কলকাতা: জনপ্রতিনিধি হওয়ার পর প্রথম সিনেমার মাধ্যমে ভক্তদের সামনে এলেন দেব। অবশ্য শুটিং অনেক আগের।
এর আগে যেসব তারকারা ভোটের ময়দানে এসেছেন তারা বেশির ভাগই হয় অবসর নিয়েছেন নয়তো খুব কম কাজ করেন। আর যতটুকু ছিল রাজনীতিতে পা দেওয়া মাত্রই শেষ হয়ে গিয়েছে।
এটা শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয় ভারতের রাজনীতিতেও এর প্রমাণ স্বয়ং অমিতাভ বচ্চন, হেমা মালিনী থেকে গোবিন্দসহ অনেকেই।
তবে দেব যখন রাজনীতিতে এলেন তখন তিনি সাফল্যের মধ্য গগনে! তবে রাজনীতিতে কেন? সিনেমায় তো মধ্যবিত্ত আর কেটে খাওয়াদের পক্ষে কথা বলে জায়গা করে নিয়েছেন এপার-ওপার দুই বাংলার কোটি দর্শক-ভক্তের।
তবে কী এবার রূপালি জগতের নায়ক রাজনীতির গ্লামারের হিসাব-নিকাশ না বুঝেই এই মঞ্চে প্রবেশ করেছেন? ঠিক যেমন ‘বুনোহাঁস’-এর অমল তার সাদামাটা জীবন থেকে জটিল একটা পথকে বেছে নিতে বাধ্য হয়।
‘বুনোহাঁস’-ছবিটি দেখে বের হয়ে বার বার এই প্রশ্নটাই মনে আসছিল! আগামী দিনে দেব কী রাজনীতির ময়দানে তরুণ নেতা কনে যাবেন নাকি রূপালি পর্দার স্বপ্নের জগতেই থাকবেন। নাকি দুই ময়দানেই ‘বুনোহাঁস’ হয়ে উঁড়ে বেড়াবেন দেব। এর জন্য চোখ রাখতে হবে ভবিষ্যতের ‘পর্দায়’।
এবার আসি ‘বুনোহাঁসে’। দেশ ভাগের যন্ত্রণায়,দেশ ভাগের পর পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতে চলে আসা উদ্বাস্তুদের জীবন নিয়ে বেশ কিছু চলচ্চিত্র নির্মাণ হয়েছে দুই বাংলায়।
সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র বুনোহাঁস –এর গল্পের মূল বিষয় কোনো ভাবেই দেশভাগ না হলেও চলচ্চিত্রের প্রতিটি ঘটনার সঙ্গে মিশে আছে ১৯৪৭ এর পূর্ব-পাকিস্তান, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ থেকে শুরু করে আজকের পুরান ঢাকা,গুলশান, চট্টগ্রাম, কাওরান বাজার সব কিছুই।
অনিরুদ্ধ রায় চৌধুরী পরিচালিত ‘বুনোহাঁস’ প্রতি মুহূর্তে এসব মানুষকে ফেলে আসা জন্মভূমির স্মৃতিগুলো যে নস্টালজিয়া করে তা এবং বর্তমান বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক বিষয়গুলো ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
প্রথিতযশা সাহিত্যিক সমরেশ মজুমদারের গল্প অবলম্বনে এই ছবিতে অভিনয় করেছেন দেব, শ্রাবন্তী, তনুশ্রী ও মুনমুন সেন প্রমুখ।
পশ্চিমবঙ্গে বিশেষ করে কলকাতায় যেসব বাঙালি বাস করছেন তারা কখনও বাংলাদেশে ছিলেন না, তাদের বেশির ভাগই পা রাখেননি বাংলাদেশে।
অনেকের কাছে বাংলাদেশ মানে ছেলেবেলায় ঘুমিয়ে পড়ার আগে দিদিমা, ঠাকুমার মুখে এক নদীমাতৃক শস্য-শ্যামলা একটি দেশ। এরা দেশ ভাগের পর পশ্চিমবঙ্গে চলে আসা উদ্বাস্তুদের তৃতীয় প্রজন্ম।
এরা শাহবাগ আন্দোলনে আন্দোলিত হয়, সুযোগ পেলে মুক্তিযুদ্ধের ছবি দেখতে ভিড় জমায়, এরা ছাত্র অবস্থায় কলকাতার ইস্ট বেঙ্গল মাঠে বাংলাদেশের ফুটবল খেলোয়াড় মুন্না-এর খেলার স্মৃতি আঁকড়ে ধরে পিতা –পিতামহের জন্মভূমিকে স্মরণ করে। এরা কলকাতা নাইট রাইর্ডাসের (কেকেআর) খেলায় সাকিব আল হাসানের জন্য গলা ফাটায়।
এরা কেউ কলকাতার আই টি কোম্পানিতে কাজ করে, কেউ শিক্ষক, কেউ অন্য কিছু আবার কেউবা সিনেমার নায়ক দেবের মতো শপিং মলের প্রতিরক্ষা কর্মী হয়ে বেঁচে থাকার লড়াই করছেন। আজও তাদের হৃদয়ে বাংলাদেশের স্মৃতি বইছে।
বুনোহাঁসদের মতোই গল্পের মূল চরিত্ররা ভেসে বেড়ায়। উড়ে বেড়ায় এক দেশ থেকে অন্য দেশ। স্থির থাকা এদের ধর্ম নয়। যেন হারিয়ে যাওয়া কোনো অতীতকে খুঁজতে ছুটে চলে এরা পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে।
চলচ্চিত্রে নায়ক অমলের চরিত্রে অভিনয় করেছেন দেব। যার বাবা মৃত্যুর আগে তার স্ত্রীকে বলে গিয়েছিলেন পারলে ছেলে যেন জীবনে অন্তত একবার বাংলাদেশের মাটি মাথায় লাগায়।
এখানে ভীষণভাবে বাস্তবকে ছুঁয়ে গেছেন পরিচালক। আজও কলকাতায় এই শেয ইচ্ছা রেখে অনেকেই পাড়ি জমান না ফেরার দেশে।
শপিং মলে চাকরি করে বিধবা মায়ের ছোট ছেলে অমল। তার নুন আনতে পান্তা ফুরনো পরিবার আর তার প্রেমিকার চিকিৎসার টাকা জোগাড় করতে গিয়ে জড়িয়ে পড়ে পাচারকারী দলের সঙ্গে।
যদিও মূল উপন্যাসের শুরুতেই জানা যায় অমলের বাবা ছিলেন ডাক্তার। আর তিনি বেঁচেও আছেন।
নায়ক বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখে তবে তার বাবার শেষ ইচ্ছাকে শুধু মর্যাদা জানাতে নয়, কারণ ততক্ষণে সে চোরাচালান দলের সদস্য। সে হাজির তার গোপন উদ্দেশে। তার চোখের সামনে ধরা পড়ে আজকের বাংলাদেশ।
চলচ্চিত্রের বেশির ভাগ অংশের চিত্রগ্রহণ করা হয়েছে ‘রিয়েল লোকেশনে’। এরজন্য অবশ্যই ধন্যবাদ দিতে হয় পরিচালককে।
অভিনয়ে নিজেকে ভেঙেছেন দেব। তার এই প্রচেষ্টা দেখা প্রথম গিয়েছিল ‘চাঁদের পাহাড়’ চলচ্চিত্রে। কিন্তু ‘বুনোহাঁস’ ছবিতে তিনি আগের থেকে অনেক বেশি পরিণতির প্রমাণ রাখলেন।
বাকি অভিনেতা- অভিনেত্রীরা তাদের চরিত্রের সঙ্গে সুবিচার করেছেন। তবে দারিদ্র্য পরিবারের ছেলে অমলের চরিত্রে দেবের নায়কোচিত ‘গ্ল্যামার’ কমানো হলেও তার পেশিবহুল বিরাট চেহারা অনেক ক্ষেত্রেই বেমানান।
একারণেই পরিচালক কিছু ব্যায়ামের দৃশ্য রেখেছেন। কিন্তু দেবের পেশিবহুল চেহারা বজায় রাখতে যেটা দরকার সেটা তার মতো গরিব পরিবারের ছেলের পক্ষে জোগাড় করা বাস্তবে অসম্ভব।
উপন্যাসে পুলিশের কাছে ধরা দেয় অমল কিন্তু চলচ্চিত্রে তার পরিণতি ভিন্ন। তবে সেটা উপন্যাসের মূল ধারাকে নষ্ট না করেই।
কিছুটা গতিশীল হতে পারত চিত্রনাট্য। তবে গানের কথা হৃদয়কে ছুঁয়ে যায়। সেই কাজে কবি শ্রীজাত, অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায় এবং চন্দ্রিল তাদের দায়িত্বটি যথার্থ ভাবে পালন করেছেন।
ইচ্ছে করেই গল্পটি ভেঙে বললাম না। সুযোগ পেলে দেখে নিতে পারেন সিনেমাটি আর এই মুহূর্তে সেই সুযোগ পাওয়া না গেলে পড়ে ফেলতে পারেন ‘বুনোহাঁস’ উপন্যাসটি। আশা করি ভালো লাগবে।
বাংলাদেশ সময়: ১৯৪৭ ঘণ্টা, আগস্ট ২৮, ২০১৪