পাইকগাছা, (খুলনা) থেকে ফিরে: সূর্যটা হেলে পড়েছে, তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল। খুলনার পাইকগাছা লোনাপানি গবেষণা কেন্দ্রের পুরো প্রাঙ্গণজুড়ে সুনসান নীরবতা।
হঠাৎ চোখ যায় যে, পুকুর পাড়ে আমরা দাঁড়িয়ে আছি সেই পুকুরের অপর প্রান্তে। কেউ একজন পুকুর থেকে কলসিতে পানি ভর্তি করছেন এবং ভ্যান গাড়িতে তুলছেন। কৌতূহল হলো পুকুরের পানি কেন খাবার পানির কলসিতে। জানার সেই আগ্রহ টেনে নিয়ে গেলো পুকুরের অপর পাড়ে।
কথা বলে জানা গেলো লোকটার নাম আশরাফুল আলম (৩০)। থাকেন এখান থেকে ৫ কিলোমিটার দূরের মদিনা মসজিদ এলাকায়। প্রতিদিন খাবার পানি নেওয়ার জন্য এখানে আসেন। রান্না এবং খাবারের জন্য এই পুকুরের পানিই তাদের ভরসা। প্রতিদিন ভ্যান নিয়ে এসে নিজের ও পরিবারের জন্য পানি নিয়ে যান।
আশরাফুল জানালেন বেশ কয়েক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে কোন সুপেয় পানির টিউবওয়েল নেই। পুরো তল্লাটে মিঠা পানির পুকুর এই একটাই। পান এবং রান্নার জন্য এ পুকুরটাই তাদের একমাত্র ভরসা।
কিছুক্ষণ পরে মানুষের জটলা বাড়তে থাকলো। কলসি, হাঁড়ি, পাতিল ও প্লাস্টিকের বড় সাইজের বোতল নিয়ে আসছেন সবাই। নারীরা লাইন ধরে পুকুর থেকে পানি নিয়ে যাচ্ছেন। কেউ কেউ আবার ট্যাংকভর্তি করে এ পানি নিয়ে যাচ্ছেন বিক্রি করতে।
কথা হয় চম্পা রানি শীল, অমিতা শীল, সুমি রায়সহ কয়েকজন গৃহিনীর সাথে। তারা জানালেন নিত্য গৃহস্থালি কাজ ও খাওয়ার পানির জন্য এ পুকুরটাই তাদের ভরসা। তাদের বাড়িতে যে টিউবওয়েল আছে তা থেকে লোনা পানি উঠে। আছে আর্সেনিকও । পুকুরগুলোতেও লোনা পানি। কোনো উপায় না থাকায় পাশের শীলপাড়া থেকে প্রতিদিন এখানে পানি নিতে আসেন তারা।
পার্বতী রানি শীল নামের আরেক নারী জানান, প্রতিদিন আসা যাওয়ায় ১০ কিলোমিটার হেঁটে তিনি পানি নিয়ে যান। রিকশায় যাতায়াতে ৪০ টাকা খরচ হয়। পুকুর থেকে প্রতিদিন ১০/১২ লিটার পানি নিয়ে তাদের গৃহস্থালি কাজ-কর্ম সারতে হয়। পার্বতী রানি বলেন, শুধু তিনি নন, ১০/১২ কিলোমিটার দূরের গড়ই খালি, গদাইপুর ইউনিয়ন থেকেও মানুষ এখানে পানি নিতে আসেন।
তিনি জানান, অনেকে পুকুরের এই পানি মানুষের বাড়ি বাড়ি নিয়ে বিক্রিও করেন।
স্থানীয় জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, বঙ্গোপসাগরের সঙ্গে খুলনার পাইকগাছা-কয়রার নদ-নদীর সংযোগ। ফলে সাগরের নোনাপানি সরাসরি উপজেলার নদ-নদী ও ফসলের মাঠে সহজে পৌঁছে যায়। এর ফলশ্রুতিতে এখানে লোনাজলের আগ্রাসন প্রকট। শুষ্ক মৌসুমে নদীতে নোনা পানির মাত্রা বেড়ে যায়। পুকুরগুলোতেও থাকে লোনাপানি। টিউবওয়েলগুলোতে রয়েছে আর্সেনিক ও আয়রনের প্রবণতা।
এদিকে এভাবে শোধন ছাড়া পুকুরের পানি খাওয়া নিরাপদ নয় বলে মনে করছেন চিকিৎসকরা।
পাইকগাছা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসক নীতিশ গোলকার বলেন, এ অঞ্চলে সুপেয় পানির সংকট প্রকট। উপায় না পেয়ে মানুষ পুকুরের পানি পান করে। খোলা অবস্থায় থাকার কারণে এর মধ্যে অনেক ধরনের জীবাণু থাকে। শোধনহীন এ পানি খেয়ে মানুষ প্রতিনিয়ত ডায়রিয়া, আমাশয়, পেটের পীড়াসহ নানা ধরনের রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। হাসপাতালে এ ধরনের রোগীর সংখ্যাই বেশি।
এ প্রসঙ্গে কথা হয় বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের পাইকগাছা লোনা পানি কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও কেন্দ্র প্রধান ড. মো লতিফুল ইসলামের সঙ্গে।
তিনি বলেন, নদীমাতৃক বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যতম সুপেয় পানির আধার। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সুপেয় পানির আধার এখন ধুঁকছে। লবণাক্ততার প্রভাব পড়েছে পুরো উপকূলজুড়ে। সুপেয় পানির সংকটে ভুগছে উপকূলের সব বয়সের মানুষ। লবণাক্ততা ফসল উৎপাদনেও মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। পানির প্রবাহ জনিত ভারসাম্যতার কারণে সমুদ্রের লোনাপানি স্থলভাগের দিকে চলে আসে। ফলে জলোচ্ছ্বাস ও জোয়ারের পানি বাড়ার কারণে লোনাপানি স্থলভাগে প্রবেশ করে, ধারণা করা হচ্ছে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়লে লবণাক্ততাও বাড়বে। কম বৃষ্টির কারণে উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততার প্রভাব আরো বেশি মাত্রায় প্রভাব ফেলছে। সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলায়ও লবণাক্ততার সংকট প্রকট।
একই প্রসঙ্গে কথা হয় জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক শ্যামল দত্তের সঙ্গে। তিনি জানালেন, পদ্মা নদীর পানি প্রবাহ ঠিক না থাকায় লবণ পানি উঠছে। পদ্মার পানি প্রবাহ ঠিক থাকলে লবণ জলের আগ্রাসন এতটা প্রকট হতো না। নদীর পানি প্রবাহ ঠিক করা গেলে সংকটের সমাধান করা সম্ভব হতে পারে।
বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) তথ্যমতে, শুধু খুলনাঞ্চলে নয়, দেশের ৪১ জেলার ১৯২ উপজেলায় দেখা দিয়েছে তীব্র পানিসংকট। রাজধানীতে পানির স্তর ভূপৃষ্ঠ থেকে গড়ে ২১২ ফুট নিচে চলে গেছে। যে কারণে ভবিষ্যতে এখানকার পানিতে সমুদ্রের লোনাপানি চলে আসার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
বেসরকারি সংস্থা ওয়াটার এইডের গবেষণা অনুযায়ী, বাংলাদেশের দুই কোটিরও বেশি মানুষ নিরপাদ পানি থেকে বঞ্চিত ৷ তাদের তথ্য অনুসারে বাংলাদেশে প্রতিবছর পাঁচ বছরের কম বয়সী কমপক্ষে ৪ হাজার ১শ শিশু মারা যায় নিরাপদ পানি এবং স্যানিটেশন সুবিধার অভাবে৷ এছাড়াও সরকারি-বেসরকারি একাধিক সংস্থার গবেষণায় দেখা গেছে দেশের উপকূলীয় অঞ্চলসহ অনেক এলাকায়ই শুরু হয়েছে মরুকরণ প্রক্রিয়া। কারণ পানির স্তর অনেক নিচে নেমে গেছে।
ভরসা বৃষ্টির পানি:
সুপেয় পানির তীব্র এই সংকটে মানুষের ভরসা হয়ে উঠছে বৃষ্টির পানি। ইতোমধ্যেই খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরাসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় স্থানীয়রা নানাভাবে বৃষ্টির পানি সংগ্রহ করে সারা বছর পান করছে।
তবে এভাবে অনিরাপদভাবে বৃষ্টির পানি সংগ্রহ করে খাওয়াতেও ঝুঁকি রয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। কারণে বৃষ্টির পানিতেও কিছু ক্ষতিকারক উপদান থাকতে পারে। শোধন করে খেলে এ পানি নিরাপদ।
এমন একটি নিরাপদ বৃষ্টির পানি শোধনাগারের দেখা মিলে খুলনার পাইকগাছা উপজেলার গদাইপুর ইউনিয়নের মঠবাঢী জি জি পি জি দাখিল মাদ্রাসায়। মাদ্রাসাটিতে আগে কোনো সুপেয় পানির ব্যবস্থা ছিল না। যে টিউবওয়েলটি ছিল তার পানি পান করলেই পেটের পীড়ায় ভুগতো শিক্ষার্থীরা। বেসরকারি সংস্থা ওয়াটারএইড ও নবলোক যৌথভাবে এখানে রেইন ওয়াটার হারভেস্ট করে শিক্ষার্থীদের জন্য সারাবছরের পানীয় জলের ব্যবস্থা করেছে।
মাদ্রাসাটির প্রধান শিক্ষক এস এম আমিনুল ইসলাম বলেন, মাদ্রাসাটিতে ছাত্র-শিক্ষক মিলিয়ে ৩৬৫ জন রয়েছে। সবাই সারা বছর এখানে সংগ্রহ করা বৃষ্টির পানিই পান করে।
বেসরকারি সংস্থা ওয়াটার এইডের প্রোগ্রাম অফিসার এম এম মমশাদ বলেন, দুটি ট্যাংকে এখানে ২০ হাজার লিটার বৃষ্টির পানি সংগ্রহ করা যায়। বায়োলজিক্যাল ফিল্টারসহ কয়েক ধাপে শোধনের পর শিক্ষার্থীরা এই পানি পান করে। বৃষ্টির মৌসুমে সংগ্রহকৃত এই পানি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা সারা বছর পান করে।
মাদ্রাসাটির সহকারী শিক্ষক মো. লুৎফর রহমান বলেন, বাচ্চারা এখন সম্পূর্ণ নিরাপদ ফিল্টারিং পানি খায়। শিক্ষার্থীদের পানির কষ্ট এখন আর নেই।
হোসাইন আহম্মদ নামের এক শিক্ষার্থী বলে, বাড়ির পানির চাইতে মাদ্রাসার এই পানি অনেক ভালো, খেতে মজা।
ওই শিক্ষার্থী আরও বলে, ফিল্টারিং হওয়া বৃষ্টির এ পানি বাজারের মিনারেল ওয়াটার থেকেও খেতে ভালো।
বৃষ্টির পানি শোধনের এমন আরেকটি উদ্যোগ দেখা গেছে ৫০ শয্যার পাইকগাছা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। সেখানে অভিনব কায়দায় রোগী ও রোগীর স্বজনরা এ পানি সংগ্রহ করেন। হাসপাতালের একটি কক্ষে স্থাপন করা হয়েছে একটি ওয়াটার এটিএম। দুই টাকার একটি কয়েন দিলেই মিলছে দুই লিটার পানি।
হাসপাতালটির চিকিৎসক ডা. নীতিশ গোলকার বলেন, এই উদ্যোগটির ফলে হাসপাতালের রোগী ও স্বজনদের দীর্ঘদিনের সুপেয় পানির সংকটের সমাধান হয়েছে। হাসপাতালে আগতরা এখন নিরাপদ পানি পাচ্ছেন।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর বলছে, দেশের উপকূলীয় জেলায় প্রথমে শুরু হলেও পরে বিভিন্ন স্থানে রেইনওয়াটার হার্ভেস্টিং পদ্ধতি জনপ্রিয়তা পেয়েছে। দেশে নিরাপদ খাবার পানির উৎস হিসেবে বৃষ্টির পানি ধরে রাখার জন্য বিভিন্ন প্রকল্পের অধীনে কাজ চলমান। পৌর ও গ্রামীণ এলাকায় পানি, স্যানিটেশন, পয়ঃনিষ্কাশনসহ বেশ কয়েক ধরনের কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে সংস্থাটি। গ্রামাঞ্চলে পানি সরবরাহ প্রকল্পের অধীনে রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং কূপ স্থাপন করা হয়েছে। বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে স্থানীয় সরকার বিভাগ বৃষ্টি থেকে খাবার পানি সংগ্রহের কাজ করছে।
বাংলাদেশ সময়: ০৯১০ ঘণ্টা, মার্চ ০৭, ২০২৩
এসএইচডি/এএটি