ঢাকা: বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি) ৬০ বছরে পদার্পণের প্রাক্কালে প্রতিষ্ঠানটিতে চরম অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগ উঠায় এ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বাংলাদেশ সংস্কৃতি ও শিল্পী অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ।
শিল্পীদের সম্মানী থেকে ভ্যাট কাটা বাতিল করাসহ ১২ দাবি জানানো হয় সংগঠনের পক্ষ থেকে।
রোববার (২২ ডিসেম্বর) জাতীয় প্রেসক্লাবের জহুর হোসেন চৌধুরী হলে ‘৬০ বছরের বিটিভি, ডুবছে বিটিভি, বাঁচাও বিটিভি’ প্রতিপাদ্যে বাংলাদেশ সংস্কৃতি ও শিল্পী অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের ব্যানারে সংবাদ সম্মেলনে বক্তারা এসব দাবি জানান।
সংবাদ সম্মেলনে বক্তারা বলেন, বিটিভিতে দীর্ঘদিন ধরে চলমান দুর্নীতির কারণে প্রতিষ্ঠানটির মান ক্রমশ অবনতি হচ্ছে। শিল্পীদের সম্মানী দেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যাপক অনিয়ম চলছে এবং অনেক শিল্পীই সময়মতো তাদের পাওনা পাচ্ছেন না।
বক্তারা আরও বলেন, আগামী ২৫ ডিসেম্বর বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি) ৬০ বছরে পদার্পণ করতে চলেছে। দেশে শিল্প সাহিত্য ও সংস্কৃতির বিকাশ বিনোদনের জন্য বিটিভির ছিল ব্যাপক ভূমিকা। বিশেষ করে ৭০ ও ৮০ এর দশকে বিটিভির বিভিন্ন নাটক, গান ও ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে অনেক কালজয়ী গান, নাটক, শিল্পী ও কলাকুশলীর জন্ম দিয়েছে। আজকের দিনে যারা বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে নানাভাবে প্রতিষ্ঠিত, একসময় তাদের প্রাণের জায়গা ছিল বাংলাদেশ টেলিভিশন।
বক্তারা বলেন, কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, ৬০ বছর পূর্তির প্রাক্কালে দাঁড়িয়ে বর্তমানে বিটিভিতে চরম অব্যবস্থাপনা, কর্তৃপক্ষের স্বেচ্ছাচারিতা, দুর্নীতি, অনিয়ম, স্বজনপ্রীতি, অদক্ষতা ও জবাবদিহিতার অভাবে, বাংলাদেশের জনগণের ট্যাক্সের অর্থে পরিচালিত ঐতিহ্যবাহী এই প্রতিষ্ঠানটি দুর্নীতি ও দুর্নীতিবাজদের কড়াল গ্রাসে ডুবতে বসেছে। সব মিলিয়ে রাষ্ট্রীয় এই প্রতিষ্ঠানটি মৃত্যুর শেষ প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে বক্তারা আরও বলেন, মানহীন বাজে অনুষ্ঠান প্রচার, সব মিলিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে সাধারণ দর্শক। দেশের জনগণ ও দর্শকদের আস্থা ও বিশ্বাস যোগ্যতার জায়গাটি চিহ্নিত কিছু দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের জন্য ইতোমধ্যে হারিয়ে ফেলেছে বাংলাদেশ টেলিভিশন। যথাযথ বিচার না হলে অচিরেই ধ্বংস হয়ে যাবে এই প্রতিষ্ঠানটি।
সংবাদ সম্মেলনে বক্তারা বলেন, সমগ্র পৃথিবীতে যেখানে সঙ্গীতাঙ্গনের মেধাবীদের রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সম্মানিত নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়, সেখানে এই দেশে একটি নিম্ন শ্রেণি থেকেও নিচে শিল্পীদের রাখা হয়। যেন এই দেশটা পৃথিবীরই নয়, অন্য কোনো গ্রহের। বিটিভির হিসাব শাখা ইতোমধ্যেই দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে। এই শাখায় কর্মরত অনেকের ঢাকা শহরে, বাইরে একাধিক বাড়ি-গাড়ি, প্লট ও ব্যবসা রয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশন ঢাকা কেন্দ্রের সাবেক জেনারেল ম্যানেজার (প্রাক্তন চলতি দায়িত্ব থাকাকালীন) মাহফুজা আক্তারের বিরুদ্ধে ২১ কোটি টাকা দুর্নীতির অভিযোগে তদন্ত কার্যক্রম চালাচ্ছে। ইতোমধ্যে তথ্য মন্ত্রণালয় মাহফুজা আক্তার ও বিটিভি ঢাকা কেন্দ্রের হিসাব শাখার প্রধান আতাউর রহমানকে যথাক্রমে সাতক্ষীরা ও নোয়াখালী উপকেন্দ্রে বদলি করেছে। কিন্তু সব দুর্নীতির মাস্টার মাইন্ড মহাদুর্নীতিবাজ প্রোগ্রাম ম্যানেজার মোল্লা আবু তৌহিদ। যার বিরুদ্ধে এখনো কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এই মোল্লা আবু তৌহিদদের সব কুকর্মের প্রধান সংগীত শাখার কি-বোর্ড বাদক সুমন রেজা গং বুক ফুলিয়ে অনৈতিকতা করে সদর্পে যা ইচ্ছে তাই করে যাচ্ছে, যেন এই প্রতিষ্ঠানটি তাদের পৈতৃক ওয়ারিশ সূত্রে পাওয়া।
অন্যদিকে মো. ফারুক এবং ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টের প্রধানসহ সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত অনেক কর্মকর্তা ও প্রযোজক বিটিভিতে এখনো বহাল তবিয়তে তাদের লুটপাট চালিয়ে যাচ্ছে। বিটিভির সর্বগ্রাসী দুর্নীতি নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে অসংখ্য রিপোর্ট ও ভিডিও প্রকাশিত হলেও বর্তমানে বিটিভি কর্তৃপক্ষ দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষেত্রে নীরবতা, ভয়ানক প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে।
বিটিভিকে রক্ষায় বাংলাদেশ সংস্কৃতি ও শিল্পী অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের ১২ দাবি হচ্ছে:
সব স্টেক হোল্ডারদের ভেতর থেকে মেধাবীদের সমন্বয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ সংস্কার কমিটি গঠন করতে হবে। বিটিভিতে তালিকাভুক্ত শিল্পী, কলাকুশলীসহ সবার শিল্পী সম্মানী শতভাগ বাড়াতে হবে। শিল্পীদের সম্মানী থেকে ১০ শতাংশ ভ্যাট কর্তন অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। প্রতিটি অনুষ্ঠানের বাজেট শিট উন্মুক্ত করে জবাবদিহিতা স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। তালিকাভুক্ত সব শিল্পী, কলাকুশলী, সুরকার, গীতিকার, বাদ্যযন্ত্রী ও অভিনেতাসহ সব পর্যায়ের শিল্পীদের গ্রেড ও নীতিমালা অনুযায়ী বিটিভির সব অনুষ্ঠানে অংশ গ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। শিল্পীদের পেমেন্ট বা-শিল্পী সম্মানী অনুষ্ঠানের দিন রেকর্ডিং শেষে সঙ্গে সঙ্গে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। প্রত্যেক বিষয়ে দ্রুত গ্রেডেশন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হবে। টাকার বিনিময়ে এবং তদবিরে নিম্নমানের শিল্পী ও তালিকাভুক্ত নয় এমন শিল্পীদের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ বন্ধ করতে হবে। শুধুমাত্র কাগুজে অনুষ্ঠান তৈরি করে (যা প্রচার হয় না কিন্তু বাজেট হয়) যে টাকা লুটপাট করা হয়েছে, তা তদন্ত করে চিহ্নিত দোষীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ঢাকা কেন্দ্রের বাদ্যযন্ত্রী শাখার সিন্ডিকেট ও দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। বিটিভির অডিশনের নীতিমালা ভঙ্গ করে সাবেক মহাপরিচালক ড. জাহাঙ্গীর আলম নিয়ম বহির্ভূতভাবে সংগীত শিল্পীদের যে অডিশন সম্পন্ন করেছেন এ ব্যাপারে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ঢাকা কেন্দ্রে নিয়মবহির্ভূতভাবে ও অনুমোদন ছাড়াই ১৩ কোটি ২৮ লাখ টাকা অতিরিক্ত খরচ দেখিয়ে মাহফুজা আক্তারের নেতৃত্বে মোল্লা আবু তৌহিদসহ সিন্ডিকেটের সদস্যরা মিলে যে লুটপাট করেছে তার বিরুদ্ধে গঠিত তদন্ত কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ী সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে কেন এখন পর্যন্ত আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি তা জানাতে হবে।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন একুশে পদকপ্রাপ্ত সুরকার ও সংগীত পরিচালক এবং সংগঠনটির আহ্বায়ক শেখ সাদী খান, সংগঠনটির সদস্য সচিব ও বিটিভির বাদ্যযন্ত্রী শিল্পী (ড্রামার) পলাশ কুমার সাউ প্রমুখ।
বাংলাদেশ সময়: ১৬৪০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২২, ২০২৪
ইএসএস/আরআইএস