কলকাতা: গোটা মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে কলকাতাতেও পালিত হচ্ছে পবিত্র রমজান। এক মাস সিয়াম সাধনার পর পালিত হবে ঈদ।
কলকাতার সেহেরি, ইফতার, ঈদের কেনাকাটা প্রভৃতি পর্যবেক্ষণ করতে রাত-বিরাতে হেঁটেছি কলকাতা রাজপথের অলি-গলিতে। আজ পাঠকদের জন্য থাকছে কলকাতার সেহেরি নিয়ে বিশেষ আয়োজন। পরবর্তীতে থাকবে ইফতার, ঈদ কেনাকাটা।
গভীর রাতে যখন ঘুমে নিমগ্ন স্বপ্ননগরী, নিয়নের আলোয় তখন স্নান করে কলকাতার রাজপথ। ঘড়ির কাঁটায় ভারতীয় সময় তখন রাত ২টা।
কলকাতায় শুধু সেহেরির জন্য গোটা রাত খোলা থাকে বিভিন্ন এলাকার বেশ কিছু দোকানপাট। রমজানের একটি মাসের জন্য। বছরের বাকি সময় দৌড় ঝাঁপে ক্লান্ত হয়ে পড়া শহরের সঙ্গে বিশ্রাম নেয় এসব হোটেল, রেস্তরাঁর উনুনগুলিও।
কলকাতার বিভিন্ন প্রান্তের এসব হোটেল-রেস্তরাঁয় হাজির হন ছোট বড় নানা বয়সের মানুষ। তারা কেউ আসেন দল বেঁধে, কেউ আসেন একাই। কেউবা এই রেস্তরাঁগুলিতে বসেই সেহেরি সেরে নেন, কেউবা নিয়ে যান বাড়ির সবার জন্য।
ভিড় সামলাতে ব্যস্ত কর্মচারীরা, টেবিলে টেবিলে হাঁক-ডাক। কলকাতায় চলছে সেহেরি। জনসমাগম দেখলে মনে হতেই পারে আপনার হাত ঘড়িটি বুঝি তার হিসেবে কিছু গোলমাল করে বসেছে।
কিন্তু দোষ হাত ঘড়ির নয়। রেস্তরাঁর মালিক জানালেন, সেহেরি উপলক্ষে এক মাস ধরে প্রতিদিনই খোলা রাখেন।
কথা বলে জানা গেল, প্রতিদিন গড়ে এক-একটি দোকানে সেহেরি করতে ৮০ থেকে ১০০ জন মানুষ হাজির হন। এছাড়াও অনেকেই বাড়ির জন্য খাবার কিনে নিয়ে যান।
বিগত চার বছর ধরে শুধু সেহেরির জন্য গোটা রাত দোকান খোলা রাখা হচ্ছে বলে জানালেন দক্ষিণ কলকাতার এমনই একটি খাবার হোটেলের মালিক ফিরোজ হাকিম। মূলত তাদের ভোক্তাদের অনুরোধেই তিনি এই পরিসেবা চালু করেছিলেন।
কিন্তু বাড়ি ছেড়ে কেন রেস্তরাঁয় সেহেরি করতে আসা? প্রশ্ন করলে তরুণ সলমন জানান, একসঙ্গে বন্ধুদের সঙ্গে সেহেরি করার আনন্দ ভাগ করে নিতে প্রতিদিন এই রেস্তরাঁয় আসেন।
সবার সঙ্গে বসে সেহেরি করার আনন্দ তো আছেই, আরও কয়েকটি কারণও জানালেন পরিবারের সঙ্গে আসা রিয়াজ খান। তিনি জানান, বাড়িতে এ সময় খাবার বানানো বেশ সমস্যার আর ফ্রিজে রাখা খাবারের চেয়ে স্বাদে-গুণমানে রেস্তরাঁর টাটকা খাবার অনেক বেশি উপাদেয়। তাই তিনি সেহেরি করতে হাজির হয়েছেন রেস্তরাঁয়।
বিশেষ কী খাবার থাকছে সেহেরি উপলক্ষে জানতে চাইলে ফিরোজ জানান বিরিয়ানি, লাচ্ছা পরটা, পুরি সবই আছে মেন্যুতে। আছে মুরগির রোস্ট থেকে চপ, ভুনা, হালিমসহ নানা ধরনের মাংসের পদ। আর শেষ পাতে আছে বেশ কয়েক ধরনের হালুয়া।
তবে রমজানের একমাস তিনি রান্নায় কিছু বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করেন। যার মধ্যে প্রধান হলো, রান্নাকে যতটা সম্ভব গুরুপাক না করে তোলা। বাবুর্চিদের তার কড়া নির্দেশ থাকে রোজার সময় বিশেষ সতর্ক হয়ে খাবার বানানোর।
সেহেরিতে চাহিদা আছে ফিরনি, লস্যি, লাচ্ছা আর মিষ্টি দইয়ের। এরকম একটি দোকানে গিয়ে দেখা গেল বিরাট কড়াইতে দুধ জ্বাল দেওয়া হচ্ছে। দোকানের ভেতরের সবকটি টেবিল পরিপূর্ণ। তাই বাইরেও লাইন পড়েছে ফিরনি আর লস্যির জন্য।
সেখানেই দেখা এক কলকাতার পরিচিত মিডিয়াকর্মীর সঙ্গে। তিনিও বন্ধুদের সঙ্গে খাবারের টেবিলে হাজির। জানালেন রমজানের একমাস বন্ধুদের সঙ্গেই খাবার খান। ব্যক্তিগত পরিচয় থাকায় জানা ছিল তিনি ধর্মে হিন্দু।
তবে এ ঘটনা ব্যতিক্রম ভাবলে ভুল হবে। কলকাতায় হিন্দু-মুসলিম একসঙ্গে সেহেরি করার নিদর্শন পাওয়া গেল বেশ কিছু জায়গায়।
দূরে মসজিদের মাইকে ভেসে এলো সেহেরির সময় প্রায় অতিক্রান্ত। ধীরে ধীরে ফাঁকা হয়ে গেল দোকানগুলি। কলকাতার আকাশে আড়ামোড়া ভেঙে সবে পূবের দরজা খুলছে সূর্য।
ভেসে এলো ফজরের নামাজের আজানের সুর। বিদায় নিলাম আমার পূর্ব পরিচিত বন্ধুর কাছ থেকে। কলকাতায় ধীরে ধীরে জন্ম নিচ্ছে নতুন একটা দিনের। যে দিনের সুরটা বেঁধে দিল কলকাতার চিরপরিচিত ছন্দ।
বাংলাদেশ সময়: ১৬১৮ ঘণ্টা, জুলাই ১২, ২০১৪