কলকাতা থেকে: বামবিরোধী মনোভাবের ভোটারদের সমর্থন পেয়ে বিপুল বিজয় নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে জয়লাভের পর মমতা ব্যানার্জির সামনের দায়িত্বগুলো নিয়ে এরই মধ্যে শুরু হয়েছে আলোচনা। কমিউনিস্ট সরকারের শাসনের উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রক্ষার পাশাপাশি মমতার সামনে আসছে বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের গ্রহণের নতুন চ্যালেঞ্জ।
নির্বাচনের ফল ঘোষণার পরদিন কালীঘাটে তৃণমূল নেত্রীর বাড়ির সামনে ছাড়াও কলকাতার প্রায় সর্বত্রই এসব নিয়ে আলোচনার কথা জানা যায়।
মূখ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর সামনের দিনগুলোতে মমতাকে যে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে তার মধ্যে রয়েছে, জলপাইগুড়ি ও দার্জিলিংয়ের পাহাড়ের সমস্যা, জঙ্গলমহলের মাওবাদী সমস্যা, মুসলিম ভোটারদের সন্তুষ্ট করা, রাজ্যের অর্থনৈতিক সংকট, রাজ্যে বিনিয়োগ বাড়ানো, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাজের পরিবেশ ফিরিয়ে আনা এবং বামবিরোধী ভোটারদের উচ্চাশা পূরণ করা। বলাই বাহুল্য, এই বিষয়গুলো বাস্তবায়নে মমতাকে রাজনৈতিকভাবেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে।
উত্তরের পাহাড়ে দার্জিলিং মহকুমাকে পৃথক রাজ্য করার দাবি জানিয়ে আসছে গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা। রাজনৈতিকভাবে এবারের নির্বাচনে গোর্খা মোর্চা মমতাকে সমর্থন জানায়। এজন্য মমতাও পাহাড়ের ওই এলাকাগুলোতে তৃণমূলের প্রার্থী না দিয়ে কৌশলে কংগ্রেসকে পাহাড়ের আসন ছেড়ে দেয়। ফলে গোর্খা মুক্তি মোর্চা সেখানে তিনটি আসনে প্রার্থী দিয়ে সবকটিতেই জয়ী হয়। গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা ঘোষণা দিয়েই রেখেছে, রাজ্য সরকারে যারাই আসুক পৃথক রাজ্যের দাবি থেকে তারা সরে আসবে না। এখানেই মূখ্যমন্ত্রী হিসেবে অখণ্ড রাজ্য রাখা হবে মমতার জন্য নতুন একটি চ্যালেঞ্জ।
মমতার অপর একটি চ্যালেঞ্জ হলো, রাজ্যের দক্ষিণ-পশ্চিমের জঙ্গলমহল এলাকা। এখানে সিপিএমবিরোধী মাওবাদীদের সমর্থন জানিয়ে আসছে তৃণমূল কংগ্রেস। এবারের নির্বাচনে মাওবাদীরাও মমতার দলকে ভোট দিয়েছেন। মাওবাদীরা সশস্ত্র বিপ্লব-সংগ্রামের মাধ্যমে রাজ্য তথা দেশের শাসনক্ষমতা অর্জন করতে চায়। বামপন্থী সরকার কেন্দ্রীয় বাহিনী নিয়ে গত প্রায় একবছর ধরে সেখানকার মাওবাদীদের নিয়ন্ত্রণ করে। মমতা ব্যানার্জি বরাবরই সেখানে মাওবাদীদের নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় বাহিনীর ব্যবহারের বিরোধী। তিনি কেন্দ্রীয় বাহিনী প্রত্যাহারের জন্য দিল্লির কেন্দ্রীয় সরকারকে নানাসময়ে চাপ দিয়েছেন। এখন জঙ্গলমহলের কী হবে, সে প্রশ্নই সবার মুখে। সিদ্ধান্ত নিতে হবে মমতাকেই।
বাম শাসনামলে রাজ্যে মুসলমানদের অগ্রগতি হয়নি, বরং তারা আরও পিছিয়ে গেছে বলে কেন্দ্রীয় সরকারের সাচার কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। এ প্রতিবেদনের সূত্র ধরেই মমতা ব্যাপক প্রচার চালান এবং মুসলমানদের উন্নয়নের ধারায় ফিরিয়ে আনার মৌখিক আশ্বাস দেন। এটির বাস্তবায়নও হবে মমতার জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ রাজ্যের ৩০ শতাংশের বেশি ভোটার মুসলমান। তারা এতোদিন বামফ্রন্টকে ভোট দিয়ে এলেও ধারণা করা হচ্ছে, এবার এদের বেশিরভাগই মমতার জোটকে ভোট দিয়েছেন।
রাজনৈতিক এসব চ্যালেঞ্জ ছাড়াও নির্বাচনের আগে মমতা ব্যানার্জি ভোটারদের নানা ধরনের প্রতিশ্রতি দিয়েছেন। সেগুলো বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ তো রয়েছেই।
নির্বাচনী ইশতেহারের মধ্যে শিল্পবিষয়ক প্রতিশ্রতির উল্লেখযোগ্য হলো, শিল্পায়ন বাড়ানো হবে, বিশেষ করে চা ও পাট শিল্পের বিকাশ করা হবে, ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্প বাড়ানো হবে, সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম বাড়িয়ে সংস্কার করা, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প উদ্যোক্তাদের বাড়তি সুবিধা দেওয়া, জেলা পর্যায়ে শিল্পায়নের সুযোগ বাড়ানো।
স্বাস্থ্যখাতে দেওয়া প্রতিশ্র্রুতিগুলোর মধ্যে রয়েছে, কমিউনিটি স্বাস্থ্যকেন্দ্র স্থাপন, জেলা পর্যায়ে অত্যাধুনিক বিশেষায়িত হাসপাতাল স্থাপন, সারা রাজ্যে ডায়াগনস্টিক সেন্টার স্থাপন, দরিদ্রদের জন্য স্বাস্থ্যবীমা চালু প্রভৃতি।
শিক্ষাখাতে প্রতিশ্রুতিগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, নতুন বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলা, কারিগরি শিক্ষার সুযোগ বাড়ানো, যুব উন্নয়ন করা, বেকারদের চাকরি দেওযা প্রভৃতি।
অবকাঠামোখাতে মমতার দেওয়া প্রতিশ্রতিগুলোর মধ্যে রয়েছে, জাতীয় মহাসড়কের উন্নয়ন, গ্রামাঞ্চলে সড়ক পাকাকরণ, গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুৎ সংযোগ বাড়ানো, সবার জন্য পানির সুবিধা, সেচ সুবিধা বাড়ানো, জলপথের সুবিধা বাড়ানো প্রভৃতি।
নির্বাচনী ইশতেহারে দেওয়া মমতা ব্যানার্জির চমকপ্রদ আরেকটি ওয়াদা হলো রাজ্যে ৭টি নতুন বিমানবন্দর তৈরি করবেন। তিনি বলেছেন, ‘নির্বাচনে জয়লাভ করলে মালদহ, কোচবিহার, বালুরঘাট, আসানসোল, মেদেনীপুর, বীরভূম ও সাগরদ্বীপে বিমানবন্দর হবে। ’ এছাড়া কলকাতা বিমানবন্দরের অবকাঠামো সুবিধাও তিনি বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
বাংলাদেশ সময়: ১৭৩৫ ঘণ্টা, মে ১৪, ২০১১