খুলনা: মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত বধ্যভূমির ওপর অবস্থিত দক্ষিণাঞ্চলের অন্যতম সেরা বিদ্যাপীঠ খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় (খুবি)। দীর্ঘ ৩৩ বছরেও যেখানে ঘটেনি কোনো রক্তপাতের ঘটনা।
আগামী শনিবার (২৫ নভেম্বর) খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় দিবস। এ বছর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাকার্যক্রমের ৩৩ বছর পূর্ণ করে ৩৪ বছরে পদার্পণ করছে। বিশ্ববিদ্যালয় দিবস উপলক্ষে আনন্দ ও গৌরবের মাহেন্দ্রক্ষণে তারুণ্যের উন্মাদনায় সিক্ত শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয়জুড়ে বিরাজ করছে সাজসাজ রব।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জনগণের নিরলস প্রচেষ্টা ও দীর্ঘদিনের আন্দোলন। দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের পর ১৯৮৭ সালের ৪ জানুয়ারি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা সংক্রান্ত সরকারি সিদ্ধান্ত গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়। ১৯৮৯ সালের ৯ মার্চ খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। ১৯৯০ সালের জুনে জাতীয় সংসদে ‘খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় আইন-১৯৯০’ পাস হয়, যা গেজেট আকারে প্রকাশ হয় ওই বছরের ৩১ জুলাই।
এরপর ১৯৯০-৯১ শিক্ষাবর্ষে চারটি ডিসিপ্লিনে ৮০ জন ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি করা হয়। ১৯৯১ সালের ৩০ আগস্ট প্রথম ওরিয়েন্টেশন ও ৩১ আগস্ট ক্লাস শুরুর মাধ্যমে শিক্ষা কার্যক্রমের সূচনা হয়।
দৃষ্টিনন্দন ক্যাম্পাস
প্রতিষ্ঠাকালের দিক থেকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান নবম। খুলনা-সাতক্ষীরা মহাসড়কের গল্লামারী নামক স্থানে স্থাপিত হয়েছে এ বিশ্ববিদ্যালয়টি। স্থানটি একাত্তরের বধ্যভূমি। আর বধ্যভূমির ওপর গড়ে ওঠা এটাই দেশের একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের প্রবেশ করেই মনে হবে এক শান্ত ও পরিচ্ছন্ন পরিবেশ। নেই কোনো কোলাহল, নেই শব্দ দূষণ। বিশেষভাবে চোখে পড়বে একই রঙে রাঙানো ভবনগুলোর দেয়াল। প্রশাসনিক বা একাডেমিকসহ কোনো ভবনের গায়ে চিকা মারা নেই। নেই কোনো স্লোগান লেখা, নেই কোনো ব্যানার, ফেস্টুন। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেকটি ভবনের নাম বিধৃত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের শহীদ তথা বাঙালির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের নামে।
দৃষ্টিনন্দন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান গেট ধরে সামনে এগিয়ে গেলে চোখে পড়বে কালজয়ী মুজিব চত্বর, সবুজের ছায়া ঘেরা পথ ধরে কিছুটা আগালে দেখা যায় ভাস্কর্য অদম্য বাংলা। রয়েছে মুক্তমঞ্চ, শহীদ মিনার, গোলপাতার ক্যাফেটেরিয়া, লেকসহ বৈচিত্র্যময় পরিবেশ। সুন্দরবনের আবহ আর রূপসা নদী ও ভৈরব নদের স্নিগ্ধতায় হাজার হাজার শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে এখানে। প্রথাগত ছক থেকে বের হয়ে দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষা ও গবেষণার আয়োজন দেশের মেধাবীদের আকৃষ্ট করছে দলে দলে।
বিশ্বসেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় খুবি
সফলতার অংশ হিসেবে চলতি বছর বিশ্ববিদ্যালয়টি আন্তর্জাতিকভাবে কিউএস র্যাংকিং, টাইমস হায়ার অ্যাডুকেশন র্যাংকিং ও এশিয়া ইউনিভার্সিটি র্যাংকিংয়ে স্থান করে নিয়েছে। ইউজিসির মূল্যায়নেও অবস্থান প্রথম দিকে। এ ছাড়া দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থার অংশ হিসেবে আউটকাম বেজড অ্যাডুকেশন প্রথম চালু হয়েছে এখানে। এক বছরে ৮০০টি গবেষণা নিবন্ধ প্রকাশ ও ১১০টি গবেষণা প্রকল্প সম্পন্ন করা বিশ্ববিদ্যালয়টিতে ছয় মাসে আন্তর্জাতিক সম্মেলন হয়েছে পাঁচটি। এসব কারণে প্রতিষ্ঠানটি শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের পছন্দের শীর্ষে থাকে সব সময়।
‘লার্ন, লিড অ্যান্ড লিভ’-স্লোগানে এগিয়ে চলা এ প্রতিষ্ঠানে ছাত্র রাজনীতি না থাকলেও শিক্ষার্থীদের মনোজাগতিক বিকাশ, মুক্তবুদ্ধির চর্চা, সামাজিক ও সাংগঠনিক দক্ষতা বাড়াতে সংগঠন রয়েছে ৩২টি।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় এগিয়ে চলা শিক্ষালয়টির ক্রমবর্ধমান উন্নয়নে সংশ্লিষ্ট সবার সহযোগিতামূলক মনোভাব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করেন দায়িত্বশীলরা।
আটটি অনুষদে সাড়ে সাত হাজার শিক্ষার্থী
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় একটি সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয় হলেও সময়ের চাহিদা অনুযায়ী এখানে জীববিজ্ঞান, বিজ্ঞান প্রকৌশল ও প্রযুক্তিবিদ্যা, কলা ও মানবিক, সামাজিক বিজ্ঞান, ব্যবসায় প্রশাসন, আইন, চারুকলাসহ অন্যান্য বিষয়ের প্রতিও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্কুল বা অনুষদের সংখ্যা আটটি, ডিসিপ্লিন বা বিভাগের সংখ্যা ২৯টি। শিক্ষার্থীর সংখ্যা সাড়ে সাত হাজারেরও বেশি। যার মধ্যে ৩৪ জন বিদেশি শিক্ষার্থী রয়েছে। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন শিক্ষক আছেন পাঁচ শতাধিক, যার এক তৃতীয়াংশই পিএইচডি ধারী। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত ১:১৪। ছাত্র-ছাত্রীর অনুপাত ৫৪:৪৬, যা দেশের মধ্যে উল্লেখযোগ্য। কর্মকর্তা তিন শতাধিক ও কর্মচারীর সংখ্যা ৫০০। বিশ্ববিদ্যালয়ে এ পর্যন্ত ছয়টি সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়েছে। যার মাধ্যমে প্রায় ১৫ হাজার গ্র্যাজুয়েটকে আনুষ্ঠানিকভাবে অভিজ্ঞানপত্র দেওয়া হয়েছে। শিক্ষা কার্যক্রম চালুর পর গত ৩৩ বছরে এখানে কোনো ছাত্র সংঘর্ষ, হানাহানি বা রক্তপাত হয়নি। শান্তিপূর্ণ পরিবেশে নিরবচ্ছিন্নভাবে এ দীর্ঘ সময়ে শিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে আসছে। দেশে উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় সেশনজট, সন্ত্রাস ও রাজনীতিমুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বতন্ত্র ভাবমূর্তি অর্জনে সক্ষম হয়েছে।
ইনোভেশন হাব-স্মার্ট ইউনিবেটর স্থাপন
বাংলাদেশ হাই-টেক পার্ক কর্তৃপক্ষের অধীন ‘ডিজিটাল উদ্যোক্তা ও উদ্ভাবন ইকোসিস্টেম উন্নয়ন’ প্রকল্পের আওতায় খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইনোভেশন হাব-স্মার্ট ইউনিবেটর স্থাপনের কাজ শুরু হয়েছে। গত ১৮ অক্টোবর সকালে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে শেখ রাসেল দিবস উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে তিনি স্মার্ট কার্ড পাঞ্চ করে এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির অটোমেশনের কাজও শেষ হয়েছে। আগামী ২৫ নভেম্বর এটি উদ্বোধন করা হবে। এটি সম্পন্ন হলে এতদঞ্চলের মধ্যে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি হবে অত্যন্ত সমৃদ্ধ, যা অনলাইনে ব্যবহারের সুযোগ উন্মুক্ত হবে।
উপাচার্যের ভাষ্য
বছরজুড়ে নানা অর্জনের পাশাপাশি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়ারা দেশের বিভিন্ন পর্যায়ে নেতৃত্ব দিচ্ছে বলে জানিয়েছেন খুবি উপাচার্য প্রফেসর ড. মাহমুদ হোসেন।
তিনি বলেন, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পেছনে এতদঞ্চলের মানুষের অপরিসীম অবদান ও ত্যাগ অনস্বীকার্য। আমরা সব সময়ই সে বিষয়টি ধারণ করি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয় এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও দেশের সংস্কৃতি-ঐতিহ্য ধারণ করেই এ বিশ্ববিদ্যালয় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কাজ করে যাচ্ছে। বর্তমান সরকারের ২০৪১ সালের স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার অভিলক্ষ্য পূরণে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়কে ‘স্মার্ট বিশ্ববিদ্যালয়’ হিসেবে গড়ে তুলতে ডিজিটাইজেশনের পথে এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে।
খুবি উপাচার্য বলেন, দেশের উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার ক্ষেত্রে ইতোমধ্যে আস্থার জায়গা সৃষ্টিতে সক্ষম হয়েছে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়। এটি ধারণ করেই এ বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বমান অর্জনের পথে এগিয়ে যাবে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রায় সব শাখার মেলবন্ধনে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় পূর্ণাঙ্গ রূপ পরিগ্রহের পথে। এ বিশ্ববিদ্যালয় শিগগিরই শিক্ষা, গবেষণা ও উদ্ভাবনে বিশ্ব পরিমণ্ডলে আলো ছড়াবে। সে প্রত্যাশার সঙ্গে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় দিবস-২০২৩ এর এ শুভক্ষণে সবার সহযোগিতা প্রত্যাশা করছি।
বিশ্ববিদ্যালয় দিবসের কর্মসূচি
আগামী শনিবার খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাকার্যক্রমের ৩৩ বছর পূর্তি হচ্ছে। দিবসটি যথাযথভাবে পালনের জন্য এ বছর বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রাসহ বিভিন্ন কর্মসূচির আয়োজন করা হয়েছে।
কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে- সকাল ১০টা ১৫ মিনিটে কালজয়ী মুজিব ও শহীদ মিনারে পুষ্পমাল্য অর্পণ, সকাল সাড়ে ১০টায় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা, পরে মুক্তমঞ্চে বিভাগ/ডিসিপ্লিনসমূহের গত বছরের অর্জন ও আগামী বছরের পরিকল্পনা উপস্থাপনার ডিসপ্লে বোর্ড স্থাপন, সন্ধ্যা ৬টায় গত বছরের কৃতিত্ব অর্জনকারী শিক্ষার্থী ও সংগঠনসমূহকে সম্মাননা দেওয়া, সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। অন্যান্য কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে- বাদ জোহর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে দোয়া মাহফিল ও মন্দিরে প্রার্থনা। এ ছাড়া ক্যাম্পাসের মেইন গেট, রাস্তা, শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ প্রশাসনিক ভবন, উপাচার্যের বাসভবন, ক্যাফেটেরিয়া, লাইব্রেরি ভবন, একাডেমিক ভবন ও হলসমূহ আলোকসজ্জা করা হয়।
বাংলাদেশ সময়: ১৬১৯ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৪, ২০২৩
এমআরএম/আরবি