কলকাতা: চিচিং ফাঁক....চিচিং ফাঁক.... বললেই খুলে যেত চল্লিশ চোরের গুহা আর তার থেকে বেরিয়ে আসতো মোহর, সোনাদানা, হিরে, মুক্ত সব কিছু। কিন্তু কেউ জানে না আরব্য রজনীর সেই গুহার ঠিকানা।
সারদা ‘পঞ্জি স্কিম’ প্রতারণা মামলায় ঘটনাটা পশ্চিমবঙ্গেও অনেকটা একই রকম। এখানে চোখের সামনে দেখা যাচ্ছে চোরকে,দেখা যাচ্ছে যাদের ঘরে চুরি হয়েছে তাদেরকেও কিন্তু কেউ বলতে পারছে না কোন গোপন গুহায় লুকোনো আছে সেই চুরি করা সম্পদ। আর এটাই এখন পশ্চিমবঙ্গের ভোট পরীক্ষার কঠিনতম প্রশ্ন।
যদি বলা হয় পশ্চিমবঙ্গের ভোটের ময়দানে সবথেকে আলোচিত বিষয়টি কি?
নরেন্দ্র মোদী নাকি রাহুল গান্ধী, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ফেডারেল ফ্রন্ট, বামেদের তৃতীয় ফ্রন্ট নাকি সব ছাড়িয়ে নির্বাচন কমিশনের শক্ত হাতে নির্বাচন পরিচালনা অথবা এই সব কিছুকে টপকে নায়ক,গায়কদের রাজনৈতিক প্রচার?
পশ্চিমবঙ্গের ভোটের ময়দানে একটু ঘোরাঘুরি করলেই বোঝা যাবে মূল আলোচ্য বিষয় এগুলির কোনটাই নয়।
তবে আলোচনার বিষয়টি কি?
এই প্রশ্নের উত্তর পেতে গেলে রাজনৈতিক বোদ্ধা হবার বিন্দুমাত্র প্রয়োজন নেই। অফিস ফেরতা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত মেট্রোতে একটু হাঁফ ছাড়ার সুযোগ পেলেই কিংবা বাজার করে ফেরার পথে পরিচিত কোন প্রতিবেশীর সাথে চায়ের দোকানে দু’দণ্ড জিড়িয়ে নেবার ফাঁকে অথবা কলেজের ক্যান্টিনে দু’টো চাকে তিনটে করে নিতে নিতে ভোটের কথা উঠলেই যে বিষয়টা সামনে চলে আসছে সেটি হোল ২ হাজার ৬শ’ কোটি রুপির সারদা কেলেঙ্কারির কথা।
২ হাজার ৬শ’ কোটি রুপির হিসাবটা পশ্চিমবঙ্গের অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্রের পেশ করা রাজ্য বাজেটের প্রায় ১ শতাংশের একটু কম।
এখন পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্টের কাছে জমা হওয়া তছরুপকৃত অর্থের হিসাব হলো এটা। আগামী দিনে যে আরও বেশ কিছু অর্থ কেলেঙ্কারির হিসাব এর মধ্যে যুক্ত হবে না তার কোন নিশ্চয়তা নেই।
পশ্চিমবঙ্গের অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্রের পেশ করা বাজেটে এক বছরে গোটা রাজ্যের স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে মোট ১ হাজার ৪৯ লক্ষ রুপি যা এই কেলেঙ্কারিতে শূন্যে মিলিয়ে যাওয়া অর্থের প্রায় অর্ধেক। গোটা রাজ্যের কৃষি ক্ষেত্রে বাজেটে যে ব্যয় বরাদ্দ ধরা হয়েছে সারদা কেলেঙ্কারিতে যুক্ত অর্থের সেটি মাত্র আট ভাগের এক ভাগ। এই কেলেঙ্কারিতে কর্পূরের মত উড়ে যাওয়া মোট টাকার পরিমাণের প্রায় অর্ধেক টাকা গোটা পশ্চিমবঙ্গের বিদ্যুৎ খাতের বাজেট বরাদ্দ ধরা হয়েছে। একবার ভেবে দেখুন।
২০১২-১৩ সালে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন কর থেকে মোট আয় ৩১ হাজার কোটি রুপি। সারদা কেলেঙ্কারির হিসাব ধরলে দেখা যাবে মোট প্রতারণার অর্থ রাজ্যের মোট কর সংগ্রহের ৮ দশমিক ৩৮ শতাংশ। এই হিসাবের মাধ্যমেই এই কেলেঙ্কারির কত বড় প্রভাব পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতির উপর পড়েছে সেটা বোঝা যায়।
“সারদা কেলেঙ্কারি” ভারতের বুকে হওয়া সবথেকে বড় ‘পঞ্জি স্কিম’ প্রতারণা। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা আপাতত পাওয়া হিসেব অনুযায়ী ১৮ লক্ষ। আর এই বিরাট অঙ্কের প্রতারণা পশ্চিমবঙ্গের ভোটের ময়দানে সবথেকে বড় আলোচনার বিষয় হয়ে উঠবে তা বলাই বাহুল্য।
আমরা যদি এই আর্থিক কেলেঙ্কারির মূল ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের দিকে চোখ ফেরাই তাহলে দেখতে পাব এই প্রতারণার মূল শিকার মধ্যবিত্ত এবং নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষ। শহর থেকে মফস্বল আর মফস্বল থেকে গ্রামে বিষবৃক্ষেরমত শিকড় ছড়িয়ে ছিল সারদা গোষ্ঠী। সরকার, বিভিন্ন নজরদারি সংস্থার চোখের সামনে লক্ষ লক্ষ মানুষকে প্রতারণা করে গেছে এই গোষ্ঠী। প্রতারণার মাধ্যমেই হাজার হাজার কোটি রুপি আত্মসাৎ করেছে তারা।
তবে কেন হঠাৎ করে নড়ে চড়ে বসল প্রশাসন? এর উত্তরে আমাদের একটু পিছন ফিরে তাকাতে হবে। আজ থেকে প্রায় এক বছর আগের ঘটনা। ২০১৩ এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি হঠাৎ উধাও সারদা গোষ্ঠীর কর্ণধার সুদীপ্ত সেন। খবরটা জানাজানি হতেই গোটা রাজ্য জুড়ে শুরু হল ব্যাপক চাঞ্চল্য। একে একে গোটা পশ্চিমবঙ্গের সারদার সমস্ত অফিস বন্ধ হয়ে গেল। লক্ষ লক্ষ আমানতকারী প্রতিদিন জমা হতে থাকল এই অফিসগুলিতে। আর্ত কান্নায় পিচ্ছিল হল রাজপথ, সর্বহারাদের চিৎকারে ঘুম ভাঙল গোটা পশ্চিমবঙ্গের।
একদিকে অফিসগুলির সামনে জমায়েত অন্যদিকে যে সব এজেন্টরা টাকা সংগ্রহ করতেন তাদের উপর হামলা চালানোর ঘটনা একে একে সামনে আসতে লাগল। ভাঙচুর হতে থাকল একের পর এক সারদার অফিস। কিন্তু তখনও উধাও সারদা গোষ্ঠীর কর্ণধার সুদীপ্ত সেন।
এরই মধ্যে আমানতকারীর একটি বিরাট দল হাজির হন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর কালীঘাটের বাড়িতে। তাদের একটাই আশা, তাদের রক্ষা করতে পারেন একমাত্র ‘দিদি’। এই ঘটনার পরে আজও বার বার এই প্রশ্ন ওঠে কেন আমানতকারীদের ঐ বিশাল মিছিল একমাত্র ‘দিদি’র কাছে বিচার চাইতে গিয়েছিল!
এই প্রশ্নের খুব স্বাভাবিক উত্তর,কারণ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী, রাজ্যের জনগণ তাদের বিপদে প্রথমে খুব স্বাভাবিক ভাবে তার কাছেই যাবে। যতই মুখ্যমন্ত্রী বলুন না কেন সারদা গোষ্ঠী বাম আমলে তৈরি হয়েছিল।
কিন্তু বিষয়টা এতটা জলবৎ তরল নয়। অন্তত বিরোধীরা সেটা একদমই মানতে রাজি নয়।
তবে আসল ঘটনাটি কি?
বিরোধীদের মতে সুদীপ্ত সেন পালিয়ে যাবার আগে তাকে তৃণমূল কংগ্রেসের বেশ কয়েকজন সামনের সারির নেতা মন্ত্রীদের দেখা গিয়েছিল সারদা গোষ্ঠীর বিভিন্ন অনুষ্ঠানে। অনেক সময়ই তারা সুদীপ্ত সেনের পিঠ চাপড়ে দিয়ে তাকে অভিনন্দিত করেছিলেন প্রকাশ্যে। আর এই ধরনের ব্যবহারের ফলেই সাধারণ মানুষের অনেকটাই বেশি ভরসা এসেছিলো সারদা গোষ্ঠী সম্পর্কে।
শুধু তাই নয় সারদা গোষ্ঠীর অন্যান্য ব্যবসার সাথে ছিল মিডিয়া ব্যবসা। একাধিক খবরের কাগজ এবং টেলিভিশন চ্যানেল ছিল এই গোষ্ঠীর। আর এই মিডিয়া ব্যবসার সিইও ছিলেন কুণাল ঘোষ। কুণাল ঘোষ ছিলেন তৃণমূল কংগ্রেসের রাজ্য সভার সাংসদ। এছাড়াও রাজ্যের বিরোধীরা বলেন, তৃণমূলের লোকসভার সদস্য সৃজ্ঞয় বোস, রাজ্যের ক্রীড়া মন্ত্রী মদন মিত্রকে বারে বারে সারদা গোষ্ঠীর বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দেখা গেছে।
কিন্তু তাহলে এদের ছেড়ে মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ির দুয়ারে কেন আছড়ে পরেছিল এই প্রতারিত আমানতকারীদের ঢেউ।
খবরে প্রকাশ পশ্চিমবঙ্গের জঙ্গলমহলের আদিবাসী এলাকায় সারদা গোষ্ঠীর অ্যাম্বুলেন্সের উদ্বোধন করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী নিজে। এছাড়াও বিরোধীদের অভিযোগ ১ কোটি ৮০ লক্ষ রুপিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবি কিনেছিলেন সুদীপ্ত সেন। যদিও এই অভিযোগ জোরালোভাবে অস্বীকার করেছেন তৃণমূল নেতৃত্ব। অস্বীকার করেছেন সুদীপ্ত সেনও।
যে সময় সুদীপ্ত সেন নিখোঁজের পর মহাকরণে দাঁড়িয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘোষণা করলেন “যা গেছে তা গেছে” ভবিষ্যতে তিনি মানুষকে এ ধরনের প্রতারণার থেকে সতর্ক হতে বললেন।
কিন্তু এই মন্তব্যে আগুনে ঘি পড়ল। রাজপথে নেমে এলেন প্রতারিত মানুষরা। তাদের একটাই প্রশ্ন তবে কি আর ফেরত পাবেন না তাদের টাকা!
মুখ্যমন্ত্রী ৫শ’ কোটি রুপির তহবিল গড়লেন। বলেন সিগারেটের উপর কর চাপবে। রাজ্যের লোকে সিগারেট খেলে যে বাড়তি অর্থ উঠবে সেই অর্থ থেকে অর্থ ফেরত দেওয়া হবে প্রতারিত মানুষদের। আবার বিতর্ক শুরু হোল মুখ্যমন্ত্রীর পদক্ষেপ নিয়ে। সিগারেট খাওয়ায় উৎসাহ দিচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী বলে প্রতিবাদ করলেন বিরোধীরা।
২৩ শে এপ্রিল কাশ্মীর থেকে ধরা পরলেন সুদীপ্ত সেন এবং তার সহযোগী দেবযানী মুখার্জি। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ প্রথম দেখল এক আপাদমস্তক স্মার্ট,৭০ দশকের হিন্দি ছবির নায়কদের মত ঝকঝকে চেহারার এক মধ্যবয়সী প্রতারককে। তখন তার চোখে মুখে কোন অপরাধ বোধের চিহ্ন তো দূরের কথা কোন চিন্তার লেশমাত্র নেই। সুদীপ্ত সেন ধরা পরতেই আবার আশায় বুক বাঁধলো প্রতারিত আমানতকারীরা। তারা ভাবলেন এইবার ফেরত পাবেন তাদের পাওনা টাকা।
উদ্ধার হলো কিছু গাড়ি,বাজেয়াপ্ত হলো অফিস। কিন্তু কোথায় তাদের গচ্ছিত অর্থ? সেদিন যেমন কেউ জানতো না আজও কেউ জানে না সেই গচ্ছিত অর্থের বেশির ভাগের হদিশ। এ যেন আলিবাবা চল্লিশ চোর গল্পের গোপন গুহা। যার হদিশ জানেনা বাইরের কোন মানুষ।
শুরু হলো বিচার, প্রাক্তণ বিচারপতি শ্যামল সেন-এর নেতৃত্বে গঠন হলো কমিশন। বিভিন্ন কোর্টে মামলা শুরু হলো সারদা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে। মামলা গড়াল সুপ্রিম কোর্টের দরজায়।
মাঝে মাঝে উঠে আসতে থাকলো শাসক দলের নানাজনের যুক্ত থাকার তথ্য। গ্রেপ্তার হলেন তৃণমূলের রাজ্যসভার সাংসদ কুণাল ঘোষ। গোপন জবানবন্দি দিতে ইচ্ছা প্রকাশ করেও সরে এলেন কুণাল। কারণ আজও অজানা। যদিও জানা যায় কুণাল আদালতে বলেছেন তাকে আরও মামলায় ফাঁসিয়ে দেবার ভয় দেখান হয়েছিল। কে ভয় দেখিয়েছিল কুণালকে? তবে কি সর্ষের মধ্যেই আছে জিনের বাসা। এমনটাই অভিযোগ বিরোধীদের। আলাদা করে তদন্ত শুরু করল এনফোর্সমেন্ট ডাইরেক্টরেট(ইডি)। এরই মধ্যে আসছিল একটি-দুটি করে আত্মহত্যার ধারাবাহিক খবর।
সুপ্রিম কোর্টের কড়া ধমক খেয়ে নড়েচড়ে বসল ইডি। গ্রেপ্তার হলেন সুদীপ্ত সেনের স্ত্রী পিয়ালি সেন এবং ছেলে শুভজিৎ সেন। ‘ইডি’র এই তদন্তের তৎপরতায় রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে সরব হলেন শাসক দল। অপর দিকে আসাম, ওড়িশা, ত্রিপুরা ইত্যাদি রাজ্য সুপ্রিম কোর্টের কাছে সিবিআই তদন্ত নিয়ে তাদের সহমত জানালেও একমাত্র পশ্চিমবঙ্গ সিবিআই তদন্তের বিরোধিতা করেছে।
অপর দিকে “ইডি” কোর্টকে জানায় তাদের সাহায্য করছে না রাজ্য পুলিশ। এই বিতর্ক আরও উসকে উঠল যখন সুদীপ্ত সেনের স্ত্রীর একটি ব্যাংক লকার খুলতে ইডিকে এড়িয়ে আদালতের রায় নিয়ে প্রায় যুদ্ধকালীন তৎপরতা দেখায় রাজ্য পুলিশ। যদিও রাজ্য পুলিশ জানায় ‘ইডি’কে সাহায্য করতেই তাদের এই তৎপরতা।
এক বছর অতিক্রান্ত এখনও অপেক্ষা কোন সংস্থা তদন্ত করবে তাই নিয়ে। তবে পুরো দমে চলছে রাজনৈতিক চাপান উতর। সামান্য কিছু আমানতকারী অল্পকিছু অর্থ ফেরত পেয়েছেন তবে এখনো না পাওয়াদের লাইনটা বিস্তর লম্বা। ঠিক চল্লিশ চোরের গুহার মত এখনো কেউ জানে না কোথায় বা কাদের পকেটে গচ্ছিত আছে সারদার বিপুল আমানত। আর এটাই বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের লোকসভা নির্বাচনের বিরোধী দলগুলির কাছেই সবথেকে বড় ইস্যু নয় পশ্চিমবঙ্গের জনগণের কাছেও সবথেকে বড় ইস্যু ।
বাংলাদেশ সময়: ১৪৫৯ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৯, ২০১৪