জামায়াত অধ্যুষিত এই আসনে হেভিওয়েট প্রার্থী থাকলেও আওয়ামী লীগে বিভক্তি স্পষ্ট। আর বিরোধীরা সুযোগ নিতে চায় সর্বশেষ পৌরসভার নির্বাচনী কৌশলে।
সাতক্ষীরা-২ আসনের পূর্বাপর নির্বাচন বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ১৯৭৩ সালে খুলনা-১৩ আসনে (সাতক্ষীরা সদর ও কলারোয়া উপজেলার অর্ধেক) সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগের সৈয়দ কামাল বখত সাকী। এরপর প্রায় ৪২ বছর এই আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা জিততে পারেননি।
১৯৭৯ সালে পুনর্নির্ধারিত খুলনা-১৪ আসনে জয়লাভ করেন মুসলিম লীগের খান এ সবুর। পরে তিনি আসনটি ছেড়ে দিলে উপ-নির্বাচনে জয়লাভ করেন মুসলিম লীগের সৈয়দা রাজিয়া ফয়েজ।
১৯৮৬ সালে সাতক্ষীরা-২ আসনে জয়লাভ করেন জামায়াতের কাজী শামসুর রহমান। ১৯৮৮ সালের নির্বাচনে জয়লাভ করেন জাতীয় পার্টির হাবিবুর রহমান, ১৯৯১ সালের নির্বাচনে পুনরায় জয়লাভ করেন জামায়াতের কাজী শামসুর রহমান। ১৯৯৬ সালেল ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে জয়লাভ করেন বিএনপির অ্যাডভোকেট শামসুল হক। একই বছরের ১২ জুনের নির্বাচনে ফের জয়লাভ করেন জামায়াতের কাজী শামসুর রহমান। ২০০১ সালের নির্বাচনে জয়লাভ করেন জামায়াতের মাওলানা আব্দুল খালেক মণ্ডল। ২০০৮ সালের নির্বাচনে জয়লাভ করেন জাতীয় পার্টির এমএ জব্বার।
আর সর্বশেষ ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে জয়লাভ করেন আওয়ামী লীগের মীর মোস্তাক আহমেদ রবি।
তবে, বর্তমান সরকারের সময়ে অনুষ্ঠিত সর্বশেষ সাতক্ষীরা পৌরসভা নির্বাচনে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও বিএনপির বিদ্রোহী প্রার্থীকে পরাজিত করে বিজয়ী হন বিএনপির প্রার্থী তাসকিন আহমেদ চিশতি।
নির্বাচন বিশ্লেষকদের মতে, এই আসনে সবসময়ই জামায়াতের প্রভাব সুষ্পষ্ট। এরপরও গত প্রায় ১০ বছরে ক্ষমতায় থাকাকালে দল গোছাতে ব্যর্থ হয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। আধিপত্য বিস্তার, মনোনয়ন প্রত্যাশা ও সর্বশেষ জেলা পরিষদ নির্বাচনকে ঘিরে এই আসনে আওয়ামী লীগে বিভক্তি স্পষ্ট।
দলীয় মনোনয়নের আশায় সাতক্ষীরা-২ আসনে আগে থেকেই গণসংযোগ করে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন বর্তমান সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মীর মোস্তাক আহমেদ রবি, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম এবং জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও সদর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান বাবু।
সম্প্রতি এতে যুক্ত হয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক আবু আহমেদ ও সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এসএম শওকত হোসেন। তারা পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে মনোনয়ন প্রত্যাশার ঘোষণা দিয়েছেন।
আওয়ামী লীগের হেভিওয়েট প্রার্থীদের মধ্যে বর্তমান সংসদ সদস্য মুক্তিযোদ্ধা মীর মোস্তাক আহমেদ রবি ১৯৭৩-৭৪ সালে সাতক্ষীরা সরকারি কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি নির্বাচিত হন। প্রায় ৪২ বছর পর দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনিই সাতক্ষীরা-২ আসন থেকে নৌকা প্রতীক নিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। নির্বাচিত হওয়ার পর সাতক্ষীরা সদর উপজেলার শিক্ষা খাতে অবকাঠামোগত উন্নয়ন, গ্রামাঞ্চলের রাস্তা-ঘাটের উন্নয়ন, জলাবদ্ধতা নিরসন ও চলাচলের সুবিধার্থে ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন।
মনোনয়ন প্রত্যাশী জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো. নজরুল ইসলাম ১৯৮৪ সালে আশাশুনি উপজেলা আওয়ামী লীগের ট্রেজারার, ১৯৯৫ সালে জেলা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষের দায়িত্ব পান। ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে সাতক্ষীরা সদর আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে পরাজিত হন। ১৯৯৭ সালে সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। ২০০৪ সালে নির্বাচিত হন সাতক্ষীরা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। ২০১৫ সালেও পুনরায় জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হন। সর্বশেষ জেলা পরিষদ নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীকে বিপুল ভোটে পরাজিত করে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন।
সাতক্ষীরা-২ আসনে সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে কাজ করছেন সদর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আসাদুজ্জামান বাবু। সাবেক তুখোড় এই ছাত্রনেতা জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ও জেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। পথসভা, জনসভা ছাড়াও বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে সরকারের উন্নয়ন ও সাফল্যের চিত্র তুলে ধরছেন তৃণমূলে।
তবে, আওয়ামী লীগের উল্লিখিত তিন সম্ভাব্য প্রার্থীর মনোনয়ন প্রত্যাশা ও গণসংযোগকে কেন্দ্র করে দলীয় নেতাকর্মীরা বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। বিষেদাগার করছেন একে অপরের। এতে দলটিতে বিভক্তি আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
দলীয় নেতাকর্মীদের মতে, এই বিভক্তিই আগামী নির্বাচনে কাল হয়ে দাঁড়াতে পারে আওয়ামী লীগের জন্য।
অপরদিকে, মাঠে না নামলেও সাতক্ষীরা-২ আসনে বিএনপি-জামায়াতের একাধিক প্রার্থী দলীয় মনোনয়নের প্রত্যাশায় সাংগঠনিক তৎপরতা চালাচ্ছেন বলে জানা গেছে।
এদের মধ্যে জেলা বিএনপির সভাপতি রহমাতউল্লাহ পলাশ, সাধারণ সম্পাদক তারিকুল হাসান, সহ-সভাপতি ও লাবসা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আব্দুল আলিম এবং আলিপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ও জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি আব্দুর রউফ উল্লেখযোগ্য।
দলটির নেতাকর্মীদের অভিযোগ, গায়েবি মামলা দিয়ে তাদের নেতাকর্মীদের ঘর ছাড়া করা হয়েছে। চায়ের দোকানেও তাদের বসতে দেওয়া হচ্ছে না। এমনকি সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানে গেলেও নাশকতার পরিকল্পনার অভিযোগে মামলা দেওয়া হচ্ছে।
এদিকে, জামায়াতের দলীয় সূত্র জানায়, সাতক্ষীরা-২ আসনে জামায়াতের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সেক্রেটারি ও খুলনা বিভাগের পরিচালক মুহাদ্দিস আব্দুল খালেক নির্বাচনে অংশ নেবেন। তিনি জেলে রয়েছেন। কঠোর গোপনীয়তার মধ্য দিয়ে দলের নেতাকর্মীরা কাজ করে যাচ্ছেন।
আর নির্বাচনে জোটগতভাবে অংশ নিলে বিএনপি-জামায়াত সর্বশেষ পৌরসভা নির্বাচনের কৌশল গ্রহণ করে বিজয় ছিনিয়ে নিতে চায় বলে দলটির নেতাকর্মীদের দাবি।
কথিত আছে, সাতক্ষীরা পৌরসভার সর্বশেষ নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াতের কর্মী-সমর্থকরা আওয়ামী লীগের প্রার্থীর ব্যাজ পরে ভোট কেন্দ্রে গিয়ে এক যোগে ধানের শীষে ভোট দেন। ফলে আওমায়ী লীগ, জাতীয় পার্টি ও বিএনপির বিদ্রোহী প্রার্থীকে পরাজিত করে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হন বিএনপির প্রার্থী।
তবে, বসে নেই জাতীয় পার্টিও। এই আসন থেকে ১৯৮৮ ও ২০০৮ সালের নির্বাচনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। তাই এবারও আসনটি চায় জাতীয় পার্টি।
এরই মধ্যে সাতক্ষীরা-২ আসনের সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে জেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি শেখ আজহার হোসেন, সাধারণ সম্পাদক আশরাফুজ্জামান আশু, সদর উপজেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার জাহিদ তপন ও কেন্দ্রীয় জাতীয় পার্টির সাংগঠনিক সম্পাদক মাতলুব হোসেন লিয়নের নাম কেন্দ্রে পাঠিয়েছে দলটি।
নির্বাচনের সামগ্রিক পরিস্থিতি ও দলীয় সাংগঠনিক অবস্থান নিয়ে সাতক্ষীরা জেলা আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক শেখ হারুন-উর-রশীদ বাংলানিউজকে বলেন, আওয়ামী লীগ বড় দল। একাধিক প্রার্থী মনোনয়ন চাইতে পারেন। যিনি মনোনয়ন পাবেন- সবাই তার পক্ষেই এক মঞ্চে উঠবো। তৃণমূলে কোনো বিভক্তি নেই।
মীর মোস্তাক আহমেদ রবি বাংলানিউজকে বলেন, সাতক্ষীরা সদর আসনে ৪২ বছর পর আমার হাত ধরে নৌকা প্রতীক বিজয়ী হয়েছে। নৌকা প্রতীকের সম্মান রাখতে যথেষ্ট চেষ্টাও করেছি। এলাকায় অভূতপূর্ব উন্নয়ন করা হয়েছে। মনোনয়ন পাওয়ার বিষয়ে আমি আশাবাদী।
আরেক মনোনয়ন প্রত্যাশী নজরুল ইসলাম বলেন, সাতক্ষীরা জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক অবস্থা সুদৃঢ় করতে সর্বাত্মক কাজ করে যাচ্ছি। দলের কাছে মনোনয়ন চাইবো। এজন্য প্রচার-প্রচারণাও চালাচ্ছি। নেত্রী অবশ্যই যোগ্য প্রার্থীকে মনোনয়ন দেবেন।
আসাদুজ্জামান বাবু বলেন, দলের একজন নিবেদিত প্রাণ কর্মী হিসেবে মনোনয়ন চাইবো। সদর উপজেলার আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সমর্থনে আমি উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছি। সংসদ নির্বাচনেও নেতাকর্মীরা আমাকে চায়। মনোনয়ন পাওয়ার আশায় কাজ করছি।
জেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি শেখ আজহার হোসেন বলেন, বিগত সময়ে সাতক্ষীরা-২ আসনে জাতীয় পার্টি থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। তাই এবারও আসনটি চায় জাতীয় পার্টি। এজন্য তৃণমূলে সাংগঠনিক তৎপরতা বৃদ্ধি করা হয়েছে। প্রত্যেক ইউনিয়ন শাখার সম্মেলন শেষ হয়েছে। আশা করি, আগামী নির্বাচনে জাতীয় পার্টির প্রার্থীই নির্বাচিত হবেন।
জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক শেখ তারিকুল হাসান বাংলানিউজকে বলেন, বিএনপি নির্বাচনমুখী দল। কিন্তু বিএনপি নেতাকর্মীদের একাধিক মামলা দিয়ে ঘর ছাড়া করা হয়েছে। মাঠে নামতে দেওয়া হচ্ছে না। তারপরও আমাদের সাংগঠনিক তৎপরতা অব্যাহত আছে। ভোট সুষ্ঠু হলে বিএনপির বিজয় কেউ ঠেকাতে পারবে না।
জেলা জামায়াতের দপ্তর সম্পাদক আজিজুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, আমরা নির্বাচনে যেতে চাই। কিন্তু সুষ্ঠু নির্বাচনের কোনো পরিবেশ এখনও দৃশ্যমান নয়। বর্তমানে আওয়ামী লীগ ছাড়া নির্বাচনের মাঠে অন্য কোনো দল নেই। অন্যান্য দলকে মাঠে নামতে দেওয়া হচ্ছে না।
বাংলাদেশ সময়: ১০১০ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৩, ২০১৮
এসআই