কলকাতাঃ রাত পোহালেই বিশ্বকাপের প্রথম খেলা খেলতে নামছে আর্জেন্টিনা, আর সেই উপলক্ষে কলকাতার প্রায় প্রতিটি পাড়ার চেহারা নিয়েছে ঠিক যেন বুইনোস আইরেস এর এক একটি রাস্তা। বঙ্গোপসাগর থেকে দক্ষিণ আটলান্টিকের উপকূলের যে দূরত্ব, ফুটবল দক্ষতার নিরিখে তার থেকেও বেশি দূরে অবস্থান করে বুইনোস আইরেস আর কলকাতা।
আর তার প্রমাণ মিলছে আর্জেন্টিনার প্রথম খেলা খেলতে নামার আগেই। পাড়ায় পাড়ায় আর্জেন্টিনার পতাকা। মেসির ছবি আর তাতে বীর পূজার মালা। রোববার কলকাতায় ছুটির দিন। তাই আর্জেন্টিনার প্রথম খেলা নিয়ে উৎসাহের মাত্রা অনেক বেশি।
দক্ষিণ কলকাতার বেশির ভাগ দখল করে নিয়েছে ব্রাজিলের সমর্থকরা। তবে উত্তরে প্রবলভাবে আছে আর্জেন্টিনা। আর রোববার দেখা গেল দক্ষিণের দখলও আর্জেন্টিনার হাতে। কোথাও কোথাও রীতিমত মঞ্চ বেঁধে অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছেন আর্জেন্টিনার ভক্তরা।
সাদা নীল পোশাকে চলছে নাচ, গান, হৌ-হুল্লোড়। আর এই উৎসব মেসি কেন্দ্রিক হলেও সব জায়গাতেই আজও প্রবলভাবে আছেন ফুটবলের রাজপুত্র ম্যারাডোনা।
এই খেলা দেখার প্রস্তুতি দেখে নেবার ফাঁকেই চা খেতে খেতে আলাপ হল প্রায় আশি ছুঁই ছুঁই এক আর্জেন্টিনা সমর্থকের সাথে। তরুণদের ভিড়ে তিনি যেন তারুণ্যের প্রতীক।
কে ভালো খেলোয়াড় মেসি নাকি ম্যারাডোনা? প্রশ্নটা করেই ফেললাম সেই আশি বছরের তরুণকে! তিনি বললেন, মেসি দক্ষ ফুটবলার এতে কোন সন্দেহ নেই। হয়ত একদিন রেকর্ডের বইয়ে ম্যারাডোনাকেও ছাপিয়ে যাবেন। কিন্তু ম্যারাডোনা শুধু দক্ষ ফুটবলার নন। দারিদ্র, প্রতিকূল অর্থনীতি, অসাম্যের শিকার আর কিছু না পাওয়া মানুষদের প্রতিবাদের প্রতিভূ।
কিন্তু কেন? আর্জেন্টিনার ভক্ত মানুষটি জানালেন, মেসি ফুটবল খেলেন বুদ্ধি দিয়ে, টেকনিক দিয়ে আর পরিশ্রম দিয়ে। কিন্তু ম্যারাডোনার এই সব কিছুর সঙ্গে ছিল আবেগ। যে আবেগ আর্জেন্টিনা ছাড়িয়ে গোটা বিশ্বের মানুষকে আজও ছুঁয়ে যায়।
কথা শেষ করে উঠতে যাবো, তিনি প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন, বলতে পারবেন মেসির জন্ম কোন শহরে। জানালাম আর্জেন্টিনার রোসারিও শহরে। আবার উড়ে এলো প্রশ্ন, আর এক জন মানুষের জন্ম ওই রোসারিও শহরে যিনি পশ্চিমবাংলার হৃদয়ের খুব কাছের মানুষ, বলতে পারবেন কে?
ফুটবল পছন্দের হলেও, কুইজে আমি চিরকালই দুর্বল। তাও আবার ভারতের আর আর্জেন্টিনার মধ্যে অবস্থান করছে আর এক মহাদেশ সুবিশাল আফ্রিকা। তারপর দক্ষিণ আটলান্টিক সাগর। যথারীতি মস্তিষ্কের স্মৃতি কোষগুলোতে বেশ কিছুটা চাপ দেবার পরেও কোন সূত্র হাজির হলো না।
মস্তিষ্কের ধুসর কোষগুলোয় তিনি একটু আলো দেখাবার চেষ্টা করলেন। আশির ওই যুবক বললেন, মেসির জন্মদিন আগামী ২৪ তারিখ। আর মেসির এই প্রতিবেশীর জন্মদিন গেল গতকাল, মানে শনিবার!
তার বলার ভঙ্গী মনে করিয়ে দিল সত্যজিৎ রায়ের সিধু জ্যাঠাকে। কিন্তু উলটো দিকে কোন ফেলুদা ছিলেন না। নিদেন পক্ষে কোন তোপসেও নয়। তাই উত্তর দিতে না পারার লাজুক হাসি মুখে লাগিয়ে রাখা ছাড়া কোন গতি ছিলনা।
মুচকি হেসে আর্জেন্টিনার সেই ভক্ত জানালেন, গতকাল ছিল যে বিখ্যাত আর্জেন্টাইন এর জন্মদিন, তিনি চে গুয়েভারা। তিনিও জন্মেছিলেন মেসির শহর রোসারিও-তে। আর তিনি যে পশ্চিমবাংলার মানুষের খুব প্রিয় আন্তর্জাতিক নেতা সেকথা বলার অপেক্ষা রাখে না। কি আশ্চর্য মিল দুই প্রজন্মের দুই খেলোয়াড়ের।
ভারতে এসে কোন এক অজানা কারণেই একটি অনুষ্ঠানে হঠাৎ করে উঠে দাঁড়িয়ে নিজের হাতে আঁকা চে –এর ট্যাটু দেখিয়েছিলেন ভারতীয় দর্শকদের। সঙ্গে দেখিয়েছিলেন তার ঐতিহাসিক বাঁ পায়ে ফিদেল কাস্ত্রো-এর ছবি। আর সেই চে-এর শহরেরই এক ফুটবলার ম্যারাডোনারা উত্তরসুরী হিসেবে উঠে এসেছেন।
মুখ দিয়ে অস্ফুটে বেড়িয়ে এলো, তাইতো! শনিবার ছিল চে গুয়েভারার জন্মদিন। ভদ্রলোক উচ্চারণ সঠিক করে দিয়ে জানালেন, ওটা ‘গুয়েভারা’ নয়, স্প্যানিস ভাষায় উচ্চারণটি হল “গেভরা”। আমারা সেটিকে বাঙালিকরণ করে ‘গুয়েভারা’ করে দিয়েছি।
তাই প্রিয় নেতা চে-এর শহরের ২৭ বছরের এক তরুণের সাফল্যের জন্য ভোরে উঠে গলা ফাটাবে কলকাতা। এতে আর অবাক হবার কি আছে!
বাংলাদেশ সময়: ১৮১৬ ঘণ্টা, জুন ১৫, ২০১৪