কলকাতার রাস্তার ধারে স্নানের দৃশ্য অনেকেই দেখেছেন। একটি পাইপ থেকে উপচে পড়ছে পানি আর সকালবেলা সেখানে স্নান করছেন বিভিন্ন বয়সের মানুষরা।
আজও এই চিত্র দেখতে পাওয়া যায়। প্রসঙ্গত বলে রাখা ভালো, কলকাতার রাস্তার ধারে পানির যে উৎসগুলো আছে সেগুলো আদতে গঙ্গার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। প্রতিদিন সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত রাস্তার ধারে পানির এই উৎসগুলোতে মানুষ স্নানের জন্য জড়ো হন। চলতি কথায় এগুলোকে বলা হয় কলতলা।
ভোরবেলা এই পানির উৎসগুলোকে ব্যবহার করা হয় গাড়ি ধোয়ার কাজে। খুব সকালে যদি উত্তর কলকাতার বিভিন্ন অংশ, মধ্য কলকাতার ধর্মতলা সংলগ্ন অঞ্চল, দক্ষিণের খিদিরপুর, ভবানীপুর ও পার্ক সার্কাস এলাকা দিয়ে যাওয়া যায়, তবে পথ চলতি মানুষের চোখে পড়বে পানির এই উৎসগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে কয়েকশ ট্যাক্সি। আর এই ট্যাক্সিগুলিকে ধোয়ার কাজ করছেন জনাকয় যুবক।
প্রতিদিনের গাড়ি ধোয়ার পানির প্রধান উৎস রাস্তার ধারে গঙ্গার জলের এই পাইপগুলো। কিন্তু এই পাইপগুলো কেনইবা বসানো হয়েছিল ? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে বাংলানিউজ২৪ হাজির হয়েছিল কলকাতা মিউনিসিপাল কর্পোরেশন এবং পূর্ত অধিদপ্তরে। এই দুই দপ্তর থেকে জানা গেল, কলকাতার পথের ধারে বিভিন্ন জায়গায় পানির এই উৎসগুলো নির্মাণের প্রাথমিক কারণ।
প্রাথমিকভাবে পানির এই উৎসগুলো নির্মাণ করা হয়েছিল কলকাতার রাস্তা ধোয়ার কাজে। এক সময় ভিস্তিওয়ালারা এসব উৎস থেকে পানি নিয়ে রাস্তা ধুয়ে দিতেন। গঙ্গায় জোয়ারের সময় এই পানির পাইপগুলিতে তীব্র বেগে জল আসে আর ভাটার সময় জলের তীব্রতা কমে যায়।
বর্তমানে কলকাতার রাস্তা ধোয়ার জন্য এক বিশেষ ধরনের গাড়ি আমদানি করেছে কলকাতা পুরসভা। কিন্তু তার পরেও পানির এই উৎসগুলোকে বন্ধ করা হয়নি। একটা সময়ের পর থেকে এলাকাবাসীরা পানির এই উৎসগুলো ব্যবহার করতে শুরু করেন। কলকাতার বিভিন্ন বস্তি এলাকায় বছরকয় আগে পর্যন্ত সাকুল্যে একটি বা দুটি পানির উৎস সরকারি তরফে বাসানো হতো। সেই পানির উৎস থেকে সাধারণভাবে খাবার পানি নেওয়া হতো।
সেই সময়ে বস্তিবাসী মানুষের স্নান, কাপড় কাচা এবং ঘরের অন্যান্য প্রয়োজনে এই গঙ্গার পানি ব্যবহার করা হতো। বর্তমানে অতি ঘন জনবসতিপূর্ণ যেসব এলাকায় পানির যথেষ্ট যোগান নেই, মূলত সেসব অঞ্চলের মানুষরাই গঙ্গার পানির এই উৎসগুলোকে সবচে বেশি ব্যবহার করেন।
এছাড়া খেটে খাওয়া মানুষ, দিনমজুর, নির্মাণশিল্পের সঙ্গে যুক্ত শ্রমিক, ঠেলাচালক, ট্যাক্সিচালক, ফেরিওয়ালারাও অনেক সময় পানির এই উৎসগুলোকে স্নান করার কাজে ব্যবহার করেন। সবচে বেশি ভিড় দেখা যায় গরমকালে।
তবে দিনের মধ্যে সময়ের ব্যবধানে পাল্টে যায় পানির পাইপকে ঘিরে গড়ে ওঠা দৃশ্যপট। সকালের দিকে পুরুষেরা স্নান করেন। লোকজনের কাজে বেরোনোর আগে ব্যস্ত হয়ে পড়ে পথের ধারের কলতলাগুলি। ভিন রাজ্যের মানুষরােএসবকে বেশি ব্যবহার করেন বলে সেখানে গ্রামের খবরাখবর চালাচালি হয়, পরিচিত মানুষদের সঙ্গে খোশগল্প-আলাপচারিতা হয়। পেশা সংক্রান্ত খোঁজ খবর থেকে শুরু করে এলাকার বিভিন্ন খবরাখবর উঠে আসে এসব আলাপে।
বেলা বাড়লে মহিলারা কাপড় কাচতে আসেন। সেখানে ঘর সংসারের খবর থেকে রান্নার গল্প ঘুরে প্রতিদিনের জীবনচর্চার নানা দিক উঠে আসে।
কলকাতায় পানির এই ধরণের উৎসের ব্যবহার কমছে। শোনা যাচ্ছে, ভবিষ্যতে ভারতের বিভিন্ন বড় শহরের মতো এখানেও বসবে ট্যাক্স। এসব মেগাসিটির উন্নয়নের প্রয়োজনে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে পানির এসব পাইপ।
কলতলাগুলোতে কান পাতলে আজও শোনা যায় যায়, খেটে খাওয়া মানুষের জীবনসংগ্রামের গল্প। আর সেই সংগ্রামে নামার আগে তারা স্নান করে তৈরি হয়ে নেন এসব কলতলাতেই। আবার দিনের শেষে শ্রমিক, কুলি, ঠেলাগাড়ির চালক কিংবা টানা রিক্সার চালকদের জীবনযুদ্ধের সমস্ত ক্লান্তি আর ঘাম ধুয়ে দেয় কলকাতার পথের ধারের এই কলতলাগুলো। তাই আকাশছোঁয়া অট্টালিকাগুলো যদি হয় কলকাতার আভরণ, তাহলে কলতলাগুলো হচ্ছে শহরের আবরণহীন চেহারার একটি অবিছেদ্য অঙ্গ।
বাংলাদেশ সময়: ১৪১৯ ঘণ্টা, ৯ আগস্ট, ২০১৬
জেএম/