কলকাতা: নির্বাচন মানেই কি তত্ত্বের কচকচানি, বিরোধীদের কড়া সমালোচনায় কোণঠাসা করার চেষ্টা নাকি প্রতিশ্রুতির বন্যা? নিন্দুকরা এইসব বললেও নির্বাচনের সঙ্গে জুড়ছে কবিতা ছড়া এবং সৃষ্টিশীলতার নানা দিক। সে দেওয়ালে রঙ দিয়ে প্রার্থী প্রচার হোক বা মিছিলের নতুন ধরনের স্লোগান।
মিছিল নগরী বলে খ্যাত কলকাতার রাজনীতিতে স্লোগানের একটা ধারাবাহিক ঐতিহ্য আছে। এই ঐতিহ্য আজকের নয়। ভারতের স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ের রাজনৈতিক ঘটনার দিকে নজর রাখলে তা দেখতে পাওয়া যাবে। কখনও দেশীয় রাজনীতি কখনও আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিভিন্ন ঘটনা এবং চরিত্র নিয়ে রাজনৈতিক স্লোগান তৈরি করেছিল কলকাতা।
২০১৬-এর বিধানসভা নির্বাচনের চমক জাগান স্লোগানগুলির কথায় আসার আগে কলকাতার রাজনীতিতে একটু পেছনে দেখার চেষ্টা করা যাক। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে রাজনৈতিক বিষয়ের পাশাপাশি স্লোগান গুলিতে উঠে আসে আর্থ সামাজিক পরিস্থিতির কথাও। জেটি যেকোনো রাজনৈতিক ভাষ্যকারকে সেই সময়ের পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করতে সাহায্য করে।
১৯৭২ থেকে ১৯৭৭ সালের সরকার বিরোধী আন্দোলনের মূল কেন্দ্র ছিল কলকাতা। সেই সময় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন প্রয়াত সিদ্ধার্থ সংকর রায়। শ্রী রায়ের সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছিলেন বামদলগুলি। যার নেতৃত্বে ছিলেন সিদ্ধার্থ সংকর রায়ের সহপাঠী এবং বন্ধু জ্যোতি বসু।
সেই সময় একটি স্লোগান খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল। যেকোনো মিছিলে পুলিশি প্রতিরোধের সামনে দাঁড়িয়ে বাম নেতাকর্মীরা স্লোগান দিতেন ‘পুলিশ তুমি যতই মারো/মাইনে তোমার একশ বারো’। আসলে এই স্লোগানের গভীরে লুকিয়ে ছিল ‘শ্রেণী সংগ্রাম’-এর তীব্র আবেদন। পুলিশ কর্মচারীদেরও মনে করিয়ে দেওয়া হচ্ছিল,তারাও আন্দোলনরত মানুষের মতোই সামাজিক এবং অর্থনৈতিক শোষণের স্বীকার।
পরবর্তী সময় বামফ্রন্ট স্লোগান তুলেছিল, ‘কৃষি আমাদের ভিত্তি ,শিল্প আমাদের ভবিষ্যৎ’। ২০০৬ সালে এই স্লোগানের ওপর ভিত্তিকরেই বিপুল ভোটে জিতেছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। এই ২০০৬ সালেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্লোগান তুলছিলেন ‘ হয় এবার, নয় নেভার’। কিন্তু সেবার তিনি ক্ষমতা আসতে পারেননি। তার পরের নির্বাচনে ‘মা-মাটি-মানুষ’ স্লোগান তুলে ভোটে জিতে ছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
শুধু অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নয়, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্র ৯০ দশকের কলকাতার দেওয়ালে দেওয়ালে দেখা যেত সেই বিখ্যাত স্লোগান, ‘যখন মানুষ চাহে বস্ত্র ও খাদ্য / সীমান্তে তখনই বাজে যুদ্ধের বাদ্য’। অনেকে বলেন, এই স্লোগানই নাকি তাদের জাতীয়তাবাদ এবং বিশ্ব রাজনীতির বিষয়ে নতুন করে ভাবতে সাহায্য করেছিল।
গত শতাব্দীর ছয় কিংবা সাতের দশকে কলকাতায় যাদের ছাত্র জীবন জীবন কেটেছে তারা অবশ্যই শুনেছেন, ‘তোমার নাম আমার নাম, ভিয়েতনাম — ভিয়েতনাম'। এই স্লোগানের থেকেই সম্ভাবত অনুপ্রাণিত হয়ে পশ্চিমবঙ্গের নন্দিগ্রামে ক্যামিকেল হাব গড়ে তোলার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে স্লোগান উঠেছিল ‘ ভুলতে পারি নিজের নাম, ভুলব নাকো নন্দীগ্রাম’।
যারা পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির খবর রাখেন তারা জানেন, নন্দীগ্রাম আন্দোলন ছিল বামফ্রন্ট সরকারের পতনের অন্যতম কারণ। ২০১১ সালের বিখ্যাত স্লোগান ‘চুপচাপ ফুলে ছাপ’ বা ‘উল্টে দেখুন, পাল্টে গেছে’ কিংবা ‘বাঙলায় চাই পরিবর্তন’ নিঃশব্দে পাল্টে দিয়েছিল সরকার।
২০১৬ সালেও কিছু নতুন স্লোগান উড়ে বেড়াচ্ছে ভোটের ময়দানে। যে স্লোগানগুলিতে আছে সমসাময়িক ঘটনা থেকে শুরু করে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের প্রতি তীব্র কটাক্ষ। পশ্চিমবঙ্গের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ করছে বিরোধী দল। কিন্তু এই সমস্ত কিছুকে চক্রান্ত বলে উড়িয়ে দিচ্ছে শাসক দল। তারা স্লোগান তুলেছে ‘যতই নাড়ো কলকাটি /নবান্ন আবার হাওয়াই চটি। ’ হাওয়াই চটি বলতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাওয়াই চটি পরার অভ্যাসের কথাই বলা হয়েছে।
তবে, প্রত্যাবর্তনের কথা শাসক দল বললেও বাম এবং কংগ্রেসের জোট কিছু এগিয়ে আছে স্লোগান যুদ্ধে। তারা স্লোগান তুলেছে ‘দু হাজার ষোলো সাল / বাংলা আবার লালে লাল। ’ জোট আরও বলছে ‘কামদুনি থেকে পার্কস্টিট / জনগণ দেবে চার্জশিট’ এই স্লোগানে উঠে এসেছে পার্কস্টিট এবং কামদুনি ধর্ষণ কাণ্ডের কথা। এই দুই ঘটনায় শাসক দল বারে বারে কোণঠাসা হয়েছিল।
শুধু তাই নয়, উঠে এসেছে সারদা আর্থিক কেলেঙ্কারি এবং সদ্য ঘটে যাওয়া নারদ স্ট্রিং অপারেশনের কথা। ‘লুট হয়েছে হাজার কোটি/ কে খেয়েছে হাওয়াই চটি’ অথবা ‘চরাম চরাম বাজছে ঢাক / তৃনমূল নিপাত যাক’।
স্লোগানের লড়াই তৃণমূল কংগ্রেস এবং জোটের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। দুই দলকে কটাক্ষ করে বিজেপি স্লোগান দিয়েছে ‘বামের ৩৪ তৃণমূলের ৫ / বাংলা থেকে এবার বাজাও এদের বিদায়ের ঢাক। ’
বাংলাদেশ সময়: ১০৫০ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৭ , ২০১৬
ভি.এস/পিসি