ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

বিনোদন

বন্ধ হয়েই গেলো রাজশাহীর ‘উপহার’

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২২০ ঘণ্টা, অক্টোবর ১২, ২০১৮
বন্ধ হয়েই গেলো রাজশাহীর ‘উপহার’ রাজশাহীর নামকরা সিনেমা হল ‘উপহার’। ছবি: বাংলানিউজ

রাজশাহী: বন্ধ হয়ে গেছে রাজশাহীর সর্বশেষ সিনেমা হল ‘উপহার’। শাকিব খান, নুসরাত ফারিয়া, সায়ন্তিকা অভিনীত ‘নাকাব’ সিনেমাটি ছিল এই হলের শেষ প্রদর্শিত শো।

বৃহস্পতিবার (১১ অক্টোবর) রাত ১২টা পর্যন্ত এর শেষ শো চলে। শুক্রবার (১২ অক্টোবর) থেকে হলটির কার্যক্রম পুরোদমে বন্ধ করে দেওয়া হয়।

ফলে এর মধ্যে দিয়ে বিভাগীয় শহর রাজশাহীতে সিনেমা হল এখন ইতিহাস হয়ে গেলো।  

সাড়ে ২৪ কাঠা আয়তনের এই জায়গায় একসঙ্গে এক হাজার পাঁচজন দর্শক সিনেমা উপভোগ করতে পারতেন উপহার সিনেমা হলে। প্রায় সাত বছর হলো এনালগ রিল সরিয়ে ডিজিটাল মেশিনের মাধ্যমে ছবি প্রদর্শন করা হচ্ছিল। শ্রেণিভেদে টিকিটের দাম ১২০, ৭৫, ৫৫ ও ৪৫ টাকা। সকাল থেকে তিনটি শো চলতো হলটিতে।  

জানতে চাইলে রাজশাহীর সদ্য বন্ধ হয়ে যাওয়া উপহার সিনেমা হলের ব্যবস্থাপক তপন কুমার দাস বাংলানিউজকে বলেন, এটি ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান। তাই মালিকের নির্দেশনা অনুযায়ী বৃহস্পতিবার (১১ অক্টোবর) রাত ১২টা পর্যন্ত এ হলের শেষ শো চলে। এর পর শুক্রবার থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে সিনেমা হলটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। এর আগে রাতেই হল বন্ধের নোটিশ দিয়ে দেওয়া হয়েছিল বলেও জানান এই কর্মকর্তা।

তপন কুমার দাস বলেন, মূলত সিনেমা ব্যবসায় মন্দাভাবের কারণেই রাজশাহীর শেষ  হলটি বন্ধ হয়ে গেলো। এর আগে একেই কারণে আরও পাঁচটি সিনেমা হল বন্ধ হয়ে যায়। এবার বন্ধের সেই তালিকার শেষ নম্বরে যুক্ত হলো উপহারের নামও।

এর আগে মহানগরীতে প্রেক্ষাগৃহ ছিল ছয়টি। এগুলো হচ্ছে অলোকা পরবর্তী নাম স্মৃতি, কল্পনা পরবর্তী নাম উৎসব, স্নিগ্ধা পরবর্তী নাম উপহার, বর্ণালী ও লিলি। এছাড়াও মহানগরীর উপকণ্ঠ কাটাখালীতে ছিল নতুন পরবর্তী নাম রাজতিলক সিনেমা হল।

এগুলোর মধ্যে উপহার সিনেমা হলটিই বেঁচে ছিল দর্শক প্রিয়তায়। আর দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম প্রেক্ষাগৃহটি ছিল ‘বর্ণালী’ সিনেমা হল। এর আসন সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৩৭৩। বতর্মানে ওই হলেরও কোনো অস্তিত্ব নেই। অনেক আগেই ভেঙে ফেলা হয়েছে। মালিকের অনেক চেষ্টায় শেষ রক্ষা হয়নি মহানগরীর উপকণ্ঠে থাকা ‘রাজতীলক’ সিনেমা হলটি। দর্শক খরায় ২০১৪ সালে হলটি বন্ধ হয়ে যায় এটি। এছাড়া ‘স্মৃতি’, ‘লিলি’ ও ‘উৎসব’ প্রেক্ষাগৃহ ভেঙে ফেলা হয়েছে। এগুলোর কিছুই আর অবশিষ্ট নেই।

রাজশাহীর পুরোনো ‘অলোকা’ হল পরে ‘স্মৃতি সিনেমা’ হল নাম হয়। ভিক্টোরিয়া ড্রামাটিক ক্লাব ব্রিটিশ আমলে নাট্য আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে রাজা প্রমথ নাথ ‘টাউন হল’ নামে এটি গড়ে তোলেন। হলটিতে বাংলা সাহিত্য ও নাট্যচর্চা হতো। ১৯১৯ সালের ২ এপ্রিল ভিক্টোরিয়া ক্লাবের কাছ থেকে হলটি কিনে নেয় রাজশাহী অ্যাসোসিয়েশন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর রাজশাহী অ্যাসোসিয়েশনের কাছ থেকে ভাড়া নিয়ে সিনেমা প্রদর্শন করে আসছিলেন স্থানীয়রা। ২০০৭ সালে সিনেমা প্রদর্শন বন্ধ করে দিয়ে হলটি ভেঙে বহুতল বিপণিবিতান গড়ে তোলার কাজ শুরুর পর শেষ হয় ২০১২ সালে। স্মৃতি সিনেমা হল এখন নিজেই স্মৃতি হয়ে গেছে। সেখানে শোভা পাচ্ছে বাণিজ্যিক ভবন। তবে ওই এলাকাটি এখনও অলোকার মোড় বলেই পরিচিত।

মহানগরীর আরেকটি পুরনো সিনেমা হল ছিল ‘উৎসব’। আলুপট্টি এলাকায় থাকায় এই সিনেমা হলটির আগের নাম ছিল ‘কল্পনা’। পরে ‘উৎসব’ সিনেমা হল নামকরণ করা হয়। এই হলটিও ভেঙে ফেলা হয়েছে। ব্রিটিশ আমলে ‘রাজশাহী সিন্ডিকেট’ নামে ১৬ বিনোদন পিয়াসী ব্যক্তি এই সিনেমা হলটি চালু করেছিলের ‘কল্পনা’ নামে। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় কল্পনার অংশীদাররা সবাই ভারতে পাড়ি জমান। স্বাধীনতার পর রাজশাহী সিন্ডিকেটের ম্যানেজার দীনবন্ধুর দেশে ফিরে যোগসাজস করে সিনেমা হলটির নিয়ন্ত্রণ হস্তান্তর করেন ঢাকাস্থ প্রয়াত মোশারফ চৌধুরীর কাছে।

তার মৃত্যুর পর সহোদর সাইফুল ইসলাম চৌধুরীর নিয়ন্ত্রণ হস্তান্তর করেন রাজশাহীর রাজপাড়ার বাসিন্দা আব্দুর রহমানের কাছে। তিনি ‘কল্পনা’ নাম পরিবর্তন করে নতুন নাম দেন ‘উৎসব’। ২০১০ সালের জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে এই সিনেমা হলটিতেও চলচ্চিত্র প্রদর্শনী বন্ধ করে দেওয়া হয়। সেখানে এখন গড়ে উঠেছে ১৭তলা বিশিষ্ট স্বচ্ছ টাওয়ার। তবে কল্পনার মোড় বলে ওই এলাকাটি নাম রয়েই গেছে।

এদিকে পাকিস্তান আমলে মহানগরীর কাদিরগঞ্জ ও আমবাগান এলাকার মধ্যবর্তী এলাকায় বাবুল ও রুবেল চৌধুরীর উদ্যোগে নির্মাণ করা হয়েছিল ‘বর্ণালী সিনেমা’ হল। কাদিরগঞ্জ এলাকায় গড়ে ওঠা এই সিনেমা হলের নামেই এখনও এলাকাটি পরিচিত। ২০০৯ সালে সিনেমা হলটি কিনে নেয় ডেসটিনি-২০০০ গ্রুপের প্রতিষ্ঠান ডেসটিনি ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস সেন্টার। ২০১০ সালের শুরুতে সিনেমা হলটি ভাঙার কাজ শুরু হয়ে কয়েক মাসের মধ্যেই তা গুড়িয়ে দেওয়া হয়। প্রতিষ্ঠানটির বহুতল ভবন গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে বর্তমানে স্থানটি ঘিরে রাখা হয়েছে। সেখানে এখন মেলা বসে।

মহানগরীর বাইপাস এলাকার ‘লিলি’ সিনেমা হলটি ওই এলাকার বৃহৎ অংশের মানুষের বিনোদনের একমাত্র কেন্দ্র ছিল। টানা দুই বছর ধরে ব্যবসায় মার খাওয়া পর লোকসানি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হওয়ায় ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারিতে লিলি সিনেমা হলের প্রদর্শনীও বন্ধ করে দেওয়া হয়। পরে ঐতিহ্যবাহী এ সিনেমা হলের জায়গাটি প্লট আকারে বিক্রি করে দেওয়া হয়। মালিকের অনেক চেষ্টায় শেষ রক্ষা হয়নি মহানগরীর উপকণ্ঠে থাকা ‘রাজতীলক’ সিনেমা হলটি। দর্শক খরায় ২০১৪ সালে হলটি বন্ধ হয়ে যায়।

এভাবেই রাজশাহীতে সুস্থ বিনোদনের মাধ্যম সিনেমা হলগুলো কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে। উপহার বন্ধ হওয়ায় কফিনের শেষ পেরেকটিও ঠুকে দেওয়া হলো।

রাজশাহীর শেষ সিনেমা হলটিও বন্ধ হয়ে যাওয়ার ঘটনাটি নিয়ে এরই মধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকসহ সর্বত্র প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। হলটি ভাঙার প্রতিবাদে ইতোমধ্যে মানববন্ধন কর্মসূচি করা হয়েছে। এছাড়া সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় ও রাজশাহী সিটি মেয়র বরাবর স্মারকলিপি দেওয়া হয়েছে।

রাজশাহী ফ্লিম সোসাইটি ও রাজশাহী ঋত্বিক ঘটক ফিল্ম সোসাইটিসহ সমমনা সংগঠনসমূহের যৌথ উদ্যোগে এসব কর্মসূচি পালন করে।

বাংলাদেশ সময়: ১৮০৯ ঘণ্টা, অক্টোবর ১২, ২০১৮
এসএস/এএটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।