ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

বিনোদন

জীবন থেকে নেয়া: বাংলাদেশের অস্তিত্বের চলচ্চিত্র

মুহাম্মাদ আলতামিশ নাবিল, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪২০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৩০, ২০২২
জীবন থেকে নেয়া: বাংলাদেশের অস্তিত্বের চলচ্চিত্র জহির রায়হান

‘ছেলেটি এখনো ঢাকায় পড়ে আছে কেন? ওর যায়গা তো অনেক উপরে। ’

১৯৭০ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘জীবন থেকে নেয়া’ চলচ্চিত্রটি দেখার পর জহির রায়হানকে নিয়ে কালজয়ী চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় ঠিক এমন মন্তব্যই করেছিলেন! রোববার (৩০ জানুয়ারি) জহির রায়হানের অন্তর্ধান দিবসে তার অন্যতম সেরা কীর্তি, চলচ্চিত্র "জীবন থেকে নেয়া" নিয়ে কিছু কথা।

‘একটি দেশ/ একটি সংসার/ একটি চাবির গোছা/ একটি আন্দোলন/ একটি চলচ্চিত্র…’ সিনেমার শুরুটা হয় এই স্লোগানগুলো দিয়ে। সত্যিই তাই, স্বাধীনতার ৫০ বছরের এসে বিশেষ উপলব্ধি, ‘জীবন থেকে নেয়া’ শুধু আর চলচ্চিত্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি, হয়ে উঠেছিল পাকিস্তানের নিপীড়নের বিরুদ্ধে এটি একটি প্রতীকী আন্দোলন, যেখানে একটি সংসার পুরো দেশকে প্রতিকীরূপে উপস্থাপন করেছে।

সিনেমাটির স্মৃতিচারণায় জহির রায়হানের ঘনিষ্ঠ সহচর এবং ‘জীবন থেকে নেয়া’র সহ-রচয়িতা আমজাদ হোসেন জানান, একদিন এফডিসির পরিচালক সমিতির আড্ডায় জহির রায়হান তাকে এসে একটা গল্প লিখে দিতে বললেন। গল্পের দেখা যাবে দুই বোনের একজন আরেকজনকে দুধ খাইয়ে দিচ্ছেন। আবার গল্পের শেষে তারাই একজন আরেকজনকে বিষ খাইয়ে দেবেন! বাড়ির চাবি নিয়ে যুদ্ধ লাগবে।  

এই দুই বোনের দুধ খাওয়ানো ও বিষ খাওয়ানোর এমন ধারণায় তিনি একটা গল্প লিখতে বসে লিখে ফেললেন ‘জীবন থেকে নেয়া’। আর গল্পে প্রতীকিভাবে চলে এলো দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি। এর কারণও তিনি জানিয়েছেন স্মৃতিচারণায়। উনসত্তরের গণ–অভ্যুত্থানের সময় শহীদ হওয়া আসাদকে নিয়ে প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করতে অনুরোধ করেন মাওলানা ভাসানী। তবে তৎকালীন সরকারি চাপ ও তার পরিবারের অনুরোধে কাজটি বন্ধ হয়ে যায়। রাজনৈতিক বিষয়টি প্রতীকিভাবে আসার পেছনে রয়েছে এই সিনেমাটি নির্মাণ করতে না পারার প্রভাব।

আনিস ফিল্মস করপোরেশনের পরিবেশনায় জহির রায়হান নির্মিত ‘জীবন থেকে নেয়া’ মুক্তি পায় ১৯৭০ সালের এপ্রিলে। চলচ্চিত্রটিতে অভিনয় করেছিলেন রাজ্জাক, সুচন্দা, রোজী সামাদ, খান আতাউর রহমান, রওশন জামিল, আনোয়ার হোসেন, শওকত আকবরসহ আরো অনেকে। চলচ্চিত্রটির যখন দৃশ্যধারণ চলছিল, তখন সুচন্দা অন্তঃসত্ত্বা। শুরুতে দুই বোনের চরিত্র করার কথা ছিল সুচন্দা-ববিতার, পরে ববিতার অল্প বয়সের কারণে চরিত্র অদল-বদল হয়। বড় বোনের দায়িত্ব পান রোজী সামাদ এবং ছোটবোন হয়ে যান সুচন্দা। সিনেমাটিতে বাকিদের পাশাপাশি স্বৈরাচারী বাড়ির বউ চরিত্রে রওশন জামিলের অভিনয় আলাদাভাবে প্রশংসার দাবি রাখে।

চলচ্চিত্রটির কাহিনী গড়ে উঠেছে বাংলার আর দশটা সাধারণ পরিবারের মতই-একটি পরিবারকে কেন্দ্র করে। পরিবারটিতে দুই ভাই আনিস (শওকত আকবর) এবং ফারুক (রাজ্জাক), তাদের বড়বোন (রওশন জামিল) ও তার ঘরজামাই দুলাভাই (খান আতাউর রহমান)। রওশন জামিলের অত্যাচারে নিরীহ স্বামী এবং দুই ভাইয়ের বাড়িতে থাকা কঠিন, তাদের জীবনে স্বাধীনতা বলে কিছু নেই। এই বোনের চরিত্রটি দিয়ে মূলত পরিচালক পাকিস্তানি স্বৈরশাসকদেরই ভিন্ন রূপে উপস্থাপন করেছেন। বাড়িতে শান্তি আনতে আনিসকে গোপনে বিয়ে করান তার দুলাভাই, সাথী (রোজী সামাদ) নামের আরেক বাড়ির বড় বোনকে তাদের ঘরে তোলা হয়। অনুমতি ছাড়া বিয়ে করায় সাথী বউ হয়ে ঘরে আসলে তার উপর রওশন জামিলের অত্যাচারের খড়গ নেমে আসে।  

অপর দিকে সাথীর ছোট বোন বীথিকে (সুচন্দা) আগে থেকেই ভালবাসতেন ছোটভাই ফারুক। তাই বাড়িতে পাকাপোক্তভাবে শান্তি আনতে বীথি ও ফারুকেরও বিয়ে দেওয়া হয়। দুই বোন এক বাড়িতে বিয়ে করে আসায় স্বভাবতই রওশন জামিলের তাণ্ডব কমে যাওয়ার অনুমেয় ছিল। তবে এই মহিলার কুটচালে মায়ের পেটের দুই বোনই একে অপরের শত্রুতে পরিণত হয় যা বিষ খাইয়ে দেওয়া এবং আইন আদালত পর্যন্ত মোড় নেয়। তবে চলচ্চিত্রটির শেষ হয় এক স্থিতিশীল পরিস্থিতির অবতারণায়।

‘জীবন থেকে নেয়া’র সঙ্গীত একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। চলচ্চিত্রটির সঙ্গীত পরিচালনা করেন জহির রায়হানের অধিকাংশ সিনেমায় সঙ্গীতের ভার সামলানো সঙ্গীত পরিচালক, গায়ক ও অভিনেতা খান আতাউর রহমান। যুদ্ধের ঠিক আগের বছরই মুক্তি পাওয়া এই চলচ্চিত্রটির সংগীত মুক্তিযুদ্ধকালে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা আন্দোলনের বড় অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে। চলচ্চিত্রটিতে ব্যবহৃত হয়েছে আবদুল গাফফার চৌধুরী রচিত কালজয়ী গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গানটি যা পরবর্তীকালে একুশের প্রভাতফেরীর অত্যাবশ্যকীয় গান হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। এছাড়াও সিনেমাটির সঙ্গীত নিয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিকটি আমাদের জাতীয় সঙ্গীত প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। ১৯৬৭ সালের ২৩ জুন পাকিস্তানের তথ্যমন্ত্রী ঢাকার নবাব বংশোদ্ভূত খাজা শাহাবুদ্দিন এদেশের রেডিও ও টেলিভিশনে রবীন্দ্রসংগীত প্রচার নিষিদ্ধ করে এবং ঘোষণা দেয়, ‘রবীন্দ্র সংগীত আমাদের সংস্কৃতি নয়’ তা উপেক্ষা করে ‘জীবন থেকে নেয়া’ সিনেমায় ব্যবহৃত হয়েছিল রবিঠাকুরের ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটি।  

মুক্তিযুদ্ধের আগে থেকেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পছন্দের গান ছিল ‘আমার সোনার বাংলা’ যা যুদ্ধপরবর্তী স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে স্বীকৃতি পায়। চলচ্চিত্রটিতে ব্যবহার হয় কাজী নজরুল ইসলামের ‘কারার ওই লৌহ কপাট’ গানটি যা আন্দোলন কর্মীদের গুরুত্বকে পর্দায় ফুটিতে তোলে। পর্দায় খান আতার স্ত্রী থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে ছাদে গিয়ে গাওয়া ‘এ খাঁচা ভাঙবো আমি কেমন করে’ চিত্রায়নের মাধ্যমে পরিচালক রুপকভাবে ফুটিয়ে তোলেন নিজ দেশে থেকেও কেমনভাবে নিজ স্বাধীনতা প্রকাশে পরাধীন, অবরুদ্ধ আমরা।
চলচ্চিত্রটির দৃশ্যধারণ শুরু হয় ১৯৬৯ সালেই, সে বছর জহির রায়হান ২১শে ফেব্রুয়ারির প্রভাতফেরী ও নানা স্থানের মিছিলের দৃশ্যধারণ করেছিলেন। তবে সে সময় অবশ্য তার লেখা ‘আরেক ফাল্গুন’ উপন্যাস অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন তিনি। বানিজ্যিক চলচ্চিত্র নির্মাণের ভিড়ে নিজেকে খুঁজে ফিরছিলেন জহির রায়হান, সেই খুঁজে ফেরা সফল হলো ‘জীবন থেকে নেয়া’ চলচ্চিত্রটিত্রটির মাধ্যমে।  

অবশেষে ১৯৭০ সালের পহেলা ফেব্রুয়ারি শুরু হয় চলচ্চিত্রটির শুটিং। সিনেমাটি নিয়ে জহির রায়হানের সাক্ষাৎকার প্রকাশ পেলে সামরিক সরকার ঘাবড়ে গিয়ে গোপনে চলচ্চিত্রটির কাজ বন্ধ করার নির্দেশনা দেন তথ্য মন্ত্রণালয় ও এফডিসিকে। জহির রায়হানকে টেলিফোনে একটি মহল বিষ প্রয়োগে হত্যার হুমকিও দেয়। ১৯৭০ সালের ১১ মার্চ সামরিক আইন প্রশাসক রাও ফরমান আলী এই চলচ্চিত্রের নির্মাণকাজ বন্ধ করার জন্য নির্দেশ দেন পূর্ব পাকিস্তানের চিফ সেক্রেটারি শফিউল আজমকে। ১৩ মার্চ ‘জীবন থেকে নেয়া’র এক্সপোজড ফিল্ম আটকে দেওয়ার নির্দেশ দেয় সরকার। তবে এসব কারণে সিনেমাটি নির্মাণ থেকে তাকে কখনই পিছপা করতে পারেনি। এমনকি শুটিং চলাকালীন একদিন চলচ্চিত্রটির নায়ক রাজ্জাক ও জহির রায়হানকে ক্যান্টনমেন্ট নিয়ে গিয়ে বন্ধের হুমকি দেওয়া হয়।  

জহির রায়হানকে নিয়ে লেখা গবেষক অনুপম হায়াতের বই থেকে জানা যায়, নির্দিষ্ট তারিখে সিনেমাটি মুক্তি না পাওয়ার তাৎক্ষনিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে বাংলার জনগণ বিক্ষোভ প্রদর্শনপূর্বক মিছিল ও স্লোগান সহকারে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও চট্টগ্রামের কিছু সিনেমাহল আক্রমণ করেছিল। এমন উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে তৎকালীন সামরিক সরকার সিনেমাটিকে সেন্সর ছাড়পত্র দেয়। সেন্সর বোর্ড সিনেমাটির অনুমোদন দিয়েছিল বটে, তবে প্রজেকশন শেষে তৎকালীন জেনারেল রাও ফরমান আলী পরিচালকের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘চলচ্চিত্রটি ছেড়ে দিলাম, তবে আমি তোমাকে দেখে নেব। ’ সিনেমাটি মুক্তির পর দর্শকপ্রিয়ও হয়, টানা ২৫ সপ্তাহ ধরে সিনেমাটি চলে বিভিন্ন প্রেক্ষাগৃহে। ‘জীবন থেকে নেয়া’র পরিচালনার পাশাপাশি চিত্রনাট্যও জহির রায়হানেরই রচিত। চলচ্চিত্রটির দৃশ্যধারণ করেন আফজাল চৌধুরী।

মজার বিষয় অনেকটা কৌশলগত কারণেই শুরুতে এ সিনেমাটির নাম ছিল ‘তিনজন মেয়ে ও এক পেয়ালা বিষ’, এবং পরিচালক ছিলেন নূরুল হক বাচ্চু। পরে চলচ্চিত্রটির নাম ও পরিচালক পরিবর্তনের আবেদন করা হয়।

পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় চলচ্চিত্রটির বেশ কিছু প্রদর্শনী হয় এবং তৎকালীন ভারতের সেরা সব চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, তপন সিনহা, ঋত্বিক ঘটক সিনেমাটির ভূয়সী প্রশংসা করেন। সে সময়ে জহির রায়হানের সংসারে চলছিল অর্থনৈতিক দৈন্যদশা। তদুপরি চলচ্চিত্র প্রদর্শনী থেকে প্রাপ্ত অর্থ তিনি দান করে দেন মুক্তিযোদ্ধা তহবিলে! দেশমাতৃকার প্রতি সত্যিকারের প্রেম বোধহয় একেই বলে।

লেখক: চলচ্চিত্র গবেষক, লেখক ও  সমাজকর্মী

বাংলাদেশ সময়: ১৪২০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৩০, ২০২২
জেআইএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।