কলকাতা থেকে ফিরে: ঝোড়ো ইনিংস দিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল দিল্লির আম আদমি পার্টি (আপ)। কিন্তু লোকসভা নির্বাচনে এসে জনপ্রিয়তা আর ধরে রাখতে পারল না দলটি।
গত বছর আপের উত্থানে দিল্লির মানুষ যেভাবে তাদের স্বাগত জানিয়েছিলেন, তা সত্যিই বিরল। দিল্লিবাসীর মতো সারা ভারতের মানুষও তাদের কাছে টেনে নিয়েছিলেন এটা ভেবে যে, দেশে অন্তত একটা দুর্নীতিমুক্ত সৎ দল পাওয়া গেল। দলটি নজর কেড়েছিল বিশ্বজুড়েও।
দিল্লির বিধানসভা নির্বাচনে পুরোনো দলগুলোর আসন ছাপিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে রাজ্যে সরকারও গড়েছিলেন আপের প্রধান অরবিন্দ কেজরিওয়াল। তবে সরকার গড়তে প্রয়োজনীয় সংখ্যক আসন না থাকায় কংগ্রেসের সমর্থন নেন তিনি।
কিন্তু ৫০ দিন যেতে না যেতেই হটকারী সিদ্ধান্ত নেন কেজরিওয়াল। মানুষের ভোটের মর্যাদা না দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী পদ থেকে পদত্যাগ করেন তিনি। ভেবেছিলেন, দিল্লিবাসী এটাকে সহানুভূতির চোখে দেখবেন। কিন্তু ফল হল উল্টো। বিরক্ত হলেন ভোটাররা।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, কাজ করতে গেলে বাঁধা আসে। তাই বলে রাজনীতিতে আবেগ দিয়ে কাজ হয় না। ধীরস্থিরভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। অল্পদিন রাজনীতিতে নেমে এটা বোধগম্য হওয়া অবশ্য কেজরিওয়ালের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই তার এ হটকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণ।
এক বছর আগের আপের জনপ্রিয়তায় যে ভাটা পড়েছে প্রবলভাবে, তা এবার হাড়ে হাড়ে টের পেলেন কেজরিওয়াল। সূতিকাগৃহ দিল্লিতেই প্রথম বড় পরীক্ষায় ডাহা ফেল করে গেলেন তিনি৷ আপ প্রার্থীরা দিল্লির সাতটি লোকসভা আসনের একটিতেও জয়ী হতে পারেননি৷
আপ শুধু দিল্লি কেন, গোটা দেশে ৪৩৪ জন প্রার্থী দাঁড় করিয়ে জিততে পেরেছেন পাঞ্জাব রাজ্যের মাত্র চারটি আসনে৷ দিল্লিতে আপের প্রাপ্ত ভোটের হার ৩২.৯ শতাংশ৷ বিজেপি সাতটি আসনেই জয়ী হয়েছে ৪৬.৪ শতাংশ ভোট পেয়ে৷ অন্যদিকে কংগ্রেস মাত্র ১৫.১ শতাংশ ভোট পেয়ে একটি আসনেও জয়ী হতে পারেনি৷
দুর্নীতিমুক্ত দেশ গড়ার ডাক দিয়ে নতুন দল হয়েও গত বছর দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনে ৭০ আসনের মধ্যে ২৮টি আসন পেয়েছিল আপ৷ বিজেপির ছিল ৩১টি আসন৷ দুর্বল সংখ্যা নিয়ে বিজেপি সরকার গঠন করতে রাজি হয়নি৷ ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ কংগ্রেসের সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করেন অরবিন্দ কেজরিওয়াল৷
কেজরি মুখ্যমন্ত্রীর পদে শপথ নিয়েই ঘোষণা করেছিলেন, দশদিনের মধ্যে দিল্লির সব সমস্যার সমাধান করে দেবেন৷ ব্যর্থ হয়ে ৪৯ দিনের মাথায় দিল্লির সিংহাসন ছেড়ে পালিয়ে যান মুখ্যমন্ত্রী কেজরিওয়াল৷
পরে তিনি নিজে একে ‘পলিটিক্যাল মিসক্যালকুলেশন' বলেছিলেন৷ অর্থাৎ কেজরিওয়াল অপরিণত রাজনীতির পরিচয় দিয়েছিলেন৷ বলা যায়, সেদিনই প্রায় নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল আপের ভবিষ্যত রাজনীতি৷
গতবছর দিল্লি বিধানসভায় আপ ২৮ আসন পেলেও এবার লোকসভা নির্বাচনে তা অনুপস্থিত। বিধানসভা নির্বাচনের ফলের অঙ্ক এ নির্বাচনে কাজে আসেনি৷ তাই লোকসভা নির্বাচনে দিল্লিতে আপের ফলাফলে অত্যন্ত হতাশ কেজরিওয়াল৷
অবশ্য দিল্লিতে দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসাবে সান্ত্বনার সুযোগ থাকছে আপের সামনে৷ তাতে দলের প্রার্থীদের কেজরিওয়াল কতোটা শান্ত রাখতে পারবেন সেই প্রশ্ন থেকেই যাচেছ৷ আপ প্রার্থীরা এ নির্বাচনে প্রতিষ্ঠিত দলগুলোর বিরুদ্ধে তাদের কষ্টার্জিত অর্থ ঢেলেছেন৷ জিততে না পেরে তাদের ক্ষোভ গিয়ে পড়েছে আপ-নেতৃত্বের ওপরেই৷ প্রার্থীরা বলছেন, দলের তারকা নেতাদের কাছে তারা কোনো সহযোগিতাই পাননি৷
এদিকে অরবিন্দ কেজরিওয়াল, কুমার বিশ্বাস, যোগেন্দ্র যাদবদের মতো নেতারা দিল্লি ভোটে ছিলেন না৷ দিল্লি ছেড়ে অরবিন্দ গিয়েছিলেন বারানসিতে বিজেপির প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে লড়তে৷
রাজনৈতিক মহল বলছে, দিল্লিতে থাকলে কেজরিওয়াল রাজধানী শহরের সাফল্যের মুখ দেখতে পাবেন না- তাই অছিলা করেই পালিয়েছেন বারানসিতে৷ খোদ দিল্লিতে হারের চাইতে বারানসিতে গিয়ে হেভিওয়েট মোদীর কাছে পরাজয়ের লজ্জা কম৷ বিধানসভা ভোটে কংগ্রেসের দুর্নীতির ইস্যু তাদের এগিয়ে রাখলেও, এ ভোটে দিল্লির মোদী হাওয়া আপকেও এগোতে দেয়নি৷
দিল্লির দেয়ালে পোস্টার পড়েছে ‘দিল্লিকা ভাগোড়া'৷ দিল্লিবাসী যে কেজরিওয়ালকে মাথায় তুলে নেচেছিলেন তারাই আজ সেই পোস্টার দেখে বাঁকা হাসি হাসছেন৷ দিল্লির সেই দেয়াল লিখন পড়তে পারেননি প্রাক্তন আইআরএস নেতা অরবিন্দ কেজরিওয়াল৷ অর্থাৎ যেখান থেকে উদয়, সেখানেই অস্ত।
লোকসভা ভোটে দিল্লিতে ছিটেফোঁটা অস্তিত্বও টিকিয়ে রাখতে না পারায় দলের মধ্যে হতাশা তৈরি হলেও তাদের অবশ্য কিছুটা ভরসা দিয়েছে পাঞ্জাব। সেখানে ১৩টি লোকসভা আসনের মধ্যে ৪টিতে জয়ের মুখ দেখেছে আম আদমি পার্টি। গোটা দেশে ৪৪৩টি আসনে প্রার্থী দিলেও এবারের ভোটে আপের সাফল্য বলতে এইটুকুই।
জনলোকপাল বিল নিয়ে বিতর্কের জেরে মাত্র ৪৯ দিনের মাথায় মুখ্যমন্ত্রীর আসন থেকে ইস্তফা দিয়েছিলেন কেজরিওয়াল। তার পর থেকেই জনমানসে আম আদমি পার্টির বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠে যায়। দলের প্রথম সারির মুখ আশুতোষ, রাখি বিড়লা বা রাজমোহন গান্ধী প্রত্যেকেই আম আদমি পার্টির জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়েছেন।
বারানসিতে মোদী-ঝড়ের সামনে দাঁড়াতেই পারেননি কেজরিওয়াল। চণ্ডীগড়ে আপ প্রার্থী বলিউড অভিনেত্রী গুল পানাগের কাছ থেকেও অনেকটাই প্রত্যাশা ছিল দলের। তবে সেখানেও বিজেপি হাওয়ায় জয় ছিনিয়ে নিয়েছেন কিরণ খের।
আমেথিতে কুমার বিশ্বাস বলেছিলেন, তিনি জিতবেন। কিন্তু তার স্বপ্নে জল ঢেলে দিয়ে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হয়েছে কংগ্রেস সহ-সভাপতি রাহুল গান্ধী এবং বিজেপি প্রার্থী স্মৃতি ইরানির মধ্যে। দেশজুড়ে খারাপ ফলের মধ্যেও সেখানে শেষমেশ জিতেছেন রাহুলই।
আম আদমি পার্টির দিল্লির আশপাশে গুড়গাঁও, গৌতম বুদ্ধ নগর, গাজিয়াবাদ এবং ফরিদাবাদেও শুধুই হারের ছবি। গুড়গাঁওয়ে আপের অন্যতম মাথা যোগেন্দ্র যাদবও দাগ কাটতে পারেননি।
যোগেন্দ্র যাদব বলেন, দিল্লিতে আমরা কোনো আসন পাবো না ভাবিনি। আমেথি বা বারানসিতেও হারের ব্যবধান এতো বেশি হবে ভাবা যায়নি। কিন্তু এর মধ্যেই ইতিবাচক দিক খুঁজে পেয়েছেন তিনি। তার মন্তব্য, দলের প্রথম লোকসভা ভোটে দেশের প্রতিটি কোণে আমাদের উপস্থিতি জানান দিতে পেরেছি।
** বিরোধী দলের মর্যাদাও হারালো কংগ্রেস
বাংলাদেশ সময়: ১২২৭ ঘণ্টা, মে ১৭, ২০১৪