কলকাতা থেকে: বিধানসভা নির্বাচনের ফল ঘোষণার পর থেকে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন এলাকায় বিদায়ী বামফ্রন্ট সরকারের নেতাকর্মীদের ওপর তৃণমূল কংগ্রেস নেতাকর্মীদের হামলার বেশকিছু ঘটনা ঘটেছে।
রোববার পর্যন্ত পৃথক ঘটনায় ২ জনের মৃত্যু, কয়েকজন গুরুতর আহত, ৫ নারী ধর্ষিত, সিপিএম পার্টি অফিস দখল ও সম্পত্তি বেদখল হওয়ার ঘটনার কথা জানা গেছে।
এদের মধ্যে নৃশংস ঘটনা ঘটেছে শনিবার পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার গড়বেতায়। সেখানে জোনাল কমিটির সদস্য জীতেন নন্দীকে প্রকাশ্য খুন করে তৃণমূল নেতাকর্মীরা। এছাড়া বর্ধমানের রায়নায় সিপিআই (এম) সমর্থক এক মহিলাকে নৃশংসভাবে খুন করা হয়েছে।
গড়বেতায় তৃণমূল কংগ্রেস বিধানসভা নির্বাচনে পরাজিত হয়। এরই জের ধরে প্রাথমিক শিক্ষক জিতেন নন্দীকে (৫৭) তৃণমূল কর্মীরা পিটিয়ে হত্যা করে বলে অভিযোগ পাওয়া যায়।
এই হামলায় গুরুতর আহত হয়েছেন সিপিএমের ফতেপুরসিং আঞ্চলিক কমিটির আরো ৩ সদস্য।
রোববার তৃণমূলের নেতাকর্মীদের হামলায় নিহত হয়েছেন বাঁকুড়া জেলার তালডাংরা থানা এলাকার শালতোড়া সিপিআই (এম) আঞ্চলিক কমিটির সম্পাদক কমরেড অজিত লোহার (৫৬)। লাঠি দিয়ে পিটিয়ে তাকে খুন করা হয়।
এছাড়া ওই ঘটনায় তালডাংরা জোনাল কমিটির সদস্য সমীর নাগকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপানো হয়। তিনি বাঁকুড়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন।
এই দুই খুনের ঘটনায় গড়বেতা পরিদর্শনে যাওয়া সিপিএম প্রতিনিধিদল তালডাংরায় আসেন। প্রতিনিধিদলে রয়েছেন, সূর্যকান্ত মিশ্র, মহম্মদ সেলিম, নরেন চ্যাটার্জি, মনোজ ভট্টাচার্য, স্বপন ব্যানার্জি।
লোহারের স্ত্রী রেণুকা লোহার ও শাশুড়ি মায়া লোহার তালডাংরা হাসপাতালে জানান, চিৎকার চেচামেচি শুনে বাড়ি থেকে বের হয়ে দেখি, ওদের দু’জনকে প্রচ- মারধর করা হচ্ছে। মায়া লোহার তার স্বামীর শরীর আঁকড়ে ধরলে তাকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দেয় তৃণমূলবাহিনী। হুমকি দেয়, ‘এবার তোর ছেলেটাকে খুন করবো, সরে যা এখান থেকে’।
রোববার তালডাংরা হাসপাতালে কমরেড অজিত লোহারের মৃতদেহের সামনে দাঁড়িয়ে মহম্মদ সেলিম সাংবাদিকদের জানান, বদলা নয় বদলের শ্লোগান তুলে তৃণমূলবাহিনী রাজ্য জুড়ে সন্ত্রাস শুরু করছে। কোচবিহার থেকে দাঁতন সর্বত্র চলছে সন্ত্রাস।
ঘটনা সম্পর্কে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা কমিটির সম্পাদক দীপক সরকার বলেন, ‘জিতেন নন্দীর বাড়ি বেনাচাপড়া গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার নেড়াশোল গ্রামে। আরো কয়েজন পার্টিকর্মীর সঙ্গেই তিনি এদিন সকালে ছিলেন মায়তায় পার্টি অফিসে। হঠাৎ করে তৃণমূল নেতা বাচ্চু কুমার, অসীম ওঝা, বিশ্বনাথ ম-ল, অসীম সিংহ রায়ের নেতৃত্বে এই হামলা চালানো হয়।
তিনি বলেন, ‘পার্টি অফিস থেকে বের করেই জিতেন নন্দীকে মারতে মারতে তুলে নেয় তৃণমূলী সশস্ত্র বাহিনী। পিটিয়ে পিটিয়ে তাকে খুন করে মৃতদেহটা পার্টি অফিস থেকে কিছুটা দূরে কেউতাড়াতে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কাছে একটি খালের ধারে ফেলে রেখে যায় তারা। পরে পুলিশ গিয়ে মৃতদেহ উদ্ধার করে। ’
বীরভূম জেলা সিপিএম অফিস ভাঙচুর
এদিকে সিপিআই (এম)-র বীরভূম জেলা কমিটির দপ্তরে হামলা চালিয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস সমর্থকরা। তারা ৩টি বাইকে চেপে এসে জেলা দপ্তরের জানলার কাচ ভাঙে, দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে হামলারও চেষ্টা চালায়।
গোয়ালতোড়ে সিপিএমের কার্যালয় ভাঙচুর
অপরদিকে, গোয়ালতোড়ে পিংবনীতে সিপিএমের কার্যালয়ে ভাঙচুর চালানো হয়। সশস্ত্র দুর্বৃত্তরা হুমগড় আঞ্চলিক কমিটির দপ্তর ঘেরাও করে। আঞ্চলিক কমিটির সম্পাদক সুনীল গায়েনের বাড়ি ঘেরাও করে তার ছেলেকে তৃণমূল কংগ্রেস সমর্থকরা তাদের কাছে ‘সারেন্ডার’ করার জন্য হুমকি দেয়।
আঞ্চলিক কমিটির সদস্য বলাই বিশ্বাসের বাড়ি ঘেরাও করে হামলা চালানো হয়। লাঠি দিয়ে তার মাথা ফাটিয়ে দেয় তারা। পার্টিকর্মী গৌতম ঘোষের বাড়ি ঘিরে কেরোসিন তেল ঢেলে পোড়ানোর চেষ্টা করে তৃণমূল কংগ্রেস সমর্থকরা। বগারডিহি কলোনিতে পিয়াশালা গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান কল্পনা বিশ্বাসের বাড়িতে ভাঙচুর করে লুঠপাট চালানো হয়।
বিভিন্ন স্থানে সিপিএম কার্যালয় ও কর্মীদের ওপর হামলা
সিপিএমের চন্দ্রকোনা আঞ্চলিক কমিটির সদস্য কৃষ্ণপুরের বাসিন্দা দিলওয়ার প্রামাণিকের ওপর চড়াও হয়ে বেধড়ক মারধর করা হয়। গুরতর আহত হন আরো বেশ কয়েকজন। এমনকী পৌর দপ্তরে ঢুকেও কর্মচারীদের ওপর হামলা চালানো হয়। ঝাঁকরাতে দুটি পার্টি অফিসে ভাঙচুরের পাশাপাশি ২৫টি পার্টি সমর্থক পরিবারের ওপর ওপর হুমকি, মারধরের ঘটনার খবর পাওয়া গেছে।
কেশপুরের বাজোয়াড়া এলাকার সিপিএম কর্মী ওয়াইদুরল ইসলাম এবং অমৃতপুরে তপন দাসকে তৃণমূল কর্মীরা এমন মারধর করেছে যে তাদের হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছে। বাজোয়াড়া পার্টি অফিসে হামলা করা হয়েছে। খেতুয়া, তড়িয়া, রাজগ্রাম এলাকায় সিপিআই (এম) কর্মীদের বাড়ি ভাঙচুর করা হয়েছে। নেড়াদেউলে পার্টি কর্মীদের ওপর আক্রমণের চেষ্টা হয়েছে।
এদিন সকালে শালবনী ব্লকের মেমুলের বাসিন্দা পার্টিকর্মী সুদর্শন দাস তার মেয়েকে নিয়ে শালবনীতে যাচ্ছিলেন। পথে তাকে আটকায় তৃণমূল কংগ্রেসের সমর্থকরা। প্রচ- মারধর করে রাস্তায় ফেলে রেখে চলে যায় তারা। নারায়ণগড়েও চালানো হয়েছে হামলা। পার্টি অফিস থেকে লাল পতাকা নামিয়ে টাঙিয়ে দেওয়া হয় তৃণমূলী পতাকা। আবার গুইয়াদহ পার্টি অফিসে বাইরে থেকে নির্বিচারে ইট-পাথর ছোড়ে তৃণমূল কংগ্রেসের কর্মীরা। এতে আহত হন পার্টির আঞ্চলিক কমিটির সদস্য স্বপন বারিকসহ বেশ কয়েকজন।
বেলদায় পার্টির কুনারপুর আঞ্চলিক থেকে সিপিআই (এম)-র ৩ জন কর্মীকে তুলে নিয়ে গিয়ে প্রচ- মারধর করে তৃণমূলের কর্মীরা। পার্টি অফিস থেকে লাল পতাকা খুলে তারা তৃণমূলের পতাকা লাগিয়ে দেয়। সিপিআই (এম)-কে সমর্থন করার জন্য মুরাদপুরে সংখ্যালঘু মানুষজনকে ব্যাপক মারধর করে তৃণমূল সমর্থক-কর্মীরা।
শনিবার পটাশপুরের বড়হাট এলাকার পুরুলিয়া গ্রামে শঙ্কর মাঝি এবং মানস দাসকে রাস্তা থেকে অপহরণ করে তৃণমূলের বাহিনী। তাদের তৃণমূলের কার্যালয়ে নিয়ে মারধর করা হয়।
মহম্মদপুরের ১টি ও মংলামডোর দুটি সিআইটিইউ অফিসে লুটপাট চালায় তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। অফিস জোর করে দখল করে তৃণমূলের পতাকা টাঙিয়ে দেওয়া হয়।
এছাড়া খেজুরি-নন্দীগ্রামেও হামলা হয়েছে।
মিনাখাঁয় ৪ নারী ধর্ষিত
উত্তর চব্বিশ পরগণার মিনাখাঁ এলাকার কুলটি গ্রামে সিপিএমের ৪ নারী কর্মী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। তাদের হাসপাতালেও চিকিৎসার সুযোগ দেয়নি তৃণমূলের নেতাকর্মীরা।
শনিবার মধ্যরাতে সন্ত্রাসীরা তৃণমূল পরিচয়ে স্থানীয় সিপিএম এক নেতার ঘরে ঢুকে তার স্ত্রী পার্টি কর্মীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। বাধা দিতে এলে প্রতিবেশী ৩ নারীকেও ধর্ষণ করে সন্ত্রাসীরা।
রোববার এ ঘটনায় থানায় গেলে থানাও মামলা নিতে চায়নি বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
বাংলাদেশ সময়: ০৩৪০ ঘণ্টা, মে ১৬, ২০১১