বাংলাদেশের ববিতাকেই শেষমেষ ‘অশনি সংকেত’ ছবির নায়িকা করেছিলেন সত্যজিৎ রায়। বিভূতিভূষণের গল্প।
মনোঃক্ষুন্ন সন্ধ্যা বিখ্যাত পরিচালক তরুণ মজুমদারকে বিয়ে করার পরে স্বামীর ছবিতে নায়িকা হওয়ার সুযোগ দু’একটিতে পেলেও, শেষে সাইড রোল নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। ধীরে ধীরে দু’জনের দূরত্ব বাড়তে বাড়তে আসমান-জমিন ফারাকে এসে দাঁড়ায়। রাজনৈতিক ব্যবধানও হয়ে ওঠে বিস্তর। তরুণ সিপিএম, সন্ধ্যা তৃণমূল। এবার মেদিনীপুর লোকসভা কেন্দ্রের প্রার্থী সন্ধ্যা। পাশে তরুণ নেই। নীতিগত সাহায্য না থাকলেও যুদ্ধে স্ত্রীর সঙ্গী হওয়ায় স্বামীর অবশ্য কর্তব্য। বিচ্ছেদ হলেও দায়িত্বটা থেকে যায়।
মনোনয়ন পাওয়ার পর সন্ধ্যা ভেবেছিলেন একাই ঝড় তুলতে পারবেন। সেটা যে সম্ভব না, ক’দিনেই বুঝেছেন। রাজনীতিতে কেউ কাজের নয়। বরং রাজনৈতিক ধাক্কায় আপনও পর হয়ে যায়। বয়সে ছোট হওয়া সত্ত্বেও যাঁকে তিনি দিদি দিদি করে পাগল সেই মমতা বন্ধ্যোপাধ্যায় পর্যন্ত কাছে নেই। দু’এক বার দেখা দিয়েই উধাও। তাঁকে দোষ দেওয়াও যায় না। একটা কেন্দ্র নিয়ে পড়ে থাকলে চলবে কেন। ৪২টি কেন্দ্র সামলাতে হচ্ছে। তৃণমূল প্রার্থী মাত্রই মমতার মুখাপেক্ষী। ব্যতিক্রম দু’জন। তাঁরাও মেদিনীপুর জেলার প্রার্থী। কাঁশির শিশির অধিকারী, তমলুকের শুভেন্দু অধিকারী। তাঁরা মমতাকে স্পষ্টভাবেই জানিয়ে দিয়েছেন, আপনি অন্যদিকে নজর দিন। এখানে আসতে হবে না, আমাদের কথা ভাবতেও হবে না।
এমন তেজ মমতার পছন্দ নয়। প্রার্থীরা নিজের পায়ে দাঁড়াবেন সেটা মেনে নিতে পারেন না। পশ্চিমবঙ্গের ৪২টি কেন্দ্রেই আসল প্রার্থী তিনি। বাকিরা ডামি। কেউ নিজের ক্যারিশমা দেখাতে চাইলেই বাদ। তবু বাধ্য হয়ে সময় বিশেষে ঢেঁকি গিলতে হয়। নন্দীগ্রামে আন্দোলন থেকে শুরু করে হলদিয়ায় সিপিএম রাজত্ব ধ্বংস করার পেছনে যাঁদের সব থেকে বেশি অবদান তাঁদের ঔদ্ধত্যও স্বীকার করতে হয় রাজনীতির স্বার্থে। শিশির, শুভেন্দু কংগ্রেসী। তৃণমূল ছেড়ে ফের কংগ্রেসে ফিরলে তো সর্বনাশ। মুহূর্তে মেদিনীপুর তৃণমূলের হাতছাড়া হয়ে যাবে।
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য আইনসভা বা বিধানসভার মোট আসন ২৯৪। সেখানে তৃণমূলের সংখ্যাগরিষ্ঠতায় মুখ্যমন্ত্রী হতে পেরেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সাতটি বিধানসভা মিলিয়ে একটি লোকসভা আসন। অর্থাৎ লোকসভায় আসন মানে বিধানসভার সাতগুণ। এই বিশাল এলাকার মানুষকে স্বপক্ষে আনা যে কোন প্রার্থীর পক্ষেই দুরূহ কাজ। ২০১১-তে বিধানসভা আসনের প্রার্থী হওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল সন্ধ্যা রায়কে। তিনি রাজি হননি। লোকসভা প্রার্থী হওয়ার সুযোগ পেয়ে তিনি আর না করেননি। একবারেই রাজ্য ছেড়ে জাতীয় রাজনীতিতে প্রবেশ। সাংসদ নির্বাচিত হলে পার্লামেন্টে বসতে হবে। সেখানে বাংলা নয়— হিন্দি অথবা ইংরেজিতে কথা বলার নিয়ম? সন্ধ্যার পক্ষে সেটা অসম্ভব। ভাল করে বাংলাই বলতে পারেন না। অন্য ভাষায় কথা বলবেন কী করে। লেখাপড়াও জানেন না। স্কুলের গণ্ডি পেরোননি।
সন্ধ্যা কলকাতা থেকে মেদিনীপুরে নিজের কেন্দ্রে প্রচারে গিয়ে ঘর ছেড়ে খুব একটা বেড়োয়নি। দুই নায়ক— দেব আর হিরণ সন্ধ্যার হয়ে কিছুটা প্রচার চালিয়েছেন। তাঁরাও তো ভাল বক্তা নন। এলাকায় তৃণমূলের গোষ্ঠী দ্বন্দ্ব প্রবল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে গিয়েও সামলাতে পারেননি। তিনি সভায় যাওয়া মাত্রই বিক্ষুব্ধ গোষ্ঠী সভা ছেড়ে চলে গেছে।
সন্ধ্যা রায়ের লড়াই তুখোড় বাম রাজনীতিক প্রবোধ পাণ্ডার সঙ্গে। সিপিআই প্রার্থী প্রবোধ পর পর তিনবার মেদিনীপুর লোকসভা আসনে জিতেছেন। এবারে জিতলে চারবার হবে। ২০১১-র বিধানসভায় নির্বাচনে বামরা এগিয়েছিল এই এলাকায়। রাজ্য জুড়ে বামদের ভরাডুবির মধ্যে দ্বীপের মতো ভেসেছিল মেদিনীপুর। সন্ধ্যা রায় বড় রকমের ঝুঁকি নিয়েছেন। বিধানসভা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জিতলে পশ্চিমবঙ্গের মন্ত্রীও হয়ে যেতে পারতেন। পুকুরে সাঁতার না শিখে একেবারে সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়েছেন। তিনি সব সময় ছোট নয়, বড় কিছু চেয়েছেন। নায়িকা হতে চেয়েছেন বারবার। তাঁকে নিরাশ হতে হয়েছে। লোকসভা ভোটে জিতে তিনি নায়িকেই হতে চান। সত্যজিৎ রায়, তরুণ মজুমদার, তাঁকে নায়িকার আসন না দিলেও মানুষ তাঁকে সেই স্বীকৃতি দেবে। এটাই তাঁর বিশ্বাস। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রবোধ পাণ্ডা এ নিয়ে কোনও মন্তব্যে নারাজ।
বাংলাদেশ সময়: ১৭২৩ ঘণ্টা, মে ০৪, ২০১৪
** পায়ের তলার জমি