কলকাতা: ব্যস্ত শহরের তখন দম ফেলবার সময় নেই । অফিস ও স্কুল- কলেজে যাওয়া যাত্রীদের ভিড় বাড়ছে।
একদিকে বাস, ট্রাম, মেট্রো অন্যদিকে হাওড়া এবং শিয়ালদা স্টেশনে ট্রেনগুলি নিয়ে আসছে হাজার হাজার যাত্রী। সময় সকাল ১০টা, কলকাতার ভাষায় ‘অপিস টাইম’। এই মানুষদের সঙ্গেই রুজি রুটির লড়াইয়ে নেমেছে কলকাতার থেকে কিছুটা দূরে শান্তিপুরের মেয়ে শিখা।
শান্তিপুরের বাতলা গ্রামের শিখা কলকাতায় বহুরূপী সেজে পয়সা রোজগার করে। দোকানে দোকানে গিয়ে মা কালির বেশে দাঁড়ায় সে। যে যা দেয় সেটাই খুশি হয়ে নিজের ঝোলায় ভরে রাখে।
বহুরূপীর কথা বললে প্রথমেই মনে আসে শরৎ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের শ্রীনাথ বহুরূপীর কথা। তবে প্রাচীন সাহিত্যে বহুরূপীদের উল্লেখ আছে বিভিন্ন জায়গায়। যদি আমরা রামায়ণ মহাকাব্যর কথাই ধরি, সেখানে সোনার হরিণ সেজে সীতাকে প্রলুব্ধ করা মারীচ রাক্ষসকে বহুরূপীদের পূর্বসূরী হিসেবে ধরা যেতেই পারে। মিশর, গ্রিস এবং এর আশেপাশের দেশগুলিতে প্রাচীন কাল থেকে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বহুরূপী সাজার বিষয়ে প্রমাণ পাওয়া যায়।
পশ্চিমবঙ্গের শান্তিপুরের বাতলা গ্রামের মেয়ে শিখা ছোটবেলা থেকেই বহুরূপী সাজছে। সে তার মার সঙ্গে বাতলা গ্রামের একটি আশ্রমে থাকে। থাকার জায়গা পেলেও নিজের খাবার নিজেকেই জোগাড় করে নিতে হয়। মায়ের বয়স বেড়েছে তাই তিনি কাজ করতে পারেন না। মা ছাড়া এই পৃথিবীতে আর কেউ নেই শিখার। বাবার বিষয়ে প্রশ্ন করতেই কিছুটা রুক্ষ হোল মা কালির রূপে সাজা শিখা। কিছু সময় চুপ থেকে উত্তর দেয়, বাবার পরিচয় সে জানে না।
বহুরূপী শিখা জানালো, দিনে ৬০ থেকে ৭০ রুপি রোজগার হয়। বিভিন্ন উৎসবের দিন ১শ’ রুপিও পাওয়া যায়। দু’জন মানুষের দিন চালাবার জন্য ১শ’ রুপি যথেষ্ট নয়। এতে হয়তো পেটের খিদে কোনরকমে মেটে কিন্তু চিকিৎসা বা অন্যান্য খরচ মেটানো সম্ভব হয় না।
কারো কাছেই শিখা বহুরূপী সাজার প্রথাগত শিক্ষা পায়নি। অন্য কোন কাজ না পেয়ে নিজে নিজেই এ সাজ সাজতে শিখেছে। এই কাজকে ‘ভিক্ষা’ বলা যায় কিনা সেই বিষয়ে অবশ্যই বিতর্ক আছে। কারণ এখানে অভিনয়ের দক্ষতা লাগে, লাগে পরিশ্রম এবং মেক-আপ নেবার শিক্ষা। কিন্তু প্রাচীনকালে বহুরূপীদের অভিনেতা-অভিনেত্রীর সম্মান থাকলেও বর্তমান সমাজের চোখে এই লুপ্তপ্রায় পেশার শিল্পীরা ভিখারিদের গোত্রেই ঢুকে গেছেন।
বহুরূপী শিখার অভিযোগ বাজার এলাকায় সমস্যা না হলেও কোন কোন এলাকায় তাদের বেশ সন্দেহের চোখে দেখে মানুষ। পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া, নদীয়া শান্তিপুর অঞ্চলে আরও কিছু মানুষ আছেন যারা বহুরূপী সাজেন। প্রতিদিন প্রায় দু ঘণ্টা সময় লাগে সাজতে।
শিখা জানায়, ‘বোঝে না সে বোঝে না’ সিনেমায় অভিনয় করেছে সে। পেয়েছিল ৫০০ রুপি। মিডিয়ার লোকেরা বলেছিল সরকারকে বলে কাজ পাইয়ে দেবে, আর্থিক সাহায্য আসবে। কিন্তু প্রতিবারই ছবি তোলার পর কেউ যোগাযোগ করেনি।
১০ রুপি প্রণামী পেয়ে শিখা বলেন ‘তুমি মিডিয়ার লোক হলে ঠাস করে চড় মারতাম। নেহাত তুমি ভক্ত তাই এতো কথা বললাম’।
শেষ প্রশ্ন ছিল, বিয়ে করবে কবে? উত্তরে শিখা জানাল কোন দিনই নয়। কারণ তার মায়ের দায়িত্ব তার কাঁধে।
কথা বলেই পাশের দোকানে সামান্য রোজগারের আশায় হাত পাতলো দেবতার চেহারার পিছনে লুকিয়ে থাকা ক্ষুধার্ত একটি মেয়ে। যার কাছে দেবতার রূপ ছাপিয়ে একমাত্র সত্য ‘ক্ষুধা’। এটাই তার বর্তমান, অতীত এবং ভবিষ্যতও।
বাংলাদেশ সময়: ১৭৩০ ঘণ্টা, জুলাই ১৫, ২০১৬
ভিএস/জিসিপি/আরআই