কলকাতা: রাজনীতি থাক নেতাদের জন্য অভিনেতারা থাকুন পর্দায়! নাকি নেতাদের টপকে পর্দার মানুষরা বেশি কার্যকরী হয়ে উঠছেন ভোটের বাক্সে। এই নিয়ে আলোচনা বিতর্ক চলছে গোটা পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে।
রাজনীতিতে অভিনেতাদের আসা নতুন বিষয় নয় । কিন্তু ২০১৬ সালের পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনের এক সঙ্গে এতজন চলচ্চিত্র তারকার রাজনীতির মঞ্চে আর্বিভাব, নতুনভাবে বিষয়টিকে ভাবতে বাধ্য করছে কলকাতার মানুষকে। কলকাতার বিভিন্ন এলাকার বিভিন্ন পেশার মানুষদের সামনে বাংলানিউজের তরফে একটি প্রশ্ন নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। প্রশ্নটি ছিলো, অভিনয় জগতের মানুষরা কি রাজনীতিতে এসে জনগণের কাজ করতে সফল হবেন?
কলকাতার নন্দন চত্বরের তরুণ-তরুণীদের আড্ডায় এই প্রশ্ন করা হলে বিভিন্ন মতামত উঠে এলো। গ্রুপ থিয়েটারের তরুণ অভিনেতা অর্ক রায় জানালেন, অবশ্যই অভিনেতারা রাজনীতিতে তার নিজের দক্ষতার ছাপ ফেলতে পারেন। নাটকের মঞ্চের সঙ্গে রাজনীতির যোগাযোগের কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন প্রয়াত উৎপল দত্তের জীবনের প্রসঙ্গ তুলে জানান, উৎপল দত্ত তার অভিনয় জীবনের বিভিন্ন সময় পরিষ্কার রাজনৈতিক অবস্থান নিয়েছেন। এছাড়া বর্তমান পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পর্যটন মন্ত্রী ব্রাত্য বসুও একজন নাট্যকার।
তবে ঐ একই আড্ডায় অর্ক-এর যুক্তির বিরোধিতা করলেন চয়নিকা মজুমদার। চয়নিকা নিজেও অভিনয়ের সঙ্গে যুক্ত। তার মতে রাজনীতি অন্যান্য বিষয়ের মতোই চর্চার বিষয়। একেবারে অন্য জগত থেকে এসে সেই চর্চার মধ্যে না থেকে নির্বাচনে দাঁড়িয়ে যাওয়াটা শুধু মাত্রই চমক সৃষ্টি করা ছাড়া আর কিছু নয়।
অনির্বাণ চৌধুরী পেশায় চিত্র গ্রাহক। তার প্রশ্ন, যখন একজন শিক্ষক , একজন আইনজীবী বা একজন চিকিৎসক রাজনীতিতে আসেন তখন প্রশ্ন তোলা হয় না। তখন কেন একজন অভিনেতা বা অভিনেত্রীর অথবা গায়কের বেলায় এই প্রশ্ন তোলা হবে। তার যুক্তি ভারত সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দপ্তর সামলাচ্ছেন স্মৃতি ইরানি। তিনিও পেশায় অভিনেতা।
কিন্তু বেশ কিছু অভিনেতার রাজনীতিতে অসফল হওয়ার ঘটনাও নতুন নয়। তার সবথেকে বড় উদহারণ অমিতাভ বচ্চন। তিনি কংগ্রেসের হয়ে নির্বাচনে লড়াই করেন এবং লোকসভার সদস্য হন। কিন্তু পরবর্তী সময় তিনি রাজনীতি থেকে নিজেকে অনেকটাই দূরে সরিয়ে নেন। তিনি বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে বলেছেন ,তিনি মনে করেন রাজনীতি তার জায়গা নয়।
এই বছর তৃণমূল কংগ্রেসের হয়ে ভোটে লড়াই করছেন, সোহোম, চিরঞ্জিতের মত অভিনেতারা। বিজেপি-এর হয়ে ময়দানে হাজির লকেট চ্যাটার্জী এবং রূপা গাঙ্গুলীরা।
এই উদাহরণ সামনে রেখে কলকাতার বই পাড়া কলেজ স্ট্রিটে বসে ছাত্র-ছাত্রীদের এক আড্ডায় একই প্রশ্ন ছুঁড়ে দেওয়া হয়েছিল বাংলানিউজের তরফ থেকে। তবে কি অভিনেতা অভিনেত্রীরা রাজনীতিতে শুধু চমক, নাকি তারা দেশ পরিচালনা করতে সমান ভাবে সক্ষম।
অভিনেতাদের রাজনীতিতে আসা নিয়ে সরাসরি বিরোধিতা করলেন সিরাজুল হোসেন। সমাজ বিজ্ঞানের ছাত্র সিরাজুলের মতে, রাষ্ট্র পরিচালনার প্রথম ধাপ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা। অভিনয়ের সঙ্গে সরাসরি রাষ্ট্র পরিচালনার কোন সম্পর্ক নেই। বরং অভিনেতারা নিজেদের তারকা ইমেজ বজায় রাখতে সাধারণ মানুষের থেকে দূরে থকেন। ফলে সাধারণ মানুষের প্রতিদিনের সমস্যার খুঁটিনাটির সঙ্গে তারা পরিচিত নন। বরং নিরাপত্তার ঘেরাটোপ আর তারকার জীবন কাটানোর ফলে তারা সমাজের বড় অংশের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন থাকেন। ফলে সমাজ, রাষ্ট্র, বিভিন্ন রাজনৈতিক ইস্যু সম্পর্কে তাদের সম্যক ধারণা না থাকাটাই স্বাভাবিক। এর ফলে তারা রাজনীতিতে এসে জনগণের বিশেষ উপকারে লাগতে পারেন না।
এই মতের সঙ্গে সঙ্গে উঠে এলো বিরোধী মতামত। ইতিহাসের ছাত্রী অনামিকা সাউ মনে করেন, রাজনীতিকরা সার্থকভাবে রাজ্য বা দেশ পরিচালনা করতে পারেন তার উদাহরণ ভুরিভুরি রয়েছে। দক্ষিণ ভারতের দিকে তাকালে দেখা যায় একাধিক অভিনয় জগতের মানুষ রাজনীতিতে বলিষ্ঠ নেতা হিসেবে উঠে এসেছেন। এর মধ্যে জয়ললিতা, চিরঞ্জীবীসহ বেশ কয়েকজনের নাম করাই যায়। এছাড়া পশ্চিমবঙ্গের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাব কংগ্রেস নেত্রী দীপা দাশমুন্সি নাট্য জগতের ব্যক্তিত্ব হলেও তিনি রাজনীতিতে বর্তমানে প্রথম সারির নেত্রী হিসেবে পরিগণিত হন। একাধারে বিজেপি-তে ভালো কাজ করছেন রূপা গাঙ্গুলী এবং লকেট চ্যাটার্জি। মন্ত্রী ব্রাত্য বসু তো আছেনই।
সাম্প্রতিক কালে সিপিএম থেকে তৃণমূল কংগ্রেসে আসা নেতা রেজ্জাক মোল্লা রাজনীতিতে তারকাদের আসা নিয়ে কটাক্ষ করেছেন। সেই নিয়ে উত্তাল হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক আবহ। তিনি বলেছেন অনেক জায়গাতেই একই রাজনৈতিক দলের দুই গোষ্ঠীর প্রার্থী নিয়ে মতবিরোধ বন্ধ করতে কোন একজন তারকা প্রার্থীকে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়। তিনি আরও বলেছেন এই তারকারা ভোটের পড়ে তাদের পেশা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন । ফলে সাধারণ মানুষ তাদের দেখা পান না।
তারকা প্রার্থীরা কি শুধুই চমক। তারা কি ভোট বৈতরণী পার হবার একটা অবলম্বন মাত্র? এই প্রশ্ন রাখা হয়েছিল বাংলানিউজের তরফে। আড্ডায় উপস্থিত ছিলেন পেশায় স্কুল শিক্ষক সুভদিপ মুখার্জি। তার মতে অন্যান্য পেশার মানুষদের থেকে চলচ্চিত্রের অভিনেতা অভিনেত্রীদের সাধারণ মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ সরাসরি কম। কারণ তারা কিছুটা সত্যজিৎ রায়ের ‘নায়ক’ ছবির চরিত্র অরিন্দম মুখার্জির মতো। কিন্তু বর্তমানে অবস্থা বদলেছে। রাজনীতি চর্চার বিষয় এই কথা অস্বীকার করা যায় না। তবে একজন অভিনেতা ইচ্ছে করলেই সেই চর্চা করতেই পারেন। আর ভারতের সংবিধান নির্বাচনে দাঁড়ানোর অধিকার প্রতিটি নাগরিককে দিয়েছে। সেই অধিকার কোন ভাবেই অভিনেতা বলে তার থেকে ছিনিয়ে নেওয়া যায় না।
কিন্তু তিনি মানুষের উন্নতিতে কাজ করবেন কিনা, সেটা তার ব্যক্তিগত ইচ্ছার উপরে নির্ভর করে। সেই ক্ষেত্রে একজন অভিনেতা এবং একজন নেতা একই সরল রেখায় দাঁড়িয়ে। তবে সব কাজের মতোই সমাজসেবা বা রাজনীতি হুজুগ মুক্ত মানসিকতা থেকে করা উচিত বলেই তিনি মনে করেন।
এই তর্ক চলতেই থাকবে। তবে ক্যারিয়ারের মধ্য গগনে থাকা অবস্থায় থেকে রাজনীতিতে আসা সোহম, মুম্বাইয়ের পাট চুকিয়ে রাজনীতিতে ঝাঁপিয়ে পড়া রূপা গাঙ্গুলি, কিংবা লকেট চ্যাটার্জি অথবা ইতিমধ্যেই সাংসদ হয়ে যাওয়া দেব আগামী দিনে সফল রাজনীতিকদের মতো মানুষের জন্য কাজ করবেন বলেন আশা করেন কলকাতার বেশির ভাগ মানুষ। তবে তাদের আশা কতটা বাস্তব আর কতটা কল্পনা তার উত্তর দেবে সময়। আর আশাপূরণ না হলে গণতন্ত্রে পাল্টে ফেলার সুযোগ তো আছেই ।
বাংলাদেশ সময়: ১৮৩৬ ঘণ্টা, ২৩ এপ্রিল, ২০১৬
ভি.এস/আরআই