ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

বিনোদন

হায়দার হোসেনের ‘স্বাধীনতা’ গান নিয়ে বিতর্ক

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫০৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৬, ২০১৫
হায়দার হোসেনের ‘স্বাধীনতা’ গান নিয়ে বিতর্ক

‘কি দেখার কথা কি দেখছি/কি শোনার কথা কি শুনছি…/৩০ বছর পরেও আমি স্বাধীনতাটাকে খুঁজছি-’ বাস্তবধর্মী এমন কথার গান গেয়ে জনপ্রিয়তা পেয়েছেন সংগীতশিল্পী হায়দার হোসেন। প্রকাশের পর থেকে গানটি শ্রোতার মুখে মুখে।

লেখা ও সুর করার পাশাপাশি এটি কণ্ঠে তুলেছেন হায়দার।

এবার গানটি নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে এর লিরিক নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন জনপ্রিয় ছড়াকার লুৎফর রহমান রিটন। গত ১ ডিসেম্বর গানটির অধিকাংশ পঙক্তির ব্যাখ্যা দিয়ে হায়দার হোসেনের উদ্দেশে একটি খোলা চিঠি পোস্ট করেছেন তিনি। লেখাটি ইতিমধ্যে দেড় শতাধিকবার শেয়ার হয়েছে, মন্তব্য করেছেন অনেকেই। রিটনের সঙ্গে সুর মিলিয়ে মন্তব্যকারীদের অনেকেই বলেছেন, গানটি স্বাধীনতা বিরোধী শক্তির পক্ষের বক্তব্য এবং গানটিতে সুক্ষ্ণভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে ‘তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য’ করা হয়েছে। এদিকে রিটনের উদ্দেশে খোলা চিঠির জবাবে সামহোয়্যারইনব্লগ ও ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছেন অনেকে। সব মিলিয়ে গানটি নিয়ে ‘বিতর্ক’ জমে উঠেছে।      

রিটন তার স্ট্যাটাসে প্রশ্ন তুলেছেন, ‘আমার খটকা লাগে কেনো আপনি (হায়দার হোসেন) তিরিশ বছর পর স্বাধীনতাটাকে খুঁজছেন? ওটা কি হাতছাড়া হয়ে গেছে? গানের বেশ কয়েকটি লাইন নিয়ে তিনি প্রতিবাদ জানিয়েছেন।

‘স্বাধীনতা কি বৈশাখী মেলা, পান্তা ইলিশ খাওয়া?’ এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে রিটন লিখেছেন, “জ্বী জনাব, এটা আমরা অর্জন করেছি। এটাকে বন্ধ করতে স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি বাংলা নববর্ষের অনুষ্ঠানে বোমা ফাটিয়ে হত্যা করেছিলো নিরীহ বাঙালিকে। আমাদের হাজার বছরের বাংলা সংস্কৃতিকে স্তব্ধ করতে ওরা হামলা করেছিলো রমনায় ছায়ানটের পহেলা বৈশাখ উদযাপন অনুষ্ঠানে। বৈশাখী মেলার আয়োজন করা, ওখানে পান্তা-ইলিশ খাওয়া এবং রবি ঠাকুরের ‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো’ গানটি গাইতে পারাই আমার স্বাধীনতার প্রতিচ্ছবি। ”

গানটির আরেক লাইন ‘স্বাধীনতা কি বটমূলে বসে বৈশাখী গান গাওয়া?’র জবাবে রিটন লিখেছেন, ‘অবশ্যই। সেই ষাটের দশকে রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধ করার বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিবাদ আর প্রতিরোধ হয়েছিলো এই বাংলায়। সেদিন, ওয়াহিদুল হক প্রমুখের নেতৃত্বে ছায়ানটের ছায়াতলে সমবেত হয়েছিলেন বাঙালির মুক্তবুদ্ধি আর মুক্তচিন্তার অগ্রদূতরা। রমনার বটমূলে বসে বৈশাখী গান গাইতে পারার স্বাধীনতাই আমার স্বাধীনতা। ’

‘স্বাধীনতা কি বুদ্ধিজীবির বক্তৃতা সেমিনার?’ রিটন এর ব্যাখ্যা দিয়েছেন এভাবে, ‘নিশ্চয়ই। বুদ্ধিজীবীর বক্তৃতা সেমিনার যাতে এইদেশে না হয় সেজন্যই তো পরাজয়ের পূর্বাহ্নে ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর তালিকা ধরে ধরে বুদ্ধিজীবী নিধনে মেতে উঠেছিলো নিজামী-মুজাহিদের রাজাকার আর আলবদর বাহিনী। ’
 
‘স্বাধীনতা কি শহীদ বেদিতে পুষ্পের সমাহার?’ এর উত্তর দিয়েছেন রিটন, ‘অতি অবশ্যই, একাত্তরে আমাদের শহীদ বেদি গুঁড়িয়ে দিয়েছিলো পাকি সৈন্যরা। ওখানে ফুল দেওয়াকে ধর্মান্ধ ও যুদ্ধাপরাধী এবং তাদের দোসররা নাজায়েজ মনে করে, এখনও। অধর্মের কাজ বলে মনে করে। হিন্দু সম্প্রদায়ের পূজার সঙ্গে গুলিয়ে ফেলে। অথচ ফুলেলশ্রদ্ধা পৃথিবীব্যাপী স্বীকৃত একটি আন্তর্জাতিক রেওয়াজ। শহীদ বেদিতে পুষ্পের সমাহারই প্রমাণ করে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে আমরা বিজয়ী হয়েছি। আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি। শহীদ মিনার আমার স্বাধীনতার প্রতীক। একুশে ফেব্রুয়ারিতে, ছাব্বিশে মার্চে এবং ষোলই ডিসেম্বরে শহীদ মিনারে স্মৃতিসৌধে পুষ্পার্ঘ অর্পণ আমার স্বাধীনতারই আনুষ্ঠানিক বহিঃপ্রকাশ। ’

‘স্বাধীনতা কি গল্প নাটক উপন্যাস আর কবিতা?’-এই লাইনটির ব্যাখ্যা এসেছে এভাবে, ‘জ্বী স্যার, একাত্তরে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রিয় সংগীত ছিলো ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি। ...নতুন একটি কবিতা লিখতে যুদ্ধ করি...নতুন একটি গানের জন্যে যুদ্ধ করি.. ’ স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত এই গানটি এখনও শিহরণ জাগায় রক্তে। আমি আমার গল্প লিখবো, নাটক লিখবো, উপন্যাস আর কবিতা লিখবো- এটাই তো আমার স্বাধীনতা জনাব!’

‘স্বাধীনতা কি আজ বন্দি আনুষ্ঠানিকতা?’ ‘নাহ্। শুধু আনুষ্ঠানিকতায় বন্দি নয় স্বাধীনতা। স্বাধীনতা আছে বলেই, পেয়েছি বলেই আপনি এই গান গাইতে পারছেন। স্বাধীনতা আছে বলেই আপনার হাতে গিটার। যন্ত্রাণুষঙ্গযোগে আপনি গান গাইছেন। স্বাধীনতা না এলে আপনি হতেন সাইমুম শিল্পী গোষ্ঠীর সদস্য। ’

আরও কিছু লাইনের ব্যাখ্যা দিয়ে রিটন লিখেছেন, ‘স্যার আপনার গানে রাজাকারের কথা নেই যে! ঘাতক দালালের কথা? যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কথা কই? এককথায় স্বাধীনতাবিরোধীদের কথা কই এই গানে? তিরিশ বছর পরের বাস্তবতায় ‘'স্বাধীনতা কি রাজাকারদের মন্ত্রী হবার দৃশ্য’ কিংবা ‘স্বাধীনতা কি খুনির গাড়িতে জাতীয় পতাকা উড্ডীন’ ধরণের একটি চরণও ঠাঁই পায়নি এই গানে। অথচ সেটা পেতে পারতো। তিরিশ বছর পরের বাস্তবতায় সেটাই স্বাভাবিক ছিলো। এই গানে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একটা সুশীল অবস্থান লক্ষণীয় যে অবস্থান আখেরে জামাতিদের পক্ষে চলে যায়। ’

হায়দার হোসেনের উদ্দেশে রিটন সবশেষে লিখেছেন, ‘প্রিয় হায়দার হোসেন, স্বদেশে এবং বিদেশে বিপুলভাবে জননন্দিত একজন শিল্পী আপনি। শিক্ষিত রুচিস্নিগ্ধ অমায়িক আচরণসম্পন্ন মার্জিত একজন শিল্পী হিসেবে আপনার গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নাতীত। আপনি একজন দেশপ্রেমিক নাগরিক, আমি জানি। আমি জানি এই গানটি লেখার পেছনে নিশ্চয়ই কিছু কারণ আছে, কিছু যুক্তি আছে আপনার। আপনার বিখ্যাত এই গানটি প্রায়শ আমাকে বিষণ্ণ করে ফেলে। বিপন্ন করে ফেলে। বিজয়ের মাসে আমি সেই বিষণ্ণতার কথাই জানাতে এসেছি। ’

বাংলাদেশ সময়: ১৪৪৯ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৬, ২০১৫
এসও/জেএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।