লক্ষ্মীপুর: নদীতে ভাসছে ছোট ছোট ইলিশের মৃত পোনা। সেই সঙ্গে নদীর তীরবর্তী এলাকায় পড়ে আছে ইলিশ, রূপচাঁদা, বেলে, পোয়া, চিংড়িসহ নানা প্রজাতির লাখ লাখ মৃত পোনা মাছ।
নদীতে সব ধরনের মাছ শিকারে নিষেধাজ্ঞা চলছে, কিন্তু সেই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে 'বাঁধা' নামক এক ধরনের নিষিদ্ধ জাল দিয়ে মাছ শিকারের নামে ধ্বংস করা হচ্ছে সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদ ও জীববৈচিত্র্য।
বুধবার (১৯ এপ্রিল) সকাল ১১টার দিকে লুদুয়া মাছঘাটে গিয়ে দেখা, মেঘনা নদীতে প্রকাশ্যে মাছ শিকার করছেন জেলেরা। মেঘনা নদীর এ অংশে অন্তত ২০টি ট্রলারে করে জেলেরা মাছ ধরছেন।
বেশিরভাগ জেলে এখন বাঁধা নামক এক ধরনের জাল দিয়ে মাছ শিকার করছেন। এতে নদীতে থাকা ইলিশসহ সব ধরনের মাছ বাঁধা জালে উঠে আসে। বড় মাছের পাশাপাশি পোনাও মারা পড়ছে এ জালে। এতে একদিকে অভয়াশ্রমে জাটকা ইলিশ রক্ষা যেমন ব্যাহত হচ্ছে, অন্যদিকে ধ্বংস হচ্ছে সামুদ্রিক বিভিন্ন প্রজাতির অন্যান্য মাছসহ জীববৈচিত্র্য।
সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থা দেখা গেছে নদীর তীরবর্তী এলাকায়। বাঁধা জালে আটকা পড়া ইলিশের পোনাসহ বিভিন্ন প্রজাতির সামুদ্রিক মাছের লাখ লাখ মৃত পোনা পড়ে থাকতে দেখা গেছে। মাছের পাশাপাশি সামুদ্রিক বিভিন্ন জীবও মরে পড়ে আছে। নদীতে ভেসে থাকতে দেখা গেছে ইলিশের পোনাসহ অন্যান্য মাছ।
মাঝে মধ্যে মৎস্য প্রশাসন নদীতে অভিযান চালিয়ে জেল-জরিমানা করলেও নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না অসাধু জেলেদের।
অভিযোগ রয়েছে, স্থানীয় রাজনৈতিক, জনপ্রতিনিধি এবং প্রভাবশালীদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে জেলেরা নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে নির্বিঘ্নে মাছ শিকার করছেন।
জানা গেছে, ইলিশের উৎপাদন বাড়াতে জাটকা নিধন রোধ করা জরুরি। তাই জাটকা রক্ষার্থে মার্চ ও এপ্রিল দুই মাস দেশের বিভিন্ন নদীর বিভিন্ন অংশকে মাছের অভয়াশ্রম ঘোষণা করেছে সরকার। এর মধ্যে মেঘনা নদীর লক্ষ্মীপুর অংশের রামগতির আলেকজান্ডার থেকে চাঁদপুরের ষাটনল এলাকার ১০০ কিলোমিটার পর্যন্ত জাটকা ইলিশের অভয়াশ্রম হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ফলে জাটকা ইলিশ রক্ষায় মার্চ এবং এপ্রিল দুই মাস অভয়াশ্রমে সব ধরনের মাছ শিকার নিষিদ্ধ। এসময়টাতে শুধু মাছ শিকারই নয়, বেচা-কেনা, পরিবহনও নিষিদ্ধ। আইন অমান্যকারীদের কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ড দেওয়ার বিধান রয়েছে। জেলেদের মাছ শিকার থেকে দূরে রাখতে খাদ্য সহায়তা দিচ্ছে সরকার।
কিন্তু আইন এবং খাদ্য সহায়তা দিয়েও জেলেদের মাছ শিকার থেকে বিরত রাখা যাচ্ছে না। নিষেধাজ্ঞা অমান্য করেই জেলেরা নদীতে নেমে পড়েন।
স্থানীয়রা জানান, বাঁধা জাল দিয়ে মাছ শিকারের কারণে সব ধরনের পোনা মাছসহ ছোট-বড় সব ধরনের মাছ ধরা পড়ে। শুধু মাছই নয়, এর সঙ্গে ধরা পড়ে বিভিন্ন প্রজাতির জলজ প্রাণী। জেলেরা কাঙ্ক্ষিত মাছ রেখে বাকি সব ফেলে দেন তীরে। ফলে নদীর মাছসহ জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হচ্ছে এসব জালে।
নাম না প্রকাশে অনিচ্ছুক অনেকে জানান, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ রাজনৈতিক নেতারা জেলেদের শেল্টার দিচ্ছেন। ফলে প্রশাসনের অভিযানেও নদীতে রক্ষা করা যাচ্ছে না মৎস্য সম্পদ।
জানা গেছে, লুদুয়া মাছঘাটের সভাপতি হলেন উপজেলার পাটওয়ারীর হাট ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য মোসলেহ উদ্দিন। আর সাধারণ সম্পাদক চর ফলকন ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক সদস্য ও ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি মোসলেহ উদ্দিন।
এদিকে জেলা এবং উপজেলা প্রশাসন প্রায়ই নদীতে অভিযান চালায়।
উপজেলা মৎস্য প্রশাসন সূত্র জানায়, মঙ্গলবার (১৮ এপ্রিল) এ ঘাটে মৎস্য অধিদপ্তর ও কোস্টগার্ডের যৌথ অভিযান চালিয়ে প্রায় ৪০০ কেজি মাছ(১৫০ কেজি জাটকা ও ২৫০ কেজি সামুদ্রিক মাছ) জব্দ করা হয়েছে। পরে মাছগুলো এতিমখানা ও স্থানীয় দুস্থ মানুষের মধ্যে বিতরণ করা হয়।
এর আগের দিন ১৭ এপ্রিল রাতে উপজেলার মেঘনা নদীর অভয়াশ্রমে মৎস্য অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ কোস্টগার্ডের যৌথ অভিযানে দুটি বাঁধা জাল, একটি নৌকা ও ৩৫০ কেজি মাছ (জাটকা ৫০ কেজি, অন্যান্য মাছ ৩০০ কেজি) জব্দ করা হয়। তবে এসব ঘটনায় কোনো জেলেকে আটক করা হয়নি।
কমলনগর প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ইউসুফ আলী মিঠু বাংলানিউজকে বলেন, মাঝে মধ্যে প্রশাসন অভিযান চালালেও সার্বক্ষণিক নজরদারির অভাব রয়েছে। অভিযানে জেলেদের আটক করলেও জরিমানা করে ছেড়ে দেওয়া হয়। এতে জেলেরা দাদনদার বা আড়তদারের কাছ থেকে টাকা নিয়ে জরিমানা পরিশোধ করে পুনরায় মাছ শিকারে নেমে পড়েন। আটক জেলেদের কারাদণ্ড দেওয়ার বিধান রয়েছে, তাদের কারাদণ্ড দেওয়া হলে মাছ শিকার থেকে বিরত রাখা যেত।
তিনি বলেন, ঘাট ভিত্তিক স্থানীয় প্রভাবশালীরা প্রশাসনকে ম্যানেজ করে মাছ বিক্রি করছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কমলনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সুচিত্র রঞ্জন দাস বাংলানিউজকে বলেন, আমরা নদীতে এবং মাছঘাটে অভিযান চালাচ্ছি। তবে লোকবল সংকটের কারণে সার্বক্ষণিক নজরদারি করা যাচ্ছে না। এ সুযোগটা কাজে লাগাচ্ছেন অসাধু জেলেরা। ওই অঞ্চল (লুদুয়া) নিয়ে আমাদের কাছেও বিভিন্ন অভিযোগ আসছে। বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৯১৮ ঘণ্টা, এপ্রিল ২০, ২০২৩
এসআই