কলকাতা: লোকসভা নির্বাচন মাধ্যমে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে বার বার উঠে এসেছে প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশের নাম। প্রতিবেশী রাষ্ট্র হিসেবে বৈদেশিক নীতি নিয়ে আলোচনায় বাংলাদেশের নাম উঠে আসবে এটাই স্বাভাবিক।
প্রতিটি দল নির্বাচনী ইশতেহারে তাদের বিদেশনীতি ব্যাখ্যা করেছে। সবকটি দলই প্রতিবেশী দেশগুলির সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখার কথা বলেছে। এর মধ্যে একমাত্র ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি–মার্কসবাদী (সিপিআই-এম) আলাদাভাবে একটি অনুচ্ছেদে বাংলাদেশের বিষয়ে তাদের মতামত জানিয়েছে। এছাড়া প্রতিবেশী রাষ্ট্র নিয়ে কোনো দল আলাদাভাবে মত প্রকাশ করেনি।
কিন্তু, সময় যত গড়িয়েছে, তত বেশি করে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ উঠে এসেছে পশ্চিমবঙ্গের লোকসভা ভোটের রাজনীতিতে। কিন্তু কী বিশেষ কারণ যার ফলে ভোটের আগে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে বাংলাদেশ নিয়ে এত আলোচনা!
এর উত্তর খুঁজতে হলে নজর রাখতে হবে গত ২৭ এপ্রিল পশ্চিমবঙ্গের জনসভায় বিজেপি প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী নরেন্দ্র মোদীর জনসভার বক্তব্যের ওপর। শ্রীরামপুরের সে সভায় নরেন্দ্র মোদী বলেছিলেন, ১৯৪৭ সালের পরে যারা ভারতে এসেছেন, তারা বিছানা-বেডিং বেঁধে রাখুন। ১৬ মে-র পরে তাদের বাংলাদেশে ফিরে যেতে হবে।
এ বক্তব্যের জেরে শুধু পশ্চিমবঙ্গেই নয়, ব্যাপক আলোচনা শুরু হয় বাংলাদেশেও। যদিও পরে বিজেপি নেতারা বলার চেষ্টা করেছেন, মোদী এমনটা বলতে চাননি।
পশ্চিমবঙ্গের খড়গপুরে জনসভা করে বিজেপি সভাপতি রাজনাথ সিং বলেছেন, কারো ওপরে অত্যাচার হবে না। কিন্তু, যারা বিনা ভিসা-পাসপোর্টে এখানে এসেছেন, তাদের ওখানে (বাংলাদেশ) ফিরে যাওয়াই উচিত। আমরা তাদের চিহ্নিত করবো।
তবে এ বিতর্কের শুরুটা আরো কয়েক দিন আগে। আসাম থেকে প্রকাশিত দৈনিক ‘সাময়িক প্রসঙ্গ’ পত্রিকায় ১৯ এপ্রিল বিজেপি নেতা সুব্রাহ্মনিয়ম স্বামীর বক্তব্য নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
এই পত্রিকায় প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, ১৯৪৭ এর জুনে দেশভাগ এবং ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্ট অ্যাক্টের বিষয় টেনে তিনি খুলনা থেকে সিলেট পর্যন্ত সমান্তরাল জমি নিয়ে একটি বিতর্কিত মন্তব্য করেন। যদিও স্বামী নিজেই বলেছেন, এটি বিজেপি দলের মতামত নয়। এটি তার ব্যক্তিগত মতামত।
নরেন্দ্র মোদীর বাংলাদেশ নিয়ে মন্তব্যের সমালোচনা করা হয় ভারতের বাকি রাজনৈতিক দলগুলির তরফে। কিন্তু এখানে একটি বিষয় লক্ষ্যণীয় যে, এ বক্তব্যের তীব্র সমালোচনা করেন তৃণমূল নেত্রী তথা পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
খড়গপুরে দাঁড়িয়েই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, কেউ কেউ চান, বাংলায়-বাংলায়, হিন্দু-মুসলিমে ভাগাভাগি হয়ে যাক। আমি জানি, আপনারা বঙ্গভঙ্গ চান না।
এর পরেই মেদেনীপুরের জনসভায় তিনি বলেন, আমার কাছে নির্দিষ্ট খবর রয়েছে, দাঙ্গা লাগানোর চেষ্টা হয়েছে। আমরা দাঙ্গা লাগাব না। দাঙ্গা লাগানো আমার উদ্দেশ্য নয়। ” যদিও তার ‘খবরের’ ভিত্তি তিনি পরিষ্কার করে খুলে বলেন নি।
বিজেপি নেতাদের এই ধরনের বক্তব্য নিয়ে খুব সমীচীনভাবেই অন্যান্য রাজনৈতিক দল সমালোচনায় মুখর হবে সেটা স্বাভাবিক। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতিক্রিয়া বিশ্লেষকদের ভাবনার খোরাক জোগায় বৈকি!
তার কারণ কি বাংলাদেশের প্রতি ভালোবাসা নাকি বাংলাদেশের মানুষের প্রতি তার আন্তরিকতা? নাকি এটি বিজেপিকে রাজনৈতিক আক্রমণের একটা ইস্যু মাত্র। কারণ, এ সভা থেকেই সারদা গোষ্ঠীর আর্থিক প্রতারণার কথা টেনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রধান অস্ত্র তার সততা নিয়ে সরাসরি প্রশ্ন তুলছিলেন নরেন্দ্র মোদী। তাই, মোদীর বক্তব্যকে সমালোচনা করে কিছুটা ভোট কেটে নেওয়ার কৌশল!
এ প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে রাজনৈতিক মহলেও। মোদীর কথার প্রতিবাদ করলেও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী পাশের রাজ্য আসামে বসে বলে যাওয়া সুব্রাহ্মনিয়ম স্বামীর বক্তব্যের কোনো প্রতিবাদ করেননি।
সুব্রাহ্মনিয়ম স্বামীর বক্তব্য নিয়ে সরাসরি প্রশ্ন করা হয় সিপিএম পলিটব্যুরোর সদস্য বিমান বসুকে। তিনি বাংলানিউজের কাছে এ বক্তব্যের বিরোধিতা করেছেন। সেই সঙ্গে এর তীব্র সমালোচনাও করেন তিনি।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। তার উত্তরে তিনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে ‘দিদি’ বলে সম্বোধন করেছিলেন।
কিন্তু তার ঠিক ৫ মাসের মাথায় ২০১১-এর সেপ্টেম্বর মাসে তিস্তা চুক্তি নিয়ে বাংলাদেশ সফরের সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং-এর সঙ্গে বাংলাদেশ যেতে অস্বীকার করেন পশ্চিমবাংলার মুখ্যমন্ত্রী। আটকে যায় তিস্তা পানি বণ্টন চুক্তি।
সেই সময় মমতা জানিয়েছিলেন তিস্তার পানি বাংলাদেশকে দিয়ে দিলে চাষের ক্ষতি হবে পশ্চিমবাংলার। তিনি আরো বলেন, এই পানি দিয়ে দিলে শুকিয়ে যাবে পশ্চিমবঙ্গ।
একথা ঠিক যে, গোটা বিশ্বের ১৮ ভাগ মানুষের বাস ভারতে। কিন্তু জাতিসংঘের প্রতিবেদন অনুযায়ী, মাত্র ৪ ভাগ জল আছে ভারতে। ১৯৪৭ সাল থেকে ২০১১ সালে জলের মাত্রা নেমে এসেছে ৬০৪২ কিউবিক মিটার থেকে ১৫৪৫ কিউবিক মিটারে।
তবে পাশাপাশি এটাও ঠিক, আন্তর্জাতিক আইনকে সম্মান দেখিয়ে শুধু ভারত এবং বাংলাদেশ নয়, এই ধরনের পানি বণ্টনের অনেক নজির আছে ইউরোপসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে।
তবে মমতা কেন তিস্তা চুক্তির বিরোধিতা করেছিলেন? এর পেছনে কি কোনো ভোটের রাজনীতি ছিল? পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী কি ভেবেছিলেন, এই তিস্তা চুক্তি হলে অখুশি হবেন পশ্চিমবঙ্গের মানুষ। নাকি অন্য কিছু!
বাংলাদেশের সঙ্গে ছিটমহল বিনিময় এবং তিস্তা চুক্তি সফলভাবেই হবে বলে গত ২৫ এপ্রিল কলকাতা প্রেসক্লাবে সাংবাদিকদের জানান পশ্চিমবঙ্গের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য।
তিনি বলেন, কোনো একটি দলের জন্য প্রতিবেশী বাংলাদেশের সঙ্গে কোনোভাবেই সুসম্পর্ক নষ্ট হতে দেওয়া যাবে না।
২০১২ সালের জুন–জুলাই, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রথমে প্রণব মুখোপাধ্যায়ের বিরোধিতা করলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু, পরে তিনি প্রণব মুখোপাধ্যায়কেই সমর্থন করলেন। কেন তবে বিরোধিতা করেছিলেন আর কেনই-বা পরে তিনি সমর্থন করেছিলেন, তার উত্তরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, তিনি বাংলার মানুষের আবেগের কথা ভেবে এই সমর্থন করেছিলেন।
কিন্তু প্রশ্ন অন্য জায়গায়। এখন পর্যন্ত ভোটের যা হাওয়া তাতে কোনো একটি দল সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন নিয়ে জিতে ক্ষমতায় আসতে পারবে বলে সঠিকভাবে কেউ বলতে পারছে না। যদি তাই হয় এবং বিজেপির সঙ্গে জোটে যেতে হয়, তৃণমূল কংগ্রেসকে, তবে কি বিজেপির যে বিষয়গুলি নিয়ে মমতা এত তীব্র মোদী বিরোধিতায় নেমেছেন, সেই বিষয়গুলিতে তিনি আদৌ মুখ খুলতে পারবেন! নাকি বিজেপিকে সমর্থন করা জনগণের ইচ্ছা, এই অজুহাতে মুখ বন্ধ করে থাকবেন।
এগুলি সবটাই অনুমান। কেউ বলতেই পারেন অনুমানের উত্তর দেওয়ার কোনো দায় নেই রাজনৈতিক নেতাদের। কিন্তু প্রশ্ন এড়িয়ে গেলেই প্রশ্নটি গুরুত্বহীন হয়ে যায় না। তবে এর উত্তর পেতে আরও কিছুটা সময়ের অপেক্ষা করতেই হবে। আর সেই সময়টা ১৬ মে এর পর।
তবে বিষয়টা এমনটা নয় যে, দিল্লিতে বিজেপি সরকার গঠন করলে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যাবে। আবার এমনটাও না যে, বিজেপি প্রথমবার দিল্লিতে ক্ষমতায় আসছে।
তবে এটাও ঠিক, বিভিন্ন নেতার বিভিন্ন মন্তব্যে বারে বারে পশ্চিমবঙ্গের ভোটের রাজনীতিতে উঠে আসছে বাংলাদেশের নাম। আগামী দিনেও এই চর্চা চলতে থাকবে বলেই মনে হচ্ছে।
বাংলাদেশ সময়: ১১৫৮ ঘণ্টা, মে ০৪, ২০১৪