কলকাতাঃ পরপর বেশ কয়েকটি ঘটনায় পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির উত্তাপ বেশ কিছুটা বেড়ে গিয়েছে। সাম্প্রতিক নানা ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে পশ্চিমবঙ্গ শুধু ভারতের রাজনৈতিক মহলেই নয়, বিশ্বের অন্যান্য দেশের রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদেরও আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে ।
শুধু আলোচনার বিষয় বললে কিছুটা কম বলা হয়, পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে ভারতের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার মত বিষয় থেকে শুরু করে বৈদেশিক সম্পর্কের মত বিষয়গুলিও।
বারবার উঠে আসছে তিস্তা চুক্তি, অনুপ্রবেশ, ছিট মহল, জে এম বি এই ধরনের নানা ইস্যু।
অনেকেই মনে করছেন সাম্প্রতিক কিছু ঘটনার ফলে সঙ্কটে পড়েছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। শুধু তাই নয় বিশ্বমঞ্চে এই কারণে বেশ কিছু প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হচ্ছে ভারতের কূটনীতিকদেরও।
উঠে আসছে জে এম বি থেকে বাংলাদেশের নির্বাচন-পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী হিংসার অন্যতম কারিগর জে এম বি-এর সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের কিছু রাজনৈতিক ব্যক্তির যোগসাজশের কথা। আলাদাভাবে তদন্ত করছে বাংলাদেশ সরকার এবং ভারত সরকার।
সুত্রের খবর বেশ কিছুদিন আগেই ২৭৩ জন সন্দেহভাজনের নাম জানিয়ে চিঠি পাঠিয়ে ছিল বাংলাদেশ সরকার। সেই চিঠির কথা পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অজানা ছিল না। তবে কেন কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি? নাকি সেই চিঠির গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারেনি পশ্চিমবঙ্গের প্রশাসন। হয়তো সঠিক সময়ে ব্যবস্থা নিলে জঙ্গি জাল এতটা বিস্তৃত হতো না।
প্রশ্ন উঠছে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুখে এক দিকে বাংলাদেশের প্রতি তার ভালবাসার কথা বলেন, অন্যদিকে তিস্তা চুক্তির বিরোধিতায় সোচ্চার হন। একদিকে তৃণমূলের এক রাজ্যসভার সাংসদের জামাত যোগের প্রসঙ্গের সাথে সাথে প্রশ্ন উঠেছে পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে বর্ধমান-বিস্ফোরণে জে এম বি সংশ্লিষ্টতার প্রত্যক্ষ প্রমাণ নিয়ে।
তবে এই ঘটনাগুলির প্রভাব সম্পর্কে আলোচনা করতে গেলে খুব ভালভাবে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির ইতিহাসের দিকে নজর দেওয়া যেতে পারে।
যে কোনো একটি অঞ্চলের ইতিহাসের উপর অনেকাংশে নির্ভর করে সেই অঞ্চলের সমসাময়িক রাজনীতি।
১৯৪৭ সালের ভারতের স্বাধীনতালাভের সঙ্গে সঙ্গেই হাজির হয় দেশভাগের মত একটি বড় সমস্যা। ভারতের দুটি রাজ্য পাঞ্জাব এবং পশ্চিমবঙ্গ দেশভাগের ফলে সব থেকে বেশি প্রভাবিত হয়েছে।
কিন্তু লক্ষ করলে দেখা যাবে, পাঞ্জাব এবং পশ্চিমবঙ্গের জমির চরিত্রগত বেশ কিছুটা মিল থাকলেও অর্থনীতি এবং রাজনীতির চরিত্রগত অমিল অনেক বেশি।
এর একটা কারণ অবশ্যই দেশভাগের সঙ্গে সঙ্গে সম্পত্তির বিনিময়। যেভাবে দূরদৃষ্টি বজায় রেখে সম্পত্তির বিনিময় হয়েছিল পাঞ্জাবে ঠিক সেইভাবে পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে করা সম্ভব হয়নি। যদিও এর অনেক বাস্তব কারণ ছিল। তবে সেই বিস্তারিত আলোচনায় না গিয়ে আমরা লক্ষ করি এই সময় থেকেই পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির চরিত্রের দিকে। যেটা আলোচনা না করলে বর্তমান সমস্যাগুলিও সঠিক ভাবে বোঝা যাবে না।
পশ্চিমবঙ্গে দীর্ঘ ৩৫ বছর একটি বামপন্থী সরকার ক্ষমতায় ছিল। কিন্তু তার আগে পঞ্চাশের দশকে যখন কোনো বামপন্থী সরকারের পশ্চিমবঙ্গে শাসন ক্ষমতায় আসার কথা ভাবাই যেত না, সেই সময় থেকেই কিছুটা ভিন্ন চরিত্রের সন্ধান পাওয়া যায় পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে।
আর তার ফলেই ষাটের দশকের শেষ দিক থেকে ৭০ দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গে চলতে থাকে নকশাল আন্দোলন। এরই মাঝে ঘটে যায় দুটি খুব গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।
এই দুটি ঘটনা পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে খুবই প্রভাব বিস্তার করে। এর মধ্যে একটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা, অন্যটি ১৯৭৫-১৯৭৭ সালে পশ্চিমবঙ্গে জরুরি অবস্থা। এর সঙ্গে প্রভাব পড়েছিল পুর্ববাংলা থেকে আশা মানুষদের উপস্থিতির।
বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকেই ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কটি বন্ধুত্বের। বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের সাথে সাংস্কৃতিক মিলের ফলে আরও গভীর হয়েছে দুই বাঙলার সম্পর্ক।
ষাটের দশকে বাংলাদেশে যখন চলছে স্বাধীনতার লড়াই, ঠিক সেই সময়ে পশ্চিমবঙ্গে চলছে নকশাল আন্দোলন। সমাজ বিজ্ঞানীরা বলেন কোনো আন্দোলনের সফলতা বা অসফলতা দিয়ে সেই আন্দোলনের ভবিষ্যৎ প্রভাব বিচার করা যায় না। এই সূত্রকেই মাথায় রেখে বলা যায়, ষাটের দশকের নকশাল আন্দোলন আক্ষরিক অর্থে সফল না হলেও পশ্চিমবঙ্গের মানুষের চেতনায় বামপন্থার একটা ধারা রোপণ করতে অবশ্যই সফল হয়েছিল।
সেই থেকে আজও বামপন্থার সেই ধারাকেই সামনে রেখে রাজ্য চালাচ্ছেন পশ্চিমবঙ্গের সরকার। কেউ যদি মনে করেন বামফ্রন্টকে সরিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে কোনো দক্ষিণপন্থি সরকার পশ্চিমবঙ্গে এসেছে, তবে তিনি ভুল করবেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়-সরকারের যে ছবি তুলে ধরা হয় সেটি বামপন্থার একটি আংশিক ব্যাবহারিক চেহারা।
যেখানে নীতির ক্ষেত্রে সহজেই দক্ষিণপন্থাকে গ্রহণ করা হলেও সরকারের বাহ্যিক চেহারাটি বামপন্থী। আর এই কারণেই পশ্চিমবঙ্গে শিল্পের জন্য জমিনীতি থেকে শুরু করে স্পেশাল ইকোনমিক জোন (সেজ) নীতি নিয়ে যথেষ্ট অখুশি পশ্চিমবঙ্গের তথা ভারতের বাণিজ্যমহল।
তবে এর শুরু সেই ৬০-এর দশকেই। অনেকেই বলেন, আজকের গুজরাটের শিল্পের শহর সুরাট-এর উন্নতির অনেকটাই ৬০ থেকে ৭০ এর দশকে এবং পরবর্তী সময় পশ্চিমবঙ্গের কারখানাগুলির অভ্যন্তরে জঙ্গি আন্দোলনের উপহার।
এই আন্দোলনের ফলেই এক এক করে কারখানা পশ্চিমবঙ্গ থেকে গুজরাটে চলে যায়। তার বেশির ভাগই যায় শিল্পনগর সুরাটে।
তবে এই ধরনের একটি আন্দোলনের পথ ধরেই পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে নিজের জায়গা তৈরি করেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। জাতীয় কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে নিজের দল তৃণমূল কংগ্রেস গঠন করেন তিনি। ধীরে ধীরে কংগ্রেস ভেঙে আসা তাবড় নেতাদের পিছনে ফেলে তৃণমূল কংগ্রেসের সর্বেসর্বা হয়ে ওঠেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
২০০৬ সালে ২৩৫ টি আসন জিতে ক্ষমতায় আসে বামফ্রন্ট। আর উপহার হিসেবে রাজ্যবাসীকে মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য জানান টাটা গোষ্ঠীর পশ্চিমবঙ্গে গাড়ি করখানা করার ইচ্ছার কথা।
কারখানা করতে লাগবে জমি আর সেই জমি অধিগ্রহণ নিয়েই শুরু হয় আন্দোলন। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ভেবেছিলেন ২৩৫টি আসন পাওয়া সি পি এম-এর সঙ্গে মানুষ রয়েছেন। কিন্তু আন্দোলনের রাশ নিজের হাতে তুলে নেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে নন্দিগ্রাম, সিঙ্গুর, কাটোয়া থেকে নয়াচর।
আর একের পর এক আন্দোলনের ঝাঁজে বেসামাল হয়ে যায় তৎকালীন বাম সরকার। আর ক্ষমতার অলিন্দে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়া বাম নেতাকর্মীরাও তখন আন্দোলন-সংগ্রাম থেকে অনেক অনেক দূরে।
এই সময় থেকে এক নতুন ধরনের প্রচার কৌশল দেখা যায় তৃণমূল কংগ্রেসের তরফে। দক্ষিণ ভারতে এমনটা দেখা গেলেও পশ্চিমবঙ্গে ছিল নতুন।
তারা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে তুলে ধরতে থাকে ‘সততার প্রতীক” হিসেবে। প্রচারে খরচ হয় কোটি কোটি রুপি। রাস্তায় রাস্তায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরাট বিরাট কাট আউট আর তার নীচে বড়বড় হরফে লেখা ‘সততার প্রতীক’।
সেই সময় রেল দপ্তরের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। রেলের প্রচারেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবি। তবে তত দিনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তার নামের আগে ডক্টরেট ডিগ্রিটি লাগান বন্ধ করে দিয়েছেন।
একটা সময় ছিল যখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তার ডক্টরেট ডিগ্রিটি ব্যবহার করতেন। কিন্তু তার এই ডক্টরেট ডিগ্রিটি নিয়ে প্রথম প্রশ্ন তোলেন প্রয়াত সি পি এম নেতা বিপ্লব দাসগুপ্ত।
তিনি বলেন যে ‘ইস্ট জর্জিয়া ইউনিভার্সিটি’ থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ডক্টরেট ডিগ্রিটি লাভ করেছিলেন সেটির কোনো অস্তিত্ব নেই।
এটাই ছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে প্রথম অসততার অভিযোগ। তবে ‘সততার প্রতীক’ বলে দেওয়া বিজ্ঞাপনের বহরে সেই অভিযোগের কথা ভুলে গিয়েছিল পশ্চিমবঙ্গের মানুষ। তখন তিনি বাঙলার ‘অগ্নিকন্যা’।
অপর দিকে দিকে বামফ্রন্টের এক শ্রেণির নেতা কর্মীর মৌরসি পাট্টার থেকে মুক্তি পেতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেই বেছে নিলেন পশ্চিমবঙ্গের মানুষ।
পশ্চিমবঙ্গ রাজনীতির ইতিহাসের দিকে যদি আরও একটু নজর রাখি তাহলে দেখতে পাব, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীদের মধ্যে ধারাবাহিক ভাবে এসেছেন প্রফুল্ল চন্দ্র ঘোষ, বিধান চন্দ্র রায়, প্রফুল্ল সেন, অজয় মুখোপাধ্যায়, সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়, জ্যোতি বসু, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
এর মধ্যে একমাত্র মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেই ‘ব্রান্ড’ হিসেবে তুলে ধরতে বিপুল প্রচার করা হয়েছিল।
কিন্তু ক্ষমতায় এসেও বিরোধী দল নেত্রীর ‘ইমেজ’ ছেড়ে বেরোতে পারলেন না মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, এটা অভিযোগ করেন অনেকেই।
কিন্তু প্রশ্ন রাজ্যের উন্নয়নের পক্ষে বিরোধী দল নেত্রীর ভূমিকাও কি সঠিক ভাবে পালন করতে পেরেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়? পারলে আজকে টাটা কোম্পানির ন্যানো গাড়ির কারখানা অন্য রাজ্যে চলে যেত না।
বিরোধী দল নেত্রীর ভূমিকা পালন করতে পারলে সিঙ্গুরের হাজার একর জমি জঙ্গল হয়ে পড়ে থাকত না। কারণ একথা পশ্চিমবঙ্গের বেশির ভাগ মানুষই মনে করেন সিঙ্গুর থেকে টাটাদের চলে যাওয়া পশ্চিমবঙ্গে শিল্পের ভাবমূর্তির জন্য যথেষ্ট খারাপ।
তাছাড়াও ভারতের সংবিধান হাতে নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা ভাংচুর করার সঙ্গে নিজের নাম জড়িয়ে ফেলার মত ঘটনাতে বিরোধীরা তার গণতন্ত্রের প্রতি আস্থা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন।
তবে তৃণমূল কংগ্রেস দলে তার কর্তৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলার কেউ নেই। কারণ দলের মাথা থেকে পা, সকলেই স্বীকার করেন তিনিই সেখানে শেষ কথা। ছেড়ে বেরিয়ে এসেছেন বেশ কিছু নেতা সাংসদ ও বিধায়ক। তবে এর ফলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলের বিশেষ কোনো ক্ষতি হয়নি। তার প্রমাণ ভোটের ফলাফল।
এর পরবর্তী সময় ধীরে ধীরে অভিযোগের তীর সামনে আসতে থাকে যা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সততার ভাবমূর্তিকে আঘাত করতে লাগল। প্রশ্ন উঠতে লাগল সারদা কেলেঙ্কারিতে তৃণমূল নেতাদের জড়িত থাকা নিয়ে। তবে সরকারের বছর ঘুরতে না ঘুরতেই তিনি ঘোষণা করে দিয়েছিলেন সরকারের ৯৯ শতাংশ কাজ করা হয়ে গিয়েছে।
গ্রেপ্তার হলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এক সময়ের ঘনিষ্ঠ তৃণমূল রাজ্য সভার সাংসদ কুণাল ঘোষ।
সারদা কেলেঙ্কারির সি বি আই তদন্ত আটকাতে কোটি কোটি রুপি খরচ করে মামলা করলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু ভারতের সুপ্রিম কোর্ট তার কোনো আবেদনই মানলেন না।
কিন্তু কেন সরকারের কোটি কোটি রুপি খরচ করে তদন্ত আটকাতে চেষ্টা করলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়? তবে কি তার সততার প্রতীকে দাগ লাগার ভয় ছিল? সূত্রের খবরে প্রকাশ, রাজ্যসভায় তৃণমূল কংগ্রেসের সাংসদ মোহম্মদ হাসান ইমরান-এর মাধ্যমে অর্থ পাচার হয়েছিল বাংলাদেশে।
খবরে প্রকাশ, সেই অর্থ ব্যবহার করে শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করেছিল বাংলাদেশের নিষিদ্ধ সংগঠন জে এম বি।
একথাও শোনা যাচ্ছে সারদা গোষ্ঠীর টাকা ব্যবহার করা হয়েছিল প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশে উত্তেজনা ছড়াতে। যে উত্তেজনায় প্রাণ গিয়েছিল বাংলাদেশের বহু নিরীহ মানুষের।
প্রশ্ন উঠছে, জামাতের উদ্দেশ্য ছিল শেখ হাসিনা সরকারকে বিপর্যস্ত করে তোলা। আর তাদের সঙ্গেই যোগাযোগের কথায় উঠে আসছে তৃণমূল কংগ্রেসের সাংসদ হাসান ইমরানের নাম। অনেক মহল থেকেই দাবি করা হচ্ছে, জে এম বি–এর সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ রয়েছে বেশ কিছু আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠনেরও।
তবে কি এই সব যোগাযোগের তরফেই কোনো চাপ ছিল তিস্তা চুক্তির বিরোধিতা করার? যে কারণে প্রথমে ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং-এর সঙ্গে বাংলাদেশ সফরের প্রস্তাবে সায় দিয়েও শেষ মুহূর্তে সরে আসেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়?
প্রশ্ন থেকে যায়, তবে কি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে কেউ বাধ্য করেছিল?
যেখানে পশ্চিমবঙ্গের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী প্রয়াত জ্যোতি বসু থেকে শুরু করে পরবর্তী বাম নেতৃত্ব তিস্তা চুক্তি নিয়ে অনেকটাই উৎসাহী ছিলেন সেখানে কি কোনো বিশেষ গোষ্ঠীর প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে বিরোধিতা করলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়? ‘এই প্রশ্ন ওঠা একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক’ বলে উড়িয়ে দেওয়া বেশ কঠিন!
যদিও তিনি বলেছেন পশ্চিমবঙ্গের উত্তর দিকের নদীগুলি এর ফলে শুকিয়ে যাবে। সত্যি কি তাই? তবে কেন আজও নদী বিশেষজ্ঞ কল্যাণ রুদ্র কমিটির প্রতিবেদন প্রকাশ করা হলো না?
যেখানে ভারত সরকার প্রতিবেশী দেশগুলির সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখার বিষয়টিতে যথেষ্ট গুরুত্ব দিচ্ছেন সেখানে কেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিষয়টি নিয়ে ভারত সরকারের উলটো পথে হাঁটছেন?
এর পরেই বর্ধমানে বোমা বিস্ফোরণ। বর্ধমান বিস্ফোরণের এন আই এ তদন্ত নিয়ে সরাসরি বিরোধিতা করে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। যদিও এই বিরোধিতাকে গুরুত্ব না দিয়ে তদন্ত ভার গ্রহণ করে এন আই এ। প্রাথমিক তদন্তের পর সরকারিভাবে এন আই এ ঘোষণা করে বাংলাদেশে অশান্তি ছড়াতে পশ্চিমবঙ্গে বোমা কারখানা বানিয়েছিল জে এম বি মদতপুষ্টরা।
প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে যখন জঙ্গি কার্যকলাপের বিষয়টি সামনে এসে গেছে তখন কেন এন আই এ তদন্তে আপত্তি করেছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পরিচালিত সরকার?
তবে কি সততার প্রতীক বলে বিজ্ঞাপন, তিস্তা চুক্তির বিরোধিতা, সারদা কাণ্ডের কেন্ত্রীয় সংস্থা সি বি আই-এর বিরোধিতা এবং বর্ধমান-বিস্ফোরণে এন আই এ তদন্তের বিরোধিতার মধ্যে কোনো একটি অদৃশ্য যোগ আছে। অন্তত বিরোধী শিবির সুযোগ পেলেই এই প্রশ্ন তুলছে।
মমতা বন্দোপাধায়ের সরকারের মন্ত্রীরা অনেকেই বলছেন জঙ্গি যোগ নিয়ে একটি সম্প্রদায়কে চিহ্নিত করছে বিরোধীরা। এই অভিযোগের মূল লক্ষ বিজেপি।
একথা সকলেই স্বীকার করে সন্ত্রাসবাদের কোনো ধর্ম হয় না। ধর্মকে ব্যবহার করে মৌলবাদীরা সস্ত্রাসের ব্যবসা করে। আর এই ব্যবসায়ে বলি হয় নিরীহ মানুষ।
কিন্তু মুখে সংখ্যালঘুদের কথা বললেও পশ্চিমবঙ্গে ইমামভাতা এবং মোয়াজ্জেম ভাতা চালু করার চেষ্টার মত কিছু চমক ছাড়া বিশেষ কিছু করেনি মমতা বন্দোপাধায়ের সরকার, এমন অভিযোগ সংখালঘু সম্প্রদায়ের অনেকেরই।
ইফতার পার্টিতে তাকে নিয়মিত দেখা গেলেও সখ্যালঘুদের বাস্তবমুখি উন্নয়নের যথেষ্ট ঘাটতি আছে বলে মত সঙ্খ্যালঘু সমাজের একটি রড় অংশের।
নতুন ১০ হাজার মাদ্রাসার সরকারি অনুমোদন দেওয়া হয়েছে বলে জানান হলেও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মতে বাম আমলে যে ৫ হাজার মাদ্রাসার সরকারি অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল তার পর আর কোনো মাদ্রাসাকে অনুমোদন দেওয়া হয়নি।
অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, মমতার ব্রান্ড ‘সততা’ কি ক্ষমতায় আসার কৌশল মাত্র? তবে কি তার প্রতিবাদী চরিত্র শুধুই বিজ্ঞাপনের কৌশল। নাহলে কেন শিক্ষাক্ষেত্রে দলীয় রাজনীতি, উপাচার্য নিয়োগে দলের নিয়ন্ত্রণ, টেট দুর্নীতি, রাতের অন্ধকারে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের লাঠিপেটা করা দেখেও ‘ভাবলেশহীন” থাকেন মুখ্যমন্ত্রী!
কিংবা ‘পার্ক স্টিট ধর্ষণ’কাণ্ড নিয়ে প্রশ্ন করা হলে কেনই বা তিনি বলেন এটি ‘ছোট্ট ঘটনা’!
কেন রাজ্যে জঙ্গি-যোগের বিস্ফোরণ হবার পর ১১টি দিন লাগল তার মুখ খুলতে? কেন যখন সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলার পরে কবি শঙ্খ ঘোষকে যখন তৃণমূল সমর্থকরা গাল পাড়ছে তখনো চুপ পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
তিনি শিল্পী । তিনি ছবি আঁকেন। তিনি তার দলের ভোটের ম্যানিফেস্টোতে দাবি করেন স্বচ্ছ নির্বাচনের। তিনি বলে,ন ছবি বিক্রি করে তিনি ভোটের খরচ তুলেছেন।
কিন্তু যখন বিরোধীদল, মিডিয়া তার ছবির ক্রেতাদের নাম জানতে চায়। যখন রাজ্যের মানুষ জানতে চায় সারদা কেলেঙ্কারির নায়ক সুদীপ্ত সেন তার ছবি কিনেছেন কিনা, তখন তিনি নিশ্চুপ থাকেন।
তাহলে তার ‘সততার প্রতীক’ ইমেজে কালি লাগা নিয়ে তিনি আদৌ চিন্তিত নন। নাকি তিনি মনে করছেন আসলে ক্ষমতায় টিকে থাকাটাই সব। আর তার আসল চাবিকাঠি ভোটে জেতা।
বাম আমলের শেষের দিকে বাম দলগুলি শুধুমাত্র ভোট কেন্দ্রিক রাজনীতিতেই ব্যস্ত ছিল বলে অভিযোগ। অনেকে মনে করেন বাম সরকারের পতনের অন্যতম কারণ এইটি।
নাকি তাকে চাপে রাখছে এমন কোনো শক্তি যাদের অঙ্গুলি হেলনেই তিনি তিস্তা চুক্তি, ছিট মহল সমস্যা, বর্ধমান বিস্ফোরণে জামায়াত-যোগ নিয়ে নিশ্চুপ থাকছেন।
তবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আশা করি জানেন, যে সম্মান যে ভালবাসা দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ তাকে তাদের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে বরণ করে নিয়েছিল, তার লড়াই তার সংগ্রাম গোটা বিশ্বে যেভাবে সমাদৃত হয়েছিল সেই ভাবমূর্তি অনেকটাই কলুষিত তার কিছু পার্ষদ এবং তার বেশ কিছু পদক্ষেপের জন্যে।
তাকে মনে রাখতে হবে, অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহ্য করে তাদের দুই জনেরই অপরাধের পার্থক্য সামান্যই।
ভারতের রাজনীতির ইতিহাসে প্রতিবাদী চরিত্র হিসেবে তিনি যে জায়গা করে নিয়েছিলেন সেই জায়গা তিনি ধরে রাখবেন কিনা সেটা তাকেই ঠিক করতে হবে। তাকেই ঠিক করতে হবে প্রতিবেশী দেশ সম্পর্কে তিনি কি অবস্থান নেবেন। তার কাজের নিরিখেই তাকে মনে রাখবে ইতিহাস, তাকে বিশ্লেষণ করবে ভবিষ্যৎ।
বাংলাদেশ সময়: ১২৫০ ঘণ্টা, অক্টোবর ৩০, ২০১৪