ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

বিনোদন

ভাওয়াইয়া গানের যতো বাদ্যযন্ত্র

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫২৭ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৫, ২০১৭
ভাওয়াইয়া গানের যতো বাদ্যযন্ত্র ছবিতে ডানে ভাওয়াইয়া শিল্পী শাহাজাহানের হাতে বেহলা, মাঝে রইস উদ্দিনের হাতে দোতরা। ছবি: বাংলানিউজ

ঢাকা: ‘পিরীতি কী গাছে ধরে/ হাত বাড়েইলে নাগাল মিলে/ দিলে দিলে না মিলিলে/ কথায় কী আর রত্ন মিলে?’ প্রেমিকের কণ্ঠে শেকড়ের গান ভাওয়াইয়া আর দোতরার ‘টুং-টাং’ শুনে ঘরে মন বসছে না অষ্টাদশী তরুণীর।

তাই তিনি ছুটে এসেছেন দোতরা বাদক প্রেমিকের কাছে। দুই তারের টু-টাং আওয়াজ তাকে উদাসিনী করে তুলেছে।

তাই তো তরুণীটিও গেয়ে ওঠেন, ‘তোমার ভাওয়াইয়া গান আর/ দোতরার বাইজনে থাকিনা না পাং ঘরে/ ওরে কুলের বাহির করিলেন মোক/দোতরায় জাদু ভরেয়া। ’
 
দোতরা-আকর ভূমি রংপুরের শেকড়ের গান ভাওয়াইয়ার মূল বাদ্যযন্ত্র। দিনভর সংসারের খোরাক যোগাতে যে কৃষক-দিনমজুর মাঠে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করেন-সেই তিনিই সন্ধ্যে বেলায় কুঁড়ে ঘরের সামনে ছোট্ট উঠোনে পাটি বিছিয়ে মনের খোরাক যোগাতে মজে যেতেন ভাওয়াইয়ায়।    

তবে হাল-আমলে দোতরা-সারিন্দার জৌলুশ কমে গেলেও বৃহত্তর রংপুরের গ্রামাঞ্চলে এখনও বসে ভাওয়াইয়ার আসর। যন্ত্রে ভাগ বসিয়েছে হারমোনিয়াম, গিটার, তবলা, বেহালাসহ হালের নানা বাদ্য বাদ্য।

ভাওয়াইয়ার নিজস্ব বাদ্যযন্ত্রের মধ্যে করকা, ঢোলক, বেঞ্জু, সানাই, একতারা, খঞ্জরী, খমক ও ঘুণ্টিসহ দেশীয় নানা বাদ্য। তবে এ বাদ্যি শুধু যে ভাওয়াইয়াতে ব্যবহৃত হয় তা নয়, বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলার নিজস্ব লোকজ গান বাউল, জারি-সারি কিংবা যাত্রাপালার গানেও  তাল  এবং  ছন্দ  ঠিক রেখে যাচ্ছে গায়ক ও বাদকের।

কুড়িগ্রামের উলিপুরে ভাওয়াইয়া একাডেমি প্রাঙ্গণে একটি সারিন্দা।  ছবি: বাংলানিউজভাওয়াইয়া গবেষক ও শিল্পী ভূপতি ভূষণ বর্মা বাংলানিউজকে বলছিলেন, ভাওয়াইয়া হচ্ছে উত্তরবঙ্গের মাঠে-ঘাটে খেটে-খাওয়া মানুষের গান। এ গানেই  গ্রামীণ মানুষের যাপিত জীবনের নানা কথা, প্রেম-ভালোবাসা, স্বামী-স্ত্রীর দ্বন্দ্ব, গৃহস্থালী কাজ-কর্ম, দেবর-ভাবির সম্পর্ক, বিয়ে-যৌতুক, নতুন বৌয়ের নাইয়র, সমাজচিত্র, অতিথি আপ্যায়ন, বন্যা-নদী ভাঙনের কথা রয়েছে। আছে মানবমনের আধ্যত্মিকতাও।

‘নিজেরা যা দেখেছেন ভাওয়াইয়া গীতিকার কিংবা শিল্পীরা তা দিয়েই গান রচনা করেছেন। নিজেই গেয়ে মানুষকে আনন্দ দিয়েছেন। ওই সময় বাদ্যযন্ত্র কোথাও পাওয়া যেতো না। পাওয়া গেলেও এসব মানুষের তখন কেনার সাধ্য কিংবা সুযোগ ছিলো না। তাই নিজেরাই কাঠ, বাঁশ দিয়ে দোতরা কিংবা সারিন্দার মতো বাদ্যযন্ত্র তৈরি করে বাজিয়েছেন, গেয়েছেন। ’
 
দোতরা নিয়ে ভাওয়াইয়া শিল্পী ভূপতি ভূষণ বর্মা জানান, বহুল ব্যবহৃত লোকপ্রিয় দোতরা দেখতে সরোদের মতো। নাম দোতরা হলেও এতে দুই, চার বা পাঁচটি তারও ব্যবহার করা হয়। পটারী বা দণ্ডের মতো অংশটি কাঠের।

 সারিন্দা হাতে বাদক শিরীষ চন্দ্র বর্মা।  ছবি: বাংলানিউজ‘তার উপর ধাতব পাত মোড়ানো থাকে। নিচের গোল অংশে থাকে পশুর চামড়ার ছাউনি। এর উপর সওয়ারী বসিয়ে তার উপর দিয়ে টান করে প্রয়োজনীয় সংখ্যক কান (কাঠের তৈরি খিলি) এর সঙ্গে তার পেঁচিয়ে দেওয়া হয়। ’

জাতীয় তথ্যকোষ বাংলাপিডিয়ায় বলা আছে, লোকগান যেমন সাধারণ মানুষের মনের কথা, তেমনই বাদ্যযন্ত্রের উপকরণও নিতান্তই সাধারণ এবং এর গঠন-প্রণালীও সহজ-সরল। লাউয়ের খোল, বেল বা নারিকেলের মালা, বাঁশ, কাঠ, নল, পাতা, মাটি, লোহা, পিতল, সুতা, তার, শিং, শঙ্খ ছাড়াও দেশজ উপাদান দিয়ে বাদ্যযন্ত্র তৈরি হয়।

কাঁসা, পিতল প্রভৃতি ধাতব পদার্থ দিয়ে খঞ্জনি, ঘণ্টা জাতীয় ঘনযন্ত্র এবং গরু, ছাগল ও সাপের চামড়া দিয়ে ঢাক, ঢোল, মাদল বানিয়ে থাকেন গ্রামীণ মানুষজন।

তবে হাল আমলে এসবের উপস্থিতি অনেক কমে গেছে। ভাওয়াইয়া শিল্পী ভূপতির ভাষায়, গ্রামে-গঞ্জে এখনও রংপুরের যেসব জায়গায় ভাওয়াইয়ার চর্চা হয়, তাতে নিত্যনতুন বাদ্য যুক্ত হয়ে গেছে। এর মধ্যে ঢোলকের বদলে তবলা, দোতরার বদলে গিটার ছাড়াও নিজস্ব বাদ্যিতে ভাগ বসিয়েছে বেহালা, হারমোনিয়াম, সানাই, সন্তুর, সেতার, এস্রাজ (সেতার জাতীয়), গিটার ইত্যাদি।

‘তাই আগের মতো গ্রামাঞ্চলেও এখন দোতরা, সারিন্দা পাওয়া যায় না। কুড়িগ্রামে এখন প্রবীণদের মধ্যে উলিপুরের বাংলাদেশ ভাওয়াইয়া একাডেমিতে কেবল শিরীষ চন্দ্রই রয়েছেন, যিনি সারিন্দা বাজান। তেমনই অভাব রয়েছে দোতরা বাদকেরও। ’
 
তবে ঐতিহ্য রক্ষায় রংপুর অঞ্চলে কোনো কোনো শিল্পী নিজে দোতরা বাজিয়ে গান করেন বলে জানান উলিপুর ভাওয়াইয়া একাডেমির এই পরিচালক।
 
শিরীষ বাংলানিউজকে জানান, শৈশবেই বাবার সঙ্গে মাঠে কাজ করার সময় এরপর আববাসউদ্দীন ছাড়াও ‘ও কী গাড়িয়াল ভাই’,   ‘যে জন প্রেমের ভাব জানে না’, ‘কোন দ্যাশে যান মইশাল বন্দুরে’, ‘নউতোন পিরিতির বড় জ্বালা’ ছাড়াও রঙ্গগীতি চটকা ও ভাওয়াইয়া গান শোনেন বাবা-চাচাদের কণ্ঠে। দোতরা, সারিন্দার সঙ্গেও তখনই তার পরিচয়। কিছুদিন স্কুলে গেলেও অভাবের সংসারে আর পড়াশোনা এগোয়নি।

‘তখন থেকেই কাজের ফাঁকে উস্তাদের পাশে বসে আয়ত্ত করেছি। এখন শিশু-কিশোরদের শেখাই-নিজে বাজিয়েও তৃপ্তি পাই,’ বলছিলেন তিনি।    

তবে নিত্য নতুন বাদ্যি এলেও এখনও নিজেই দোতরা বাজিয়ে গান করেন পুরস্কারপ্রাপ্ত ভাওয়াইয়া শিল্পী রণজিৎ কুমার রায়। বয়স পঁয়ত্রিশ থেকে চল্লিশের ঘরের এই শিল্পী বলেন, ভাওয়াইয়ার মূল বাদ্য দোতরা, তখন এতো বাদ্যের সমাহার ছিলো না। কিন্তু এখন সংগীতের ক্ষেত্র অনেক উন্নত হয়েছে। রেডিও কিংবা টেলিভিশন ছাড়াও অন্যান্য জায়গায় অনুষ্ঠানেও পরিবেশনের মান বেড়েছে।

তবে এখনও দোতরা হাতে থাকলেই তার ভাওয়াইয়া প্রাণ পায় বলেই জানালেন টেলিভিশন ও বেতারের এই শিল্পী।

জানা যায়, ভাওয়াইয়া উত্তরবঙ্গের নিজস্ব লোকগীতি হলেও জন্ম রংপুর ও ভারতের কুচবিহার জেলায়। যা এই বঙ্গ ছাড়াও বৈশ্বিকেভাবে জনপ্রিয় করেছেন আববাসউদ্দীন আহমদ।

বাংলাদেশ সময়: ২১১৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৫, ২০১৭
এমএ/জেডএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।