কলকাতা থেকে ফিরে: ভারতের ষষ্ঠদশ লোকসভা নির্বাচন নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের মানুষের মধ্যেও ছিল ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা। এ রাজ্যে এখন শাসন ক্ষমতায় তৃণমূল কংগ্রেস।
প্রায় ৩ বছর চলছে রাজ্য পরিচালনা করছে তৃণমূল কংগ্রেস। সিপিএম নেতৃত্বাধীন ৩৩ বছরের বামফ্রন্ট সরকারকে হটিয়ে পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় আসেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
সদ্য সমাপ্ত লোকসভা নির্বাচনে একটা বিষয় খুবই লক্ষ্যণীয় যে এক সময়ের দোর্দণ্ড প্রতাপশালী শাসকদল সিপিএমের ভোট হ্রাস পেয়েছে দারুণভাবে। পক্ষান্তরে শাসকদল তৃণমূল তাদের ঘাঁটি আরও শক্ত করেছে। আর বিজেপি রাজ্যের মানুষের সমর্থন লাভে সফল হয়েছেন।
পশ্চিমবঙ্গে দলের আসন পাকাপোক্ত করতে কয়েকবারই এ রাজ্যে এসে নির্বাচনী জনসভা করে গিয়েছেন ভারতের প্রায় চূড়ান্ত প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী দামোদর। এসেছেন কংগ্রেসের সহ-সভাপতি রাহুল গান্ধী।
৩৩ বছরের বাম জমানার আগে অর্থাৎ ১৯৪৭ সাল থেকে পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় ছিল কংগ্রেস। ভারতের স্বাধীনতা নেতৃত্বদানকারী দল কংগ্রেস তাদের পশ্চিমবঙ্গে হারানো দুর্গ ফিরে পেতে জোর প্রচেষ্টা চালিয়েছে।
যে কারণে কংগ্রেস তাদের শক্ত প্রতিপক্ষ তৃণমূলকে ঘায়েল করতে সারদা, টেট-এর দুর্নীতি নিয়ে মমতা ও তার মন্ত্রিসভার বিরুদ্ধে ব্যাপক সরব ছিল। মমতাও তার সরকারকে রক্ষা করতে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে তোপ দেগেছেন।
অথচ ২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেস-তৃণমূল জোট গড়ে একসঙ্গে ভোট করেছে। বিজয়ী হয়ে একসঙ্গে সরকারও গঠন করেছে। মমতা পেয়েছেন ভারতের সবচেয়ে শক্তিশালী ও মর্যাদাপূর্ণ মন্ত্রণালয় রেল। যা তিনি আগেও লাভ করেছিলেন বাজপেয়ী সরকারের সময়ে।
যাহোক ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের সঙ্গে সমঝোতা করে বিজয়ী হন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শোচনীয় পরাজয় বরণ করে ৩৩ বছরের ক্ষমতাসীন সিপিএম ও বামভুক্ত দলগুলো।
কিন্তু বছর না ঘুরতেই নানা ইস্যুতে মন্ত্রীত্ব থেকে পদত্যাগ করে কংগ্রেসের মন্ত্রিসভা থেকে বেড়িয়ে আসেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এজন্য রাহুল গত সপ্তাহে একেবারে শেষ মুহূর্তের পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচনী জনসভায় মমতাকে বিশ্বাসঘাতক আখ্যায়িত করে সমালোচনা করতে ছাড়েননি।
মমতাও কম যান না পাল্টা আক্রমন করেন কংগ্রেসের। কিন্তু একটা ব্যাপার লক্ষ্যণীয় ছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নির্বাচনী সভাগুলোতে কংগ্রেসের চেয়ে কড়া সমালোচনা করেছেন বিজেপি ও হবু প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর।
মমতার আশঙ্কা ছিল সদ্য এ নির্বাচনে কংগ্রেস নয় তার রাজ্যে ভাগ বসাবে বিজেপি। তাঁর এ আশঙ্কা সত্য হয়নি। হয়তো তার কড়া প্রত্যুত্তরের কারণে বিজেপি কোনভাবেই তৃণমূলের ভোটব্যাংকে সুবিধা করতে পারেনি। মমতা সমানে সমানে বিজেপিকে টক্কর দিয়েছেন। তাই দুর্গ রক্ষা করতে সমর্থ হয়েছেন।
অপরদিকে সিপিএম বেশ খোশ মেজাজে ছিল এইভেবে যে কংগ্রেস এবং বিজেপি যেভাবে তৃণমূলকে সারদা ও টেট দুর্নীতি নিয়ে যেভাবে জেঁকে ধরেছে তাতে মমতার দলের আসন কমবে। কিন্তু ফল হয়েছে উল্টো। তাদেরই ভোটব্যাংক আশঙ্কাজনক হারে কমেছে।
আশ্চর্যজনকভাবে সিপিএম’রই ভোট গিয়ে পড়েছে চির বৈরী বিজেপির ঝুলিতে। সাড়ে ৩ দশকের মধ্যে সিপিএমের জন্য যা বড়ই গ্লানিকর। অবশ্য সারদা বা টেট নিয়ে রাজ্যে মমতা সরকার বেশ অস্বস্তিতে রয়েছে।
তারপরও সুবিধার পরিবর্তে আরও পিছিয়ে পড়েছে সিপিএম। লক্ষ্যণীয়ভাবে আসন কমেছে। তারা সহসা যে আবার ঘুরে দাঁড়াবে তারও কোন আলামত দেখা যাচ্ছে না। সিপিএম‘র কর্মীদের দারুণ হতাশা লক্ষ্য করা গিয়েছে। মনে হচ্ছে তারা নিজেদের গুটিয়ে নিচ্ছেন রাজনীতি থেকে।
তাদের এমন ধারাটা শুরু হয়েছে দলের শক্তিশালী নেতা ও প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতিবসুর রাজনীতি থেকে অবসরে যাওয়ার পর থেকে। কর্মীদের উজ্জীবিত করার সম্মোহনী শক্তি তাঁর মতো আর কোন নেতার মধ্যে দেখা যায়নি।
বাংলাদেশে বিএনপি নেতাদের মতো সিপিএম নেতাদের মধ্যেও বেশ একটা গা-ছাড়া ভাব। যা কিনা এক সময়ের লড়াকু দলটির কর্মকাণ্ড খুবই হতাশাজনক। জনসাধারণকে ঐক্যবদ্ধ করার সম্মোহনী শক্তি নেতাদের মধ্য থেকে উবে গিয়েছে বলে মনে হল।
কে বলবে এই দলটি ৩৩ বছর এ রাজ্যে শাসন করেছে শক্তহাতে। যা কিনা সারা ভারতে ছিল ঈর্ষনীয়। তাদের সুশাসনের কারণে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের বহু মানুষ পশ্চিমবঙ্গে এসে স্থায়ীভাবে থিতু হয়েছেন।
চাকরি-বাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্যে অন্য রাজ্যের লোকদের সরব পদচারনা তারই সাক্ষ্য বহন করছে।
এবার দেখে নেওয়া যাক পশ্চিমবঙ্গে কে কোন আসন থেকে বিজয়ী হলেন-
রাজ্যের লোকসভার আসন সংখ্যা ৪২। এরমধ্যে-
তৃণমূল - ৩৪
বামফ্রন্ট - ২
বিজেপি -২
কংগ্রেস -৪।
জয়ী হয়েছেন-
১.দার্জিলিং-এ সুরেন্দ্র আলুওয়ালিয়া ( বিজেপি)
২.আলিপুরদুয়ার- দশরথ তিরকে (তৃণমূল)
৩.জলপাইগুড়ি-বিজয়চন্দ্র বর্মন (তৃণমূল)
৪.রায়গঞ্জ- মহম্মদ সেলিম(সিপিএম)
৫.কুচবিহার- রেনুকা সিনহা (তৃণমূল)
৬.বালুরঘাট- অর্পিতা ঘোষ (তৃণমূল)
৭.মালদহ- (উত্তর)- মৌসম বেনজির নূর (কংগ্রেস)
৮.মালদহ-(দক্ষিণ)-আবু হাসেম খান চৌধুরী (কংগ্রেস)
৯.জঙ্গিপুর- অভিজিত মুখোপাধ্যায়(কংগ্রেস)
১০.বহরমপুর- অধীর চৌধুরী (কংগ্রেস)
১১.মুর্শিদাবাদ- মদুদ্দেজা হোসেন (সিপিএম)
১২.কৃষ্ণনগর- তাপস পাল (তৃণমূল)
১৩.রানাঘাট- তাপস মণ্ডল (তৃণমূল)
১৪.বনগাঁ- কপিলকৃষ্ণ ঠাকুর(তৃণমূল)
১৫.ব্যারাকপুর- দীনেশ ত্রিবেদী (তৃণমূল)
১৬.দমদম- অধ্যাপক সৌগত রায় (তৃণমূল)
১৭.বারাসত- কাকলি ঘোষদস্তিদার(তৃণমূল)
১৮.বসিরহাট- ইদ্রিস আলি (তৃণমূল)
১৯.জয়নগর- প্রতিমা মণ্ডল (তৃণমূল)
২০.মথুরাপুর- চৌধুরী মোহন জাটুয়া (তৃণমূল)
২১.ডায়মন্ডহারবার- অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় (তৃণমূল)
২২.যাদবপুর- সুগত বসু (তৃণমূল)
২৩.কলকাতা (দক্ষিণ)- সুব্রত বক্সি (তৃণমূল)
২৪.কলকাতা (উত্তর)- সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় (তৃণমূল)
২৫.হাওড়া - প্রসুন বন্দ্যোপাধ্যায় (তৃণমূল) ২৬.উলুবেড়িয়া- সুলতান আহমেদ (তৃণমূল)
২৭.হুগলি- রত্না দে নাগ (তৃণমূল)
২৮.আরামবাগ- আফরিন আলি (তৃণমূল)
২৯.শ্রীরামপুর- কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়(তৃণমূল)
৩০.তমলুক- শুভেন্দু অধিকারী (তৃণমূল)
৩১.কাঁথি- শিশির অধিকারী (তৃণমূল)
৩২.মেদিনীপুর- অভিনেত্রী সন্ধ্যা রায় (তৃনমূল)
৩৩.ঘাটাল- দীপক অধিকারী (তৃণমূল)
৩৪.পুরুলিয়া- মৃগাঙ্ক মাহাতো (তৃণমূল) জয়ী
৩৫.বাঁকুড়া- অভিনেত্রী মুনমুন সেন (তৃণমূল)
৩৬.বিষ্ণুপুর- সৌমিত্র খান (তৃণমূল)
৩৭.ঝাড়গ্রাম- উমা সোরেন (তৃণমূল)
৩৮.আসানসোল- বাবুল সুপ্রিয় (বিজেপি)
৩৯.বর্ধমান- সুনীল কুমার মণ্ডল (তৃণমূল), জয়ী
৪০.দুর্গাপুর- সংঘমিত্রা মুমতাজ (তৃণমূল)
৪১.বোলপুর- অনুপম হাজরা (তৃণমূল) এবং
৪২.বীরভূমে- অভিনেত্রী শতাব্দী রায়(তৃণমূল)।
বাংলাদেশ সময়: ২২৫১ ঘণ্টা, মে ১৬, ২০১৪