কলকাতা: ভারতের নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশ হতে আর মাঝে মাত্র একটি দিন। শুক্রবার সকাল থেকেই শুরু হবে ভোট গণনা।
ফল ঘোষণার পর নিয়ম মেনে ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি সবচেয়ে বেশি আসন যে দল বা জোট পেয়েছে তাদেরকে সরকার গঠনের জন্য আহ্বান জানাবেন। রাষ্ট্রপতির কাছে ওই দল বা জোটকে নিজেদের সমর্থনে সংখ্যাগরিষ্ঠ বিজয়ী প্রার্থীদের লিখিত সমর্থনের প্রমাণপত্র জমা দিতে হবে।
এরপরেই রাষ্ট্রপতি সরকার গঠনের আদেশ দেবেন। কিন্তু এ নির্বাচন পরবর্তী এবং ফলাফল পূর্ববর্তী সময়ের মধ্যে গোটা ভারতের দৃষ্টি যেদিকে নিবদ্ধ হয়ে আছে সেটি আর কিছু নয়, একমাত্র বুথ ফেরত সমীক্ষা।
ইতিমধ্যেই সকলেই জেনে গেছেন, বেশিরভাগ বুথ ফেরত সমীক্ষায় এগিয়ে আছে বিজেপি। বলতে গেলে মোদীতে মগ্ন হয়ে আছে ভারত । অন্তত বুথ ফেরত সমীক্ষার হিসাব সে কথাই বলছে।
বুথ ফেরত সমীক্ষার মতে, কে কতোটি আসন পাবে বা কে কতো শতাংশ ভোট পাবে ইতিমধ্যেই সেটি বহুল প্রচারিত। তবে বুথ ফেরত সমীক্ষা প্রকাশ হবার সঙ্গে সঙ্গেই এ সমীক্ষার কার্যকরিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে।
কংগ্রেস নেতারা সরাসরি এ সমীক্ষার কার্যকরিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। অপরদিকে বিজেপি এ সমীক্ষাকে অভিনন্দন জানিয়েছে। কারণটা সহজেই অনুমেয়। বিজেপির পক্ষে ফল আসায় তারা স্বাভাবিকভাবেই সাদরে গ্রহণ করেছে এ সমীক্ষাকে।
কিন্তু সাধারণ মানুষের মনে একটা প্রশ্ন থেকেই যায় যে, ঠিক কিভাবে এ সমীক্ষা করা হয়। কিভাবেই বা মিডিয়া হাউজগুলো তাদের সমীক্ষা থেকে আসনভিত্তিক ফলাফল বের করে? কারা এ ধরনের সমীক্ষার সমীক্ষক হিসেবে কাজ করেন? কিভাবেই বা তারা মানুষের মতামতগুলো সংগ্রহ করেন?
এছাড়াও আছে আরও কিছু প্রশ্ন। যেমন কিসের ভিত্তিতে বেছে নেওয়া হয় ভোটারদের? অথবা কিসের ভিত্তিতেই বা ঠিক হয়, কতোজন ভোটারের মতামত নেওয়া হবে।
যদিও ভারতের বুথ ফেরত সমীক্ষার ইতিহাস খুব একটা সাফল্যের নয়। সুদূর অতীতের ইতিহাস না ঘেঁটেও যদি আমারা অতি সাম্প্রতিককালের ইতিহাসের দিকে একটু নজর ফেরাই তাহলে দেখতে পাবো দিল্লির বিধানসভা নির্বাচনে ‘এবিপি নিউজ’ এবং ‘এসি নিয়েলসন’-এর যৌথ সমীক্ষায় বলা হয়েছিল, ৭০টি আসনের মধ্যে বিজেপি পাবে ৩৭টি আসন, কংগ্রেস পাবে ১৬টি আসন এবং আম আদমি পার্টি পাবে ১৫টি আসন।
দিল্লির নির্বাচনের ‘সি ভোটার’ এবং ‘টাইমস নাও’ টেলিভিশন চ্যানেলের যৌথ সমীক্ষায় বলা হয়েছিল, বিজেপি পাবে ৩১টি আসন, কংগ্রেস পাবে ২৪টি আসন এবং আম আদমি পার্টি পাবে ১২টি আসন। বাকি চারটি আসন পাবে অন্যান্য দল।
‘ইন্ডিয়া টুডে’ এবং ‘ও আর জি’-এর সমীক্ষায় বলা হয়েছিল, বিজেপি পাবে ৪১টি আসন, কংগ্রেস পাবে ২০টি এবং আম আদমি পার্টি পাবে ৬টি আসন।
কিন্তু ফলাফল দেখলেই বাস্তব আর সমীক্ষার পার্থক্যটি বোঝা যাবে। দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনে আম আদমি পার্টি পেয়েছিল ২৮টি আসন, কংগ্রেস ৮টি আসন এবং বিজেপি ৩২টি আসন।
গত ১২ মে নির্বাচন শেষ হবার পরে এক সাক্ষাতকারে জম্মু-কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লা মন্তব্য করেছিলেন, বুথ ফেরত সমীক্ষা শুধুমাত্র একটি ভালো সময় কাটানোর বিষয়।
কংগ্রেস নেতা দিগ্বিজয় সিং টুইটারে লিখেছিলেন, একটি দেশের ৮০০ মিলিয়ন ভোটারের মতামত কিভাবে মাত্র কয়েক লাখ ভোটারের মতামতকে বিশ্লেষণ করে পাওয়া যাবে!
২০০৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের বুথ ফেরত সমীক্ষার ফলাফল এবং ভোটের বাস্তব ফলাফলের সঙ্গেও যথেষ্ট পার্থক্য ছিল। যেখানে ‘সি ভোটার’ ২৭৬টি আসন বিজেপির দখলে থাকবে বলে জানিয়েছিল সেখানে বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোট পায় মোট ১৮১টি আসন। আর পরেরবার ২০০৯ সালের নির্বাচনে যেখানে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ জোট ১৯৫টির কাছাকাছি আসন পাবে বলে সমীক্ষায় প্রচার করা হয়েছিল সেখানে সেবার ইউপিএ পায় ২৬২টি আসন।
বুথ ফেরত সমীক্ষা বেশ কয়েক ধরনের পদ্ধতিতে পরিচালিত হয়। তবে পদ্ধতি বেশ কয়েক ধরনের হলেও সমীক্ষার মূল তত্ত্বটি প্রায় একই রকম।
প্রথমে বেছে নেওয়া হয় যে কতো আসনে এ বুথ ফেরত সমীক্ষা করা হবে। ভারতের ক্ষেত্রে সাধারণত ৫৪৩টি লোকসভা আসনকেই এ সমীক্ষার ভেতরে আনা হয়। এরপর কিছু অনুমতি নেবার বিষয় থাকে। অনুমতি পাওয়া গেলে শুরু হয় সমীক্ষার কাজ।
প্রথমেই একটি সহজ অঙ্কের ব্যবহার করা হয়। ধরা যাক, একটি দেশে চারটি জেলা আছে এবং এ চারটি জেলায় নির্বাচন হচ্ছে। খুব সহজেই চারটি জেলার নির্বাচনের ভোটার সংখ্যা পাওয়া যাবে, ধরা যাক, ‘ক’ জেলার ভোটার সংখ্যা ১০০০ জন, ‘খ’ জেলার ভোটার ১২০০ জন, ‘গ’ জেলার ভোটার ৯০০ জন এবং ‘ঘ’ জেলার ভোটারও ৯০০ জন। চারটি জেলার মোট ভোটারের সংখ্যা দাঁড়ায় ৪০০০ জন।
যদি প্রতিটি জেলা অনুযায়ী ভোটারের শতাংশ নির্ণয় করা হয় তাহলে ‘ক’ জেলায় পাওয়া গেল ১০০০ জন ভোটার/৪০০০ জন মোট ভোটার অর্থাৎ ২৫ শতাংশ। ঠিক এইভাবেই ‘খ’ জেলায় পাওয়া গেল ৩০ শতাংশ ‘গ’ এবং ‘ঘ’ জেলায় পাওয়া গেল ২২ শতাংশ।
এরপরের পদক্ষেপে নির্ণয় করা হয় প্রতি জেলায় কতোজন করে ভোটারের মতামত সমীক্ষা করা হবে। এটা এমনটা নয় যে, যতোজন ইচ্ছা হল ততোজন ভোটারের মতামত গ্রহণ করা হবে। এর হিসাবটিও অতি সরল। আগে ঠিক করতে হয়, এ চারটি জেলার মধ্যে গড়ে কতোজন ভোটারকে নিয়ে সমীক্ষা করা হবে।
এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন সমীক্ষক বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করে থাকেন। হিসাবের সুবিধার জন্য ধরা যাক, প্রতি জেলায় ৫০০ জন করে ভোটারকে আমাদের সমীক্ষায় আনা হবে।
আগেই দেখেছি, ‘ক’ জেলায় চারটি জেলার মোট ভোটারের ২৫ শতাংশ ভোটদাতা বর্তমান। ধরা যাক, সমীক্ষায় আসছেন প্রতি জেলার ৫০০ জন ভোটার।
এবার নির্ণয় করতে হবে কতোজন ভোটারকে প্রশ্নপত্র বা নমুনা ব্যালট পেপার দেওয়া হবে । নমুনা ব্যালট পেপারে কিছু প্রশ্ন থাকে যার মাধ্যমে অনুমান করা যায় যে, ভোটার কোন দলকে ভোট দিয়েছেন।
আবার একটি অঙ্কের পালা ৫০০x ২৫% =১২৫। অর্থাৎ ‘ক’ জেলার ১২৫ জন ভোটারকে নমুনা ব্যালট পেপার দিতে হবে। একইভাবে এগোলে ‘খ’ জেলার ১৫০ জন ভোটার, ‘গ’ জেলার ১১২ জন ভোটার এবং ‘ঘ’ জেলার ১১২ জন ভোটারের মতামত নিতে হবে।
এরপর ওই ভোটারদের পুরুষ এবং মহিলায় ভাগ করা হয়। ১২৫ জন ভোটার হলে ৬৩ জন পুরুষ এবং ৬২ জন মহিলার মতামত নেওয়া হবে। এছাড়াও অনেক সময় বয়সের ভিত্তিতেও ভাগ করা হয়।
এ নমুনা ব্যালট এবং ব্যালট বাক্স কিছু নির্দিষ্ট ভোটকেন্দ্রের বাইরে রাখা থাকে। ভোট দিয়ে বের হয়ে ভোটাররা সেখানে মতামত জানান।
এ মতামতের ওপর ভিত্তি করেই ফলাফলের বিষয়ে ধারণা করা হয়।
তবে একথা বলাই যায়, বিপুল জনসংখ্যার দেশ ভারতে কয়েক লাখ ভোটারের ওপর সমীক্ষা করে ভোটদানের একটা প্রবণতা পাওয়া গেলেও পরিষ্কার চিত্র পাওয়া খুবই কঠিন। তাই অপেক্ষা আরও একটা দিনের । আগামী শুক্রবার ১৬ মে- সেই দিন।
বাংলাদেশ সময়: ১৬০৫ ঘণ্টা, মে ১৪, ২০১৪