ঢাকা: হায়দার আলী পেশায় একজন ভ্যানচালক। পিরোজপুরের নাজিরপুর উপজেলার শেখ মাটিয়া ইউনিয়নের রামনগর গ্রামের মৃত কাঞ্চন খানের ছেলে তিনি।
এই অর্জনে আপ্লুত হায়দার আলী ও তার পরিবার। উচ্ছ্বসিত তার প্রতিবেশীরাও। হায়দার আলীর পাশের ঘরের বাসিন্দা হাশেম মিয়া বলেন, বাচ্চারা কী খেয়ে রাতে ঘুমাতে যাবে, সেটা হয়তো কখনো কখনো সে জানতো না। পরদিন পরীক্ষা বলে হয়তো ভ্যান নিয়ে কাজে যেতে পারেনি, তাতে ছয়টা পেট অভুক্ত, কারণ ঘরে খাবার নেই। একদিন চাকা না ঘুরলে চুলায় আর ভাত ওঠে না- এই হলো হায়দার আলীর অবস্থা!
জীবনে এমন কোনো কিছুই বাধা হতে পারেনি হায়দার আলীর শিক্ষা অর্জনের পথে। ভ্যান চালানোর পাশাপাশি লেখাপড়া শেখার অদম্য আগ্রহের কারণে রাতে পরিবারের সবাই ঘুমিয়ে পড়লে এবং দিনে ভ্যান চালানোর ফাঁকে ফাঁকে পড়ালেখা চালিয়ে যেতেন হায়দার। ইংরেজিতে তার বেজায় দখল। নিয়মিত ইংরেজি বলার চর্চা ও নতুন শব্দ শেখার আগ্রহ তাকে সমৃদ্ধ করেছে। রেডিওতে নিয়মিত আন্তর্জাতিক বিশ্বের সংবাদ শোনাও তার নেশা।
ব্যক্তিগত জীবনে হায়দার আলী চার সন্তানের জনক। তিনি ১৯৯৪ সালে প্রথম বিভাগে মাধ্যমিক পাস করেন। সংসারের অভাব-অনটনের কারণে অনেকটা বাধ্য হয়ে সেসময় শিক্ষাজীবনের ইতি টানতে হয় তাকে। দীর্ঘ শিক্ষা বিরতির পর ২০১৩ সালে বাউবিতে এইচএসসিতে ভর্তি হন। পরিবারের ঘানি, স্ত্রী-সন্তানদের ভরণ-পোষণ আর দায়িত্ব পালনের পরেও ৩.৮৩ পেয়ে এইচএসসিতে পাস করে চমক দেখান তিনি।
ভ্যান চালিয়ে প্রতিদিন গড়ে তিন থেকে চার শ টাকা আয় হয় তার। পৈতৃক সম্পত্তির মধ্যে তার একটি ঝুপড়ি ঘর আর মাত্র ৩ শতাংশ জমি আছে।
বিএ পাস হায়দার আলী বলেন, এবার আমার স্বপ্ন উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন। যত বছরই লাগুক আমি এমএ পাস করবোই। চাকরির জন্য নয়, উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার বাসনা থেকে এ শিক্ষা অর্জন করছি। তারপরও যদি একটি অন্য কাজ পেতাম; পরিবার-পরিজন নিয়ে একটু ভালো থাকতে পারতাম। বয়স এখন ৪৭ বছর। যত বাড়ছে বয়স, ভ্যান টানার শক্তি ততই কমে যাচ্ছে। খুব কষ্টের কাজ চরাঞ্চলে ভ্যান টানা।
হায়দার আলীর মতো সুযোগবঞ্চিত, অবহেলিত, বয়স্ক ও অদম্য শিক্ষার্থীর শিক্ষার সুযোগ সম্পর্কে বাউবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বলেন, হায়দার আলী একটি সাহসের নাম। সংগ্রামী, পরিশ্রমী, দৃঢ়, অপরাজিত, স্বপ্নবান একজন মানুষ। শিক্ষাবঞ্চিত মানুষের আদর্শ তিনি। এই রকম মানুষের পাশে সব সময় রয়েছে বাউবি। প্রযুক্তির কল্যাণে আমাদের শিক্ষাক্রম এখন সারা দেশেই সব বয়সের, পেশার নাগরিককে ঘরে বসে শিক্ষা লাভের সুযোগ দিচ্ছে। শুধু তাই নয়, জনকল্যাণের জন্য সম্প্রতি গবেষণার সুযোগকে অবারিত ও বিস্তৃত করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাউবি।
বাউবি দেশের বাইরেও স্টাডি সেন্টার খুলেছে। দক্ষিণ কোরিয়া, সৌদি আরব, কাতার, কুয়েত, আরব আমিরাত, ইতালিতে অবস্থানরত বাঙালি রেমিট্যান্স যোদ্ধারা সেখানে বসে এখন বাউবির বিভিন্ন প্রোগামে শিক্ষা লাভ করছেন।
উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী পরিচালক (তথ্য ও গণসংযোগ বিভাগ) মো. আব্দুল হাই বাবু জানান, পটুয়াখালীর সাগরপাড়ের জেলে হাসান পারভেজ, কিশোরগঞ্জের চা বিক্রেতা হারুন মিয়া, বগুড়ার হুইল চেয়ারের যোদ্ধা প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী নুরজাহান রিয়া কিংবা নারী সাফ ফুটবল দলের সাবেক ক্যাপ্টেন সাবিনা খাতুন, মার্কিন সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার ফটোগ্রাফার নিজামুল বিশ্বাস- এরা সবাই বাউবির স্টুডেন্ট। সব মিলিয়ে, দক্ষতা, শিক্ষার আলো পৌঁছে দিতে ও আলোকিত মানুষ গড়তে বাউবি আজ একটি আদর্শ প্রতিষ্ঠান। হায়দার আলীর উচ্চশিক্ষা গ্রহণে সার্বিক সহযোগিতার জন্য অবশ্যই তার পাশে থাকবে বাউবি।
বাংলাদেশ সময়: ১৭২৬ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৩, ২০২৪
এমআইএইচ/এইচএ/