কলকাতা: ভারতের জাতীয় রাজনীতির ‘নতুন চমক’ আম আদমি পার্টির খাসনেতা অরবিন্দ কেজরিওয়াল। একাধারে তিনি ভারতীয় রাজনীতিতে এক নতুন ধারার জন্মদাতা, অন্যদিকে তিনি তার বেশকিছু সিদ্ধান্তের জন্য রাজনৈতিক মহলের সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা এক ব্যক্তিত্ব।
আবার ব্যক্তিজীবনে বিলাসহীন ও সবকিছুতে স্বচ্ছ থাকার প্রয়াস যেমন আছে অরবিন্দের মন্স্তত্বে ঠিক তেমনি অন্যদিকে নেতা হিসাবে দল পরিচালনোর অর্থ এবং পদ্ধতি নিয়েও আছে নানা প্রশ্ন। তবে সকল প্রশ্নের সরাসরি উত্তর দেবার বিরল রাজনৈতিক মানসিকতার অধিকারী আম আদমি পার্টির এই নেতা।
আম আদমি পার্টি ভারতবর্ষের বুকে এমন একটি মাত্র দল যারা স্বেচ্ছায় নিজেদের ‘রাইট টু ইনফরমেশন অ্যাক্ট’ এর অধীনে আনতে চেয়েছে। যার মাধ্যমে দলের প্রতিটি হিসাব যেকোনো মানুষ চাইলেই দেখতে পারবেন।
তবে এই আম আদমি পার্টির নেতা তার মোট সম্পদে টেক্কা দিয়েছেন উত্তর প্রদেশের বারানসী আসনে তার অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী ও ভারতীয় জনতা পার্টি-বিজেপির প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী নরেন্দ্র দামোদর দাস মোদীকে।
ভারতের রাজধানী দিল্লির সাবেক মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালের জন্ম হরিয়ানাতে। পশ্চিম বঙ্গের খড়গপুর আই আই টি থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি লাভ করে তিনি টাটা স্টিল কোম্পানিতে উচ্চপদে যোগদান করেন। কিন্তু মোটা বেতনের চাকরি তুষ্ট করতে পারেনি কেজরিওয়ালকে। প্রায় তিন বছর চাকরি করার পর তা ছেড়ে আবার পড়াশুনায় মন দেন এই প্রতিভাবান প্রকৌশলী।
১৯৯৫ সালে ভারতীয় আয়কর দপ্তরে (আই আর এস) উচ্চপদে যোগদান করেন কেজরিওয়াল। কিন্তু এই চাকরি জীবনেও বেশি দিন স্থির থাকেননি তিনি। বেশ কিছু ঝড়-ঝাপটা, লড়াইয়ের মধ্যে থেকে ২০০৬ সালে তিনি এই সরকারি চাকরিটি ছেড়ে দেন। এখানে বলে রাখা দরকার, সরকারের সঙ্গে চুক্তি ভঙ্গের ফলে এই সময়কালে তার বেতনের অনেকটাই সরকারকে ফিরিয়ে দিতে হয়।
এই সময়টা কঠিন ছিল কেজরিয়ালের। কিন্তু ভবিষ্যতের নেতার চোখে তখন সমাজ বদলের অনির্বাণ স্বপ্ন। যতদূর জানা যায়, সরকারের সঙ্গে আইনি সমস্যার সম্পূর্ণ সমাধান হয় ২০১১ সালে। এই সময়ে আর্থিকভাবে তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন তার বন্ধুরা, যারা প্রায় সকলেই তখন দেশ-বিদেশে বিভিন্ন বড় বড় পদে চাকরিরত।
চাকরি করতে করতেই তিনি ‘পরিবর্তন’ নাম দিয়ে একটি সংস্কারমূলক আন্দোলন শুরু করেন। এরপর আসে ‘রাইট টু ইনফরমেশন অ্যাক্ট’ এবং ‘জন লোকপাল বিল’ নিয়ে আন্দোলনে মহাত্মা গান্ধীর অনুসারী ‘টিম আন্না’ এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়া।
তুখোড় মেধাবী কেজরিওয়াল ছিলেন ‘টিম আন্না’ এর সাংগঠনিক বিভাগের দায়িত্বে। তবে ‘টিম আন্না’ থেকে বেড়িয়ে নিজের দল গঠন করেন কেজরিওয়াল। তিনি পরিষ্কার ঘোষণা করেন, রাজনৈতিক দল গঠন না করলে দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠন করা সম্ভব নয়। আর এ নিয়েই মতবিরোধ হয় গুরু আন্নার সঙ্গেও।
এই সময়ে অনেকেই কেজরিওয়ালকে পথভ্রষ্ট, ক্ষমতালোভী ইত্যাদি নানা নামে অভিহিত করেছিলেন। কিন্তু মনস্তাস্তিক বিচারে একরোখা মানসিকতার কেজরিওয়ালকে সমালোচনা থামাতে পারেনি। ঠিক যেমন হাজার সমালোচনা থামতে পারেনি তার চাকরি ছাড়ার সিদ্ধান্তকে।
অপ্রতিরোধ্য এক নেতার চরিত্র বেড়িয়ে আসে এই সময়েই। দল গঠনের এক বছরের মাথায় ২০১৩ সালে বসেন দিল্লির মুখ্যমন্ত্রীর পদে। যদিও এর স্থায়িত্ব তার চাকরি জীবনের স্থায়িত্বের থেকেও অনেক কম, মাত্র ৩৯ দিন। দুর্নীতিবিরোধী ‘জন লোকপাল বিল’ পাশ করাতে না পেরে পদত্যাগ করেন তিনি।
এই পদ্যত্যাগ নিয়ে ঝড় ওঠে সমালোচনার। এর মাঝেই সমস্ত রেকর্ড ভেঙ্গে গোটা রাত দিল্লির তীব্র ঠাণ্ডায় ফুটপাতে প্রতিবাদ করেন কেজরিওয়াল। কোনো মুখ্যমন্ত্রীর এই ধরনের প্রতিবাদ ভারতের ইতিহাসে অভূতপূর্ব। মধুমেহ রোগের শিকার কেজরিওয়ালকে নিউমোনিয়ার জন্য ভর্তি করতে হয় হাসপাতালে।
ব্যক্তি জীবনে কেজরিওয়াল দুই সন্তানের পিতা। তিনি তার সহপাঠী সুনিতাকে বিয়ে করেন। সুনিতা সরকারি কর্মচারী। কেজরিওয়ালের খুব ঘনিষ্ঠ মানুষদের বক্তব্য, ব্যক্তিজীবনের রোজকার কাজে অনেকটাই স্ত্রীর উপর নির্ভরশীল এই বিপ্লবী মানসিকতার নেতা। বিভিন্ন সময় দেখা গেছে, নিরামিষভোজী কেজরিয়ালের জন্য বাড়ি থেকে টিফিন বক্স করে আন্দোলনস্থলে খাবার নিয়ে এসেছেন সুনিতা।
এবার আসুন দেখি, কেজরিওয়ালের সিন্ধুকে কী কী সম্পদ আছে। বেনারসে মোদীর বিরুদ্ধে মনোনয়নপত্র জমা দেবার সময় কেজরিওয়াল নিয়ম অনুযায়ী তার বিস্তারিত তথ্য নির্বাচন কমিশনকে দিয়েছেন।
কেজরিওয়াল জানিয়েছেন, তার হাতে আছে নগদ ১৫ হাজার রুপি। তার স্ত্রী সুনিতা কেজরিওয়ালের হাতে আছে নগদ ১০ হাজার রুপি। অরবিন্দ কেজরিওয়ালের ব্যাঙ্কে জমা আছে ৪ লাখ ১৪ হাজার রুপি। এই খাতে সুনিতা কেজরিওয়ালের জমা আছে ৭ লাখ ৭১ হাজার রুপি।
সুনিতা কেজরিওয়াল ৯ লাখ ২৪ হাজার রুপির গহনা থাকলেও কোনো গহনা নেই অরবিন্দ কেজরিওয়ালের। ঠিক যেমন কোনো শেয়ার বা বন্ড কেনা নেই অরবিন্দের। তবে স্ত্রী সুনিতা কেজরিওয়ালের ৩৬ হাজার ৪৯০ রুপি মূল্যের শেয়ার বা বন্ড কেনা আছে।
উত্তর প্রদেশের গাজিয়াবাদে এবং হরিয়ানায় দুটি জমি আছে অরবিন্দ কেজরিওয়ালের, যার বাজার মূল্য ৯২ লাখ রুপি। এর মধ্যে একটি জমি তার জন্মসূত্রে প্রাপ্ত। গুরগাঁওতে কেজরিওয়ালের যে বাড়ি আছে তার মূল্য ১ কোটি রুপি বলে নির্বাচন কমিশনকে জানিয়েছেন কেজরিওয়াল। কেজরিওয়ালের নামে কোনো দেনা না থাকলেও সুনিতি কেজরিওয়ালের দেনা আছে ৪১ লাখ রুপি। এর মধ্যে ১১ লাখ রুপি নেওয়া আত্মীয়-পরিজনদের কাছ থেকে। কোনো গাড়ি নেই কেজরিওয়াল পরিবারের।
দল গড়েছেন কেজরিওয়াল। সেই দলে ভাঙ্গণও এসেছে। অনেকে বলেছেন, নিজের মতকে সব থেকে বেশি প্রাধান্য দেন তিনি, অনেকে বলেছেন ক্ষমতার দম্ভে তিনি দাম্ভিক।
তবে সমস্ত সমালোচনার কথা মাথায় রেখেও একটি কথা খুব পরিষ্কারভাবে বলা য়ায়- কেজরিওয়াল রাজনীতির ময়দানে নিয়ে এসেছেন সমাজের সেই স্তরের মানুষদের যারা যথেষ্টভাবে রাজনৈতিক চেতনা সম্পন্ন হয়েও কোনো দিনই সরাসরি রাজনীতিতে আসার উৎসাহ বোধ করেননি।
আর ভারতের রাজনীতিতে এইটাই বোধহয় কেজরিওয়াল বা তার দল আম আদমি পার্টির এখনও পর্যন্ত সব থেকে বড় অবদান।
বাংলাদেশ সময়: ১৪৩০ ঘণ্টা, ২৬ এপ্রিল , ২০১৪