ঢাকা, সোমবার, ৮ আশ্বিন ১৪৩১, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৯ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিক্ষা

মাঠহীন চার দেয়ালে বন্দি শিক্ষাজীবন

এম আব্দুল্লাহ আল মামুন খান, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪১২ ঘণ্টা, জুন ২৬, ২০১৯
মাঠহীন চার দেয়ালে বন্দি শিক্ষাজীবন রাস্তার পাশে গড়ে ওঠা এসব বহুতল ভবনেই চলছে স্কুলের কার্যক্রম

শিশুর সুস্থ বিকাশের জন্য খেলাধুলা অপরিহার্য। কিন্তু সমকালীন বাস্তবতায় সেই সুযোগবঞ্চিত হচ্ছে কোমলমতি শিশুরা। যে বিদ্যালয়ে তারা পড়াশোনা করছে সেখানেই নেই খেলার মাঠ। আবার অভিভাবকরাও চান না পড়াশোনা বাদ দিয়ে শিশুরা খেলাধুলায় মেতে উঠকু।

ফলে এসব শিশুরা পায় না মুক্ত বাতাসে ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ। বঞ্চিত হয় শরীর চর্চার সুযোগ থেকেও। এসব নিয়ে দুই পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদন লিখেছেন বাংলানিউজের সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট এম. আব্দুল্লাহ আল মামুন খান ছবি তুলেছেন অনিক খান। আজ পড়ুন প্রথম পর্ব। 

ময়মনসিংহ: শিক্ষানগরী ময়মনসিংহের সরকারি ও বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা শুধুই লেখাপড়া করে, খেলাধুলা করতে জানে না ওরা! দু’ধরনের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বেশিরভাগ শিক্ষার্থীই ক্রীড়াবিমুখ। সরকারি কয়েকটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে খেলার মাঠ থাকলেও জোর নেই খেলাধুলা চর্চায়।

আবার নগরীর কমপক্ষে ছয় শতাধিক বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চিত্র ঠিক বিপরীত। এখানে ভবন বড় কিন্তু লাপাত্তা খেলার মাঠ! ফলে চার দেয়ালের বন্দি থেকেই শিক্ষাজীবন শুরু হয় কোমলমতি শিশুদের।

খেলাধুলার ন্যূনতম জায়গা না থাকায় মুক্ত আকাশে ঘুরে বেড়ানোর আনন্দ ওরা যেমন পায় না, তেমনি দুরন্তপনায় মেতে ওঠারও সুযোগ নেই।  

খেলাধুলা শিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলেও কোমলমতিরা এ সুযোগবঞ্চিত হওয়ায় তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। উচ্ছলতার বদলে বন্দি শৈশব নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে ওদের জীবনে। মাঠের সংস্কৃতির সঙ্গে ন্যূনতম যোগাযোগ না থাকায় আকাশসংস্কৃতি কেড়ে নিচ্ছে ওদের শৈশবের স্বপ্ন-সাধ।

নগরীর সানকিপাড়া, সানকিপাড় শেষ মোড়, গোহাইলকান্দি, ক্যান্টনমেন্ট মোড়, গাঙ্গিনপাড়, নতুন বাজারসহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ঘুরে দেখা গেলো এমন চিত্রের।  

দেখা গেছে, নগরীর গোহাইলকান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের খেলাধুলার জায়গা নেই। গাঙ্গিনারপাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়তো খেলার মাঠহীন। এ বিদ্যালয়ে আবার চলে শাখারিপট্টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ক্লাস। ফলে দু’টি বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা একসঙ্গে খেলাধুলার সুযোগবঞ্চিত হচ্ছে। একই অবস্থা সদর উপজেলার মালতিপ্রভা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়েরও।
রাস্তার পাশে গড়ে ওঠা এসব বহুতল ভবনেই চলছে স্কুলের কার্যক্রমএসব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে খেলার জন্য উন্মুক্ত মাঠ না থাকায় শিক্ষার্থীরা খেলাধুলা করতে পারে না। শুধু সরকারি এ বিদ্যালয়ই নয় নগরীর বেশিরভাগ ওয়ার্ড পর্যায়ে খোলা মাঠ নেই। ফলে স্কুলবয়সী ছেলেমেয়েরা খেলাধুলা ছাড়াই বড় হয়ে উঠছে। এ অবস্থায় অভিভাবকরা বাধ্য হয়ে শিশুদের পার্কে নিয়ে যান। যেখানে উন্মুক্ত স্থানে শিশুরা দৌড়ঝাঁপ করতে পারে।  

নগরীর বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো কেবল ভবনকেন্দ্রিক। অলিগলিতে, রাস্তার উপর অপরিকল্পিত বাড়ি ভাড়া নিয়ে চলে এসব বিদ্যালয়ের কার্যক্রম। যার সামনে এক চিলতে মাঠও নেই। সেখানে খেলাধুলা নামক শব্দটি যেন অজানা।

বছরে একবার শিক্ষার্থীদের খেলার জন্য বাইরে কোথাও নিয়ে যাওয়া হয়। এজন্য আবার চাঁদাও নেওয়া হয়। অর্থাৎ নগরীরে কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষার্থীদের খেলাধুলার দিনটির জন্য টাকা দিতে হয়!  

বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা কল্যাণ সমিতির সভাপতি নাজমুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, ‘সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জন্য যে পরিমাণ জায়গা থাকা দরকার তা নেই। ফলে অনেক স্কুলে লেখাপড়া চললেও খেলাধুলা চলে না। জেলা পর্যায়ের শহর ও গ্রামাঞ্চলের স্কুলের শিক্ষার্থীদের মধ্যে খেলাধুলার দিকে উৎসাহ নেই। শহরের স্কুলে জায়গার অভাবে আর গ্রামের স্কুলে উৎসাহের অভাবে খেলাধুলা নেই। ’  

ময়মনসিংহ জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মোফাজ্জল হোসেন বাংলানিউজকে জানান, জেলায় ২ হাজার ১৪২টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এর মধ্যে ৪ থেকে ৫টি বিদ্যালয়ে খেলার মাঠ নেই। আর কিন্ডারগার্টেন বা বেসরকারি ৬৪১টি বিদ্যালয়ের মধ্যে ৬০০টিতেই খোলা জায়গা নেই। ভবনেই গড়ে উঠেছে বিদ্যালয়।  
স্কুলে চলছে শিক্ষা কার্যক্রমনগরীর গাঙ্গিনারপাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী অরিন্দন, স্নেহা ও প্রীতম বাংলানিউজকে জানায়, খেলার মাঠ না থাকায় ছোট্ট খোপে তাদের বন্দি থাকতে হয়। টিফিনের সময়েও তাদের অলস বসে থাকতে হয়। সুযোগ হয় না হৈ-হুল্লোড়ে মেতে ওঠার।  

নগরীর ক্যান্টনমেন্ট মোড় এলাকায় একটি ৫তলা ভবনের প্রথম ও দ্বিতীয় তলায় গড়ে উঠেছে গ্লোবাল পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ। নার্সারি থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত অধ্যয়নের সুযোগ থাকলেও এখানে রয়েছে খেলার মাঠের অভাব। স্কুল-টু-বাসা, এতেই ঘুরপাক খেতে হয় কোমলমতি শিক্ষার্থীদের।  

এ স্কুলের ৮ম শ্রেণির ছাত্র আব্দুর রহমান ও সাবিকুন নাহার জিনিয়া জানান, সকালে ঘুম থেকে উঠেই স্কুল। বিকেলে বাসায় ফিরে প্রাইভেট, সন্ধ্যায় আবারো পড়তে বসা। মাঝখানে খেলাধুলার সুযোগ নেই। তবে স্কুলে মাঠ থাকলে কিছুটা হলেও বন্ধুরা মিলে দৌড়ানোর সুযোগ হতো।  

জানতে চাইলে গ্লোবাল পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রধান শিক্ষক কুমকুম সরকার বাংলানিউজের কাছে দাবি করেন, বিদ্যালয়ের সামনেই ছোট্ট খোলা জায়গা আছে। এছাড়া বার্ষিক ক্রীড়ানুষ্ঠানেরও আয়োজন হয়। সেখানে বিভিন্ন ইভেন্ট থাকে। তখন শিশুরা ভালো করে খেলার সুযোগ পায়।  

কোমলমতি শিক্ষার্থীরা খেলাধুলার সুযোগবঞ্চিত হওয়ার বিষয়ে ময়মনসিংহ জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মোফাজ্জল হোসেন বাংলানিউজকে জানান, শৈশব থেকে একজন শিশুর মধ্যে প্রতিযোগিতার মানসিকতা গড়ে ওঠে। আর খেলাধুলা করতে গিয়েই হার-জিত মেনে নিতে শিখে শিশুটি। এতে তার সুস্থ দেহ ও সবল মন গড়ে উঠে। কিন্তু বেসরকারি বিদ্যালয়গুলোতে খেলার মাঠ না থাকায় শিশুদের সুস্থ মানসিক বিকাশ গড়ে উঠছে না।  

বাংলাদেশ সময়: ১০০০ ঘণ্টা, জুন ২৬, ২০১৯ 
এমএএএম/জেডএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।