কলকাতা: লোকসভা নির্বাচন নিয়ে সরগরম গোটা কলকাতা। পাড়ার চায়ের দোকান থেকে অফিস–আদালত, কলেজ–ইউনিভারসিটি অথবা বাসে কিংবা মেট্রোতে সব জায়গাতেই জমজমাট আলোচনা, তর্ক–বিতর্ক।
দেশের অর্থনীতি,রাজনীতি, বিদেশ নীতি কি হবে? অথবা মোদী নাকি রাহুল কে হবেন নতুন দিল্লীর ৭ নম্বর রেস কোর্স রোড-এর আগামী বাসিন্দা। এই নিয়ে জল্পনা তুঙ্গে কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গের আপামর নাগরিকের। কিন্তু যারা কলকাতায় বাস করেও কলকাতার নাগরিকদের মর্যাদা পান না। সভ্য সমাজ যাদের নাগরিক মর্যাদা দিতে কুণ্ঠা বোধ করেন! কিংবা যাদের এড়িয়ে চলাটাই সুস্থ নাগরিকদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বলে ধরা হয়, কি বলছেন কলকাতার সেই প্রান্তিক মানুষরা । কি বলছেন কলকাতার সোনাগাছির মেয়েরা।
ভোটের বাজারে এই প্রান্তিক মহিলাদের পাড়ায় হাজির বাংলানিউজের কলকাতা প্রতিনিধি। তাদের সঙ্গে কথা বলে একটা ধারণা পাওয়া গেল ভোট নিয়ে তাদের চিন্তা ভাবনার।
কলকাতার সোনাগাছি এলাকা দক্ষিণ এশিয়ার সবথেকে বড় পতিতা পল্লীগুলোর মধ্যে অন্যতম। এখানে হাজার হাজার মেয়ে যৌন ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। যদিও ভারতের আইন অনুযায়ী যৌন ব্যবসা বেআইনি তবুও বাস্তব চিত্রটিকে অস্বীকার করলে সত্যের অপলাপ হবে। এখানে একটা বিষয় খুবই উল্লেখযোগ্য য, ১৮ বছর বয়েসের উপরে এখানকার মহিলারা প্রায় সকলেই ভোটার। এদের বেশির ভাগের কাছেই আছে সচিত্র ভোটার পরিচয় পত্র। এবং গত নির্বাচন পর্যন্ত তারা ভোটও দিয়েছেন নিয়ম করে। অর্থাৎ ভারতের অন্যান্য নাগরিকদের থেকে এরা মৌলিক অধিকারগুলো পাবার ব্যাপারে এরা কোন অংশে কম সচেতন নন। কিন্তু বাস্তব চিত্র সত্যিই ভিন্ন। আর এটা অনুভব করা গেল যখন হাজির হলাম এই প্রান্তিক নারীদের মহল্লায়।
উত্তর কলকাতা লোকসভা আসনে অবস্থিত এই সোনাগাছি। ভোটের প্রচার এখানেও আছে। দেওয়াল লিখনেও যেন ললাট লিখনের প্রতিচ্ছবি আড়াই কিলোমিটার লম্বা পাড়ার বিভিন্ন দেওয়ালে। কে বলে রাজনীতির মানুষরা তাদের সমস্যাটা জানেন না! তারা জানেন আর জানেন বলেই ভোটের প্রচারে দেওয়ালে দেখা যায় একটি নখ বের করা হাতের তালুর নিচে এক জ্বলন্ত এক নারীর কান্না ভেজা মুখ। কিন্তু সেই চোখের জল মুছিয়ে দিতে আদৌ কোন পদক্ষেপ নেয়নি রাজনৈতিক দলগুলি। এমনটাই অভিযোগ করলেন এখানকার নারীরা।
কেমন এদের জীবন, আদৌ রাজনৈতিক কোন বিষয় এদের প্রভাবিত করে? এ সব প্রশ্ন নিয়ে হাজির হয়েছিলাম পশ্চিমবঙ্গের যৌনকর্মীদের সব থেকে বড় সংগঠন দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটির দপ্তরে। কলকাতার সোনাগাছি অঞ্চলেই তাদের অফিস। মুখোমুখি হয়েছিলাম এই সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা ড. স্মরজিত জানা এবং সংগঠনের সম্পাদক ভারতী দে-এর।
কথায় কথায় বেড়িয়ে এলো চড়া মে-কাপের নিচে জমে থাকা যন্ত্রণার কথা। ভারতী দেবী জানালেন তাদের দাবির কথা। মূল দাবি তিনটি, প্রথমত পেশার স্বীকৃতি, দ্বিতীয়ত স্ব নিয়ন্ত্রিত বোর্ড, তৃতীয়ত ইমমরাল ট্রাফিক (প্রিভেনশন) অ্যাক্ট বাতিল। আর এই দাবিগুলো নিয়ে তারা নির্বাচনের আগে হাজির হয়েছিলেন ১০০ জন প্রার্থীর কাছে যাদের আগামী দিনে লোকসভা নির্বাচনে জিতে সাংসদ হবার সম্ভাবনা আছে। এর মধ্যে ৬০ জন প্রার্থী লিখিত ভাবে এই বিষয়গুলোতে তাদের সহমত পোষণ করেছেন। জানালেন ভারতী দে।
কিন্তু সাংবাদিক হিসেবে ভারতের প্রথম সারির রাজনৈতিক দলগুলোর ইশতেহার খুঁটিয়ে পড়েও এই প্রান্তিক মহিলাদের সম্পর্কে একটি শব্দও পায়নি। প্রশ্ন ছুড়ে দিলাম দুর্বার সমন্বয় সমিতির সম্পাদিকার দিকে। তিনি জানালেন এই সমর্থন করার বিষয়টি পুরোটাই ব্যক্তিগত স্তরে, দলীয় স্তরে নয়। এর কারণ হতে পারে “ভোট ব্যাংক”। হয়তো রাজনৈতিক দলগুলি মনে করে এই প্রান্তিক নারীদের নিয়ে কথা বললে তথাকথিত সভ্য সমাজের কাছে তাদের অবস্থান ক্ষুণ্ণ হবে। জানালেন দুর্বার সমন্বয় সমিতির প্রতিষ্ঠাতা ড. স্মরজিত জানা।
তাহলে কি করবেন সোনাগাছির এই নারীরা। ভারতী দেবী জানালেন রাজনৈতিক দলগুলির কিছু করার আশা আর এই অঞ্চলের মেয়েরা আর করে না। তাই এদের অনেকেরই উৎসাহ নেই ভোট দেবার, অনেকে আবার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন “না ভোটে” ভোট দেবার। কিন্তু আপনাদের দাবিগুলো তাহলে সরকারের কাছে পৌঁছবে কি করে? আবার প্রশ্ন করলাম ভারতী দেবীকে।
ইতোমধ্যেই আলাপ হয়েছে এমন কয়েকজনের সঙ্গে যারা যৌন কর্মীদের সন্তান। এরা কেউ পড়াশোনা করছেন, কেউ পড়াশোনা শেষের পর চাকরি করছেন। কিন্তু বিদ্যালয় থেকে কর্মক্ষেত্রে যখনই এদের পরিচয় প্রকাশিত হয়েছে ঠিক সেই সময় এক চরম দুর্বিপাক নেমে এসেছে এদের জীবনে।
যৌন কর্মীদের আর্থিক নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচাতে দুর্বারের পরিচালনায় তৈরি হয়েছে ঊষা কো-অপারেটিভ যার মাধ্যমে একটু একটু করে সঞ্চয় করছেন তারা। দরকারে সেখান থেকেই ঋণ নিচ্ছেন। কিন্তু এদের সন্তানরা, যাদের রাতের বেলায় ঘুম পেলে রাস্তার ফুটপাত অথবা বাড়ির দালানই একমাত্র জায়গা । তাদের জন্য চিন্তিত সোনাগাছির মায়েরা।
তারা লড়াই করছেন নিজেদের শিশুদের একটা সুন্দর ভবিষ্যৎ দিতে। কিছুটা সফলও হচ্ছেন। কিন্তু আজও বদল হচ্ছে না সমাজের বাঁকা চোখের চাউনি, তবে তারা বুঝেছেন তাদের লড়াইটা অন্য কেউ এসে লড়ে দেবে না। অধিকার রক্ষার প্রখর দাবিতে চিৎকার করতে হবে তাদের নিজেদেরই।
আবার ফিরলাম লোকসভা নির্বাচনের কথায়। না আর অন্য কারোর উপর ভরসা রাখতে পারছেন না যৌন কর্মীরা। তবে ভরসা আছে গণতন্ত্রে, বিশ্বাস আছে সহ-নাগরিকদের উপর আর সেই কারণেই তাদের পরিকল্পনায় আছে ২০১৬ সালের পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটি-এর তরফে প্রার্থী দেবার, জানালেন ভারতী দেবী। উপস্থিত সকলের মুখে ছড়িয়ে পড়ল হাসি। এই হাসি যে সমর্থনের সেটা বুঝে নিতে একটুও সমস্যা হলো না।
বাংলাদেশ সময়: ১৬২০ ঘণ্টা, এপ্রিল ২১ , ২০১৪