কলকাতা: বলা হয়, দুর্গা কন্যারূপে প্রতিবছর বাপের বাড়ি আসেন তিন দিনের ছুটিতে। আর দশমীতে মেয়ে বাপের বাড়িকে বিদায় জানিয়ে স্বামীর গৃহে অর্থাৎ কৈলাসে ফিরে যান।
সেকালে অর্থাৎ আগে ছানার মিষ্টি ছিল আড়ম্বরের একটা অংশ। যা বনেদি বাঙালি বাড়ির স্পেশাল। ওইসব বাড়ির মা মেয়েরা দুর্গাকে বিদায় বরন করতেন ছানার সন্দেশ দিয়ে। মনে করা হতো পিত্রালয়ে উমার মুখে ছানার সন্দেশ দেখেই নাকি নীলকণ্ঠ পাখি কৈলাসে উড়ে যেত পতিগৃহে ফেরার সন্দেশ নিয়ে।
অমৃতলাল বসু তার স্মৃতি কথায় বলছেন, সেকালে অর্থাৎ ১৮৫৩ খ্রিষ্টাব্দে এক মন ছানার সন্দেশ বিক্রি হত ১৬ থেকে ২০ রুপির মধ্যে। যা মধ্যবিত্ত বা গরীবের সাধ্যের বাইরে। তাই ছানার সন্দেশ ছিল ধনীদের জিম্মায়। তার বদলে সেকালে গরীব, মধ্যবিত্তরা উমাকে বিদায় জানাতেন নাড়ু, মালপোয়া, রসবড়া, নারিকেল ও চিনি-গুড় দিয়ে ছাঁচের মিষ্টি বানিয়ে। অনেক পরে মধ্যবিত্তদের বিজয়াতে যোগ হয়েছে ছানার সন্দেশ। মহেন্দ্রনাথ দত্ত লিখেছেন, বনেদি ছাড়া ‘বিজয়ার দিন নারিকেল ছাবা দেওয়া হইত। বিজয়ার কোলাকুলিতে সন্দেশ বা অন্য কোনো খাবার চলিত না। ’
তাই দশমীর সকাল থেকেই আজও কলকাতার উত্তর থেকে দক্ষিণ, গ্রাম থেকে মফস্বলের বাড়ির কর্তাদের লাইন পড়ে পাড়ার মিষ্টির দোকানে। দশমীতে বাঙালির সংস্কৃতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ঐতিহ্যের টান ‘বিজয়ার মিষ্টি’।
কলকাতার ইতিহাস ঘাঁটলে জানা যাবে, সেকালে বনেদি বাড়ি দুর্গাপূজার শেষে দশমীর সকাল থেকে মিষ্টির ভিয়েন বসিয়ে তৈরি হতো বিজয়ার মিষ্টি। ঢাকের বাদ্যিতে বিজয়ার বিদায় ছন্দ বাজলেই ময়রাদের হেঁসেলে পাক হতো ছানার সন্দেশ, জিবেগজা, রসবড়া, মনোহরা, মিহিদানা, সীতাভোগ ইত্যাদি।
ইতিহাস বলছে, একদিকে যখন বনেদি বাড়িতে বিজয়ার ছানার মিষ্টি আড়ম্বর চলছে তখন গরীবদের ঘরে ছানার আড়ম্বর না থাকলেও নারকেল নাড়ুর উপস্থিতি জানান দিত পূজা শেষ। সেকালে মা, ঠাকুমার হাতের তৈরি মালপোয়া বা নাড়ুর স্বাদ ছিল বিজয়ার পরম প্রাপ্তি।
যদিও কালের নিয়মে বদলে গেছে বহু রীতি। তবুও একালেও বাঙালির বিজয় দশমীর সঙ্গে জড়িয়ে আছে সংস্কৃতি। তাই দশমীর পর যেমন সেই সময় মিষ্টি মানেই বাঙালিরা কিনতেন জলভরা সন্দেশ, শাঁখ সন্দেশ, কালাকাঁদ, গোলাপ সন্দেশ, কাজু বরফি। ঠিক আবার একালে নতুন প্রজন্ম ফিউশনে বিশ্বাসী। তাদের পছন্দ আইসক্রিম সন্দেশ, স্যান্ডউইচ সন্দেশ, চকোলেট সন্দেশ, চকোলেট ক্ষীরকদম, চকোরোল, চকোলেট রসগোল্লার, বেকড রসোগোল্লার মতো মিষ্টি এখন রাখতে হয় ক্রেতা টানার জন্য।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পাল্টায় রীতি রেওয়াজ। নারিকেল মিষ্টি দিয়ে এখন বিজয়া কথা ভাবতিই পারে না বাঙালিরা। কিন্তু একটা সময়ে মহালয়ার পর থেকেই বাড়ির মহিলাদের ব্যস্ততা শুরু হয়ে যেত দশমীর প্রস্তুতিতে। গাছ থেকে নারিকেল পাড়িয়ে জমা করা, ঘষে-মেজে সন্দেশের ছাঁচগুলিকে প্রস্তুত করে রাখা, মিষ্টির জন্য গুড়-চিনি মজুত রাখা আরও কত কী?
১৭৮০ খ্রিস্টাব্দে তালপাতায় লেখা এক পুঁথিতে দুর্গাপূজার খরচের একটি ফর্দ বলছে, সে বছর ‘দুর্গাপূজায় মোট খরচ হয়েছিল ৮০ টাকা ১৪ আনা ২ পাই পয়সা। এরমধ্যে প্রতিমার দাম ৫ টাকা, এক মন ঘি কেনা হয়েছিল ৫ টাকা, ৪ মন ময়দা ২ টাকা ৬ আনা। ক্ষীর কেনা হয় ৫ টাকার, সন্দেশ ৭ টাকার। ’ অর্থাৎ পূজা মানেই মিষ্টি মুখের আয়োজন।
ফলে বাঙালির কাছে বিজয় দশমীর সঙ্গে মিষ্টি যুগ যুগ ধরে জড়িয়ে আছে আবেগ ও ঐতিহ্যের সঙ্গে। তাই বিজয়ার সঙ্গে বাঙালীর মিষ্টির প্রতি ভালোবাসা এখন বহন করে চলেছে সেকালের মত একালের বাঙালীরা।
বাংলাদেশ সময়: ১৬২২ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৭, ২০২০
ভিএস/জেআইএম