কলকাতা থেকে ঢাকা যতটা, কাশী ততটাই। বিভূতিভূষণের উপন্যাসে, সত্যজিৎ রায়ের সিনেমায় অপুর বাবা হরিহরের মৃত্যু কাশিতেই।
রস আর সুরের জায়গায় এবার বেসুর। নীরব শহর রণক্ষেত্র। ষোড়শ লোকসভা নির্বাচনের কেন্দ্রবিন্দু। সিন্ধুর মতো তরঙ্গায়িত। ২৩টি দেশের সাংবাদিক আছড়ে পড়ছে। টিভির লাইভ কভারেজ ছড়াচ্ছে বিশ্বের কোণায় কোণায়। এই কেন্দ্রে প্রার্থী নরেন্দ্র মোদী অহঙ্কার করে বলছেন, এতো আকর্ষণ তাঁর জন্যই। দেশ-বিদেশের সবাই তাকেই ভারতের হবু প্রধানমন্ত্রী বলে ধরে নিয়েছে। সিংহাসনে বসাটা শুধু সময়ের অপেক্ষা। এটা আত্মবিশ্বাস, না দেমাক ঠিক করে বলা যায় না। তাঁকে ঠোকরাচ্ছে কংগ্রেস আর আম আদমি পার্টির সভাপতি অরবিন্দ কেজরিওয়াল স্বয়ং। হারার আগে হারতে নারাজ। না লড়ে এক সেন্টিমিটার মাটিও ছাড়বে না। প্রিয়াঙ্কা প্রার্থী হলে যুদ্ধটা অন্যমাত্রা পেত, তিনি চেয়েছিলেনও তা। মা সোনিয়া গান্ধী মত না দেওয়ায় ইচ্ছের মৃত্যু প্রিয়াঙ্কার।
মোদীকে দাবিয়ে রাখতে সিপিএম-তৃর্ণমূল পৌঁছেছে সেখানে। ভোট কেটে মোদীর পালক যদি কিছুটা ছাটা যায়। ডানা যতোই লম্বা হোক, একটা পালক খসলেও তো ক্ষতি। কাজটা তৃণমূল প্রার্থী ইন্দিরা তেওয়ারি কতটা পারবেন, তা নিয়ে সংশয়। মোদীর নৌকাতেই ছিলেন তিনি, আচমকা ঝাঁপ দিয়ে তৃণমূলে। অযোধ্যায় রামমন্দির নির্মাণের সংকল্পকে জোরদার করতে আন্দোলনে নেমেছিলেন। বিজেপি নেতা মুখতার আব্বাস নাকভি যখন রামমন্দির নির্মাণের ঘোষণাকে জোরদার করতে চেয়েছেন, ইন্দিরার পালে বাতাস লেগেছে। ভেবেছেন এবার কিছু একটা হবেই। হাওয়া ফুরিয়ে দিয়েছেন মোদী স্বয়ং। তিনি জানতের প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সাম্প্রদায়িকতার দাগ মুছতেই হবে। ফর্সা ইমেজ ছাড়া হালে পানি মিলবে না। তিনি মন্দির তৈরির পুরনো রাস্তা ছেড়ে ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে জানিয়ে দেন, পহেলে শৌচালয়, বাদ মে দেবালয়। নির্বাচনী বাজারে এটা নিঃসন্দেহে ক্যাচি শ্লোগান।
ইন্দিরা বুঝতে পারেন, রামমন্দির হওয়ার আপাতত কোন চান্স নেই। বিজেপির সদস্য তিনি ছিলেন না। তাঁর একরোখা প্রোগ্রাম ছিল রামমন্দির নির্মাণ। সেটা হবে না জেনেই অন্য রাস্তা খুঁজতে থাকেন। মমতা বন্দোপাধ্যায়ও তখন পাগলের মতো বেনারসে প্রার্থী সন্ধানে ব্যস্ত। ইন্দিরাকে পেয়ে আশ্বস্ত হন। ইন্দিরাকে মনোনয়ন দেওয়ার প্রধান কারণ তিনি কলকাতার সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত। আবার বেনারসেও পায়ের তলায় জমি আছে। হিন্দি-বাংলা দু’ভাষাতেই স্বচ্ছন্দ। বেনারসে বাঙালি ভোট ৭০ হাজার। সেই ভোট ইন্দিরা তৃণমূলের ঝুঁলিতে ভরতে পারলে মোদীকে বোঝান যাবে, তাঁর ডেরায় গিয়ে ভোট লুট করার ক্ষমতা তৃণমূলের আছে। মোদী পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূলের বিরুদ্ধে প্রায় সব আসনে প্রার্থী দিয়ে মমতাকে বিপাকে ফেলেছেন। মমতাও মোদীর কেন্দ্রে ইন্দিরাকে দাঁড় করিয়ে কিছুটা প্রতিশোধ নিয়েছেন। ইন্দিরার ইমেজে রামমন্দিরের ছাপ থাকায় মুসলমান ভোট পাওয়া যাবে না। মমতাও সেটা জানেন। তাঁর টার্গেট তাই বাঙালি হিন্দু ভোট। উত্তরপ্রদেশের অন্য জায়গার চেয়ে বেনারসে বাঙালি বেশি। হিন্দু বিধবাদের শেষ ঠিকানা কাশী। সংসারে অরুচি ধরায় বা প্রত্যাঘাত হওয়ায় তাঁরা কাশীমুখি হোন। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় থেকে আধুনিক ঔপন্যাসিকদের উপন্যাসে তার নজির যথেষ্ট। তাঁরাই এখন মমতার ভোটার। ইন্দিরা অতীতের বিশিষ্ট কংগ্রেস নেতা কমলাপতি ত্রিপাঠীর নাতনি। তা সত্ত্বেও কংগ্রেসে তাঁর ঠাঁই হয়নি। বাধ্য হয়ে তৃণমূলে।
বেনারসে সিপিএম প্রার্থী হীরালাল যাদব যুদ্ধে নেমেছেন মেহনতী মানুষের সমর্থন নিয়ে। তাঁর বিশ্বাস, মুসলমান ভোট তাঁর দিকেই আসবে। শ্রমিকরাও সিপিএমের দিকেই ঝুঁকবে। বেনারসে হিন্দুর সংখ্যা বেশি হলেও, প্রায় তিন লাখ মুসলমান ভোট আছে। তারা কোনভাবেই মোদীকে সমর্থন করতে পারছে না। কংগ্রেস আর আম আদমি পার্টি সেই ভোটে থাবা বসাতে চাইছে। সিপিএম তার কিছুটা পাবেই। হীরালালের বাড়িটা দশাশ্বমেধ ঘাটের পাশেই। বাড়ি থেকে গঙ্গা দেখা যায়। একটু দূরে বিসমিল্লাহ খানের বাড়ি। হীরালাল ঘাটে বসে প্রতিদিন প্রত্যূষে সিডি প্লেয়ারে বিসমিল্লাহর সানাইয়ে ভৈরবী শোনেন। আর গঙ্গাকে কানে কানে বলেন, নৈতিকতার পতন দেখেও তুমি বইছ কেন।
বাংলাদেশ সময়: ১৪৪৩ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৩, ২০১৪