আর সঙ্গে মনে রাখা দরকার দীঘা কখনই আন্তর্জাতিক সমুদ্র সৈকত নয়। এটি পশ্চিমবাংলার মেদীনিপুর জেলার একটি সমুদ্র সৈকত। তাই কক্সবাজারের মত আন্তর্জাতিক সমুদ্র সৈতকের সঙ্গে কখনই তুলনা করা যায় না। এখানের প্রশাসনিক নিরাপত্তার জন্যই দিঘার সমুদ্র সৈকত হয়েছে সুন্দর থেকে সুন্দরতর।

বাংলাদেশ সময়:  ০৩২৫  ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০২, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।