ঢাকা: ভারতের আইনে আছে, কোনো ভোটারের বাড়ি থেকে তাঁর নিকটতম ভোটকেন্দ্রের সর্বাধিক দূরত্ব হতে পারে দু’কিলোমিটার। কিন্তু দক্ষিণ-পশ্চিম গুজরাটের ভরত দাস জি নামে এক সাধুর আশ্রম থেকে সবচেয়ে কাছের ভোটকেন্দ্রটি প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরে।
বৃহস্পতিবারের সপ্তম দফা ভোটে ভরতকে ভোট দেওয়ার সুযোগ করে দিতে বুধবার শেষ রাতে সাধুর আশ্রমের কাছে ভোটকেন্দ্র বানাতে যান ছয়জন ভোটকর্মী ও তিনজন বনকর্মী।
এরপর সকাল থেকে বিকেলের যে কোনো একসময় ‘গ্রহণ’ করা হবে তার ভোট মূল্যবান ভোটটি।
বুধবার এক প্রতিবেদনে ভারতের আনন্দবাজার পত্রিকা জানায়, দক্ষিণ-পশ্চিম গুজরাটে ১৪১২ বর্গ কিলোমিটারজুড়ে ভারতের একমাত্র সিংহ অভয়ারণ্য গির। সেই অরণ্যের প্রায় মাঝামাঝি জায়গায় রয়েছে আশ্রম সরস্বতী দাস বাপুর। জনশ্রুতি, পাণ্ডবেরা বনবাসে এসে এখানে বাণেশ্বর শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, স্থানীয়দের কাছে যা বাণেজ তীর্থক্ষেত্র হিসেবেই পরিচিত। বর্তমানে উদাসীন আখড়ার একমাত্র আশ্রমিক এই ভরতদাস মহারাজ দর্শনদাস। জুনাগড় লোকসভা কেন্দ্র শুধু নয়, গোটা দেশের তিনিই একমাত্র নাগরিক, যাঁর ভোটের ব্যবস্থা করে দিতে থাকছে গোটা একটি কেন্দ্র। অরণ্যচারী ওই ভোটার যাতে নিজের ভোটটি স্বচ্ছন্দে দিতে পারেন, তার জন্য সব রকমের ব্যবস্থা করে নির্বাচন কমিশন।
মৎস্য রফতানি কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত ভেরাবল থেকে গাড়িতে ঘণ্টা খানেক যাওয়ার পরে শুরু গির অরণ্য। বন দফতরের পারমিট ছাড়া ভেতরে ঢোকা যায় না। অসমান কাঁচা রাস্তা। একাধিক শুকনো নদীখাতের পাশাপাশি রয়েছে কিছু সজীব নদীখাতও। বর্ষায় সেগুলি ভরে গিয়ে কার্যত অগম্য হয়ে পড়ে গোটা গির। এখন প্রথম গ্রীষ্মের ঝাঁ ঝাঁ ৪৪ ডিগ্রিতে সব নদীর জল উবে গিয়েছে। দাবানলের চিহ্ন পথের দু’ধারের শাল-সেগুনের গুঁড়িতে। আঁকা-বাঁকা ৩০ কিলোমিটার পাথুরে রাস্তা ঘণ্টা আড়াইয়ে পার হয়ে যখন আশ্রমে পৌঁছানো যায়
মন্দির ঘেঁষেই বইছে ডাফরি নদী। ভরা গ্রীষ্মেও নাকি তিরতির করে ঠাণ্ডা জল বয় এই নদীতে। তাই আখড়া চত্বরে সন্ধ্যার আঁধার একটু গাঢ় হলেই নিয়ম করে হাজির হয় পশুরাজের দলবল। যদিও মন্দির চত্বর তো বটেই, অরণ্যের ওই গোটা অংশে দর্শনার্থীদের রাত্রিবাসে রয়েছে কড়া নিষেধাজ্ঞা।
এই ভরত দাসের ভোটের বন্দোবস্ত করতেই ফি ভোটে কয়েক জন বনকর্মীকে সঙ্গে নিয়ে উনা থেকে প্রায় ৩৫ কিলোমিটার ভেতরে আসেন ছয় ভোট কর্মী। শেষ পাঁচ কিলোমিটার হেঁটেই আসতে হয় তাঁদের। আশ্রম চত্বরে বানানো হয় ভোট কেন্দ্র। সকাল সকালই নিজের ভোটটি দিয়ে ঝামেলা চুকিয়ে ফেলেন ভরত দাস। সে পর্ব মেটার পরে প্রসাদ-টসাদ খেয়ে ফের উনার পথে পা বাড়ান কর্মীরা। ২০০৪ সাল থেকে শুরু হয়েছে ভরত তাদের জন্য এই ব্যবস্থা। ২০০৯ সালের লোকসভা ভোট এবং ২০০৭ ও ২০১২ সালের বিধানসভা ভোটেও এ ভাবেই ভোট দেন ভরত দাস।
এক জনের ভোটারের জন্য কেন এত আয়োজন?
জুনাগড়ের জেলাশাসক অলোককুমার পাণ্ডের কথায়, তিনি কেবল কমিশনের নিয়ম পালন করছেন মাত্র। আর যাঁর মূল্যবান ভোটটির জন্য এত আয়োজন, সেই ভরত দাস জি কী বলেন? ‘এই ঘন জঙ্গলে ভোটের অধিকারটুকু ছাড়া আমার আর কী-ই বা আছে? ভাল লাগে যে, শুধু আমার জন্যই এখানে আস্ত একটা কেন্দ্র তৈরি হয়। এটাই আমার গুপ্তধন। ’
কিন্তু পাঁচ বছর আগে তিনি যে প্রত্যাশা নিয়ে ভোট দিয়েছিলেন, তা কি মিটেছে? স্মিত হাসেন ভরতদাস, ‘আমার কোনো প্রত্যাশা নেই। আমি আমার কাজ করে যাচ্ছি। নেতাদের কাজ কথা দেওয়া। তা রাখা বা না-রাখা তাদের দায়িত্ব। সে সব দেখার জন্য ঈশ্বর রয়েছেন। আমার দায়িত্ব শুধু ভোটটুকু দেওয়া। ’
এখন তো মোবাইলেও প্রচার হয়। কোনো ফোন কল বা এসএমএস কি আপনাকে পাঠিয়েছে কোনো দল?
প্রৌঢ় ভরত দাস বলেন, ‘আমি লেখাপড়া শিখিনি, তাই এসএমএস পড়তে পারি না। কেবল ফোন ধরতে আর কাটতে জানি। ফোনেও কেউ তাদের প্রার্থীকে ভোট দিতে বলেনি। তবে আমি আমার পছন্দের প্রার্থীকেই ভোট দেব। ’
ভোট দিতে জনগণকে সচেতন করতে ঢালাও প্রচার চালাচ্ছে নির্বাচন কমিশন। সেই প্রচারের নির্যাস হল, ‘প্রতিটি ভোটই গুরুত্বপূর্ণ। ’ কিন্তু গিরে তাদের এই ব্যবস্থা সম্ভবত কমিশনের সব চেয়ে বড় প্রচার। আর ভরত দাসও বিলক্ষণ সেটা বোঝেন। সংসারে আসক্ত না হলেও তাই নিজের ভোটটা ঠিকই দিয়ে আসছেন।
বাংলাদেশ সময়: ০৯৩৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ৩০, ২০১৪