ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২ মাঘ ১৪৩১, ১৬ জানুয়ারি ২০২৫, ১৫ রজব ১৪৪৬

পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য

নিষিদ্ধ পলিথিনে কদর কমছে পরিবেশবান্ধব ‘ঠোঙা’র

মুশফিক সৌরভ, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৩২ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৬, ২০২৫
নিষিদ্ধ পলিথিনে কদর কমছে পরিবেশবান্ধব ‘ঠোঙা’র কাগজের ঠোঙা

বরিশাল: দেশে পলিথিন নিষিদ্ধ। তাতে ভালো থাকার কথা ছিল কাগজপাড়ার মানুষদের।

কিন্তু তা না হয়ে, পলিথিন নিষিদ্ধ ঘোষণা হওয়ার পর যেন কাগজের তৈরি ঠোঙার ব্যবহার কমেছে দিন দিন।  

ঠোঙা তৈরির কারিগরদের অভিযোগ, নিষিদ্ধ পলিথিনের অবাধ ব্যবহার কমিয়েছে ঠোঙার চাহিদা। আর ব্যবসায়ীরা বলছেন, ক্রেতারা ঠোঙায় নয়; পলিথিন ব্যাগেই বেশি সন্তুষ্ট। তাই আধুনিক এ সময়ে ঠোঙার সঙ্গে তাদের বনিবনা কম।

যদিও বরিশালে এখনো নারীরা গৃহস্থালি কাজের পাশাপাশি ঠোঙা তৈরি করে থাকেন। তাদের তৈরি ঠোঙা বিক্রি করে যে অর্থ আসছে তা দিয়ে সংসারে সচ্ছলতার হাসি ফুটছে।  

বরিশাল নগরের নতুন বাজার এলাকার বাসিন্দা পঞ্চাশোর্ধ্ব পারুল বেগম ২০ বছরের অধিক সময় ধরে ঠোঙা তৈরির কাজের সঙ্গে জড়িত। তিনি বাংলানিউজকে জানান, সস্তার পলিথিনের কারণে দিন দিন কদর কমছে কাগজের তৈরি ঠোঙার। ফলে ঠোঙা তৈরির কাজে যারা জড়িত তাদেরও আয়-রোজগার কমে এসেছে। তারপরও অনেকেই এ কাজটির সঙ্গে এখন জড়িয়ে আছেন।  

তিনি বলেন, ঠোঙা তৈরিতে কাগজ, আটা, তুঁতে লাগে, এ সবকিছুরই দাম এখন বাড়তি। ফলে ঠোঙার দামও আগের মতো নেই, এখন প্রতিকেজি ঠোঙা পাইকারি বাজারে তারা আকারভেদে ৬৫ থেকে ৭০ টাকায় বিক্রি করেন। আর এতে কেজিতে ১০-১৫ টাকার মতো লাভ থাকে তাদের।

পারুল বেগম বলেন, শুধু নিষিদ্ধ পলিথিনের কারণে বাজারে ঠোঙা কদর নেই। কিন্তু যখন পলিথিনের প্রচলন কম ছিল তখন ঠোঙার কদর ছিল। সময়ের সঙ্গে বিভিন্ন সামগ্রীর দাম বাড়ায় ঠোঙার দামও বেড়েছে কিন্তু বিক্রি কমেছে। অথচ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পলিথিনের দাম কমে এখন সেটি পাওয়া যাচ্ছে সর্বত্র। অপরদিকে ঠোঙা পরিবেশবান্ধব হলেও পলিথিন কিন্তু পৃথিবীর জন্য ক্ষতিকর। মাটির নিচে চাপা পড়লেও পচে না এবং সেখানে গাছপালাও হয় না।

চাহিদা বাড়লে উৎপাদনের ঘাটতি হবে না জানিয়ে তুলি বেগম নামে অপর এক ঠোঙার কারিগর বলেন, শুধু বরিশাল শহরে এলাকাভিত্তিক অনেক জায়গাতে ঠোঙা এখনো তৈরি হয়। আবার চাহিদা কম থাকায় লাভ কম হওয়ায় ঠোঙা তৈরির কাজ অনেকে ছেড়েও দিয়েছেন। তবে চাহিদা থাকলে এলাকাভিত্তিক উৎপাদনে গেলে ঠোঙার কোনো সংকট হবে না। সেখানে কাগজ, আট ও তুঁতের যোগানও ঠিকমতো থাকতে হবে।

তিনি জানান, গৃহকর্মীর কাজের পাশাপাশি প্রতিদিন সন্ধ্যায় ঠোঙা বানাতে বসেন। এভাবে প্রতি দুইদিনে পাঁচ কেজি ঠোঙা বানিয়ে বাজারে বিক্রি করেন তিনি। তবে চাহিদা বাড়লে এর উৎপাদন দ্বিগুণ বা তিনগুণ করাও সম্ভব। ঠোঙা বিক্রির লাভের টাকায় আর গৃহকর্মীর কাজ করে তার সংসার দিব্বি ভালোভাবে এগিয়ে যাচ্ছে।

তার মতো গোটা সংসার ঠোঙা বানিয়ে না চললেও ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনার খরচ যোগাতে পারছেন কাজল মহুরী। তিনি বলেন, স্বামীর উপার্জনের পাশাপাশি আমি ঠোঙা বানিয়ে যা আয় করছি তা দিয়ে সন্তানদের পড়াশোনার খরচ উঠে যাচ্ছে। আবার সংসারের টুকটাক জিনিসও ঠোঙা বিক্রির টাকায় কিনতে পারছি, ফলে স্বামীর বাড়তি আয়ের জন্য চাপ নিতে হচ্ছে না।

যদিও পলিথিনের ব্যাপক বিস্তারের পর থেকেই ঠোঙার কদর দিন দিন কমছে জানিয়ে লিজা আক্তার বলেন, পলিথিন নিষিদ্ধ হলে ঠোঙার কদর বাড়বে, আর এর কদর মানেই বিশাল এক কর্মযজ্ঞ, যেখানে নারীদের আত্মনির্ভরশীল হয়ে ওঠার সুযোগ বেশি থাকবে।  

কারণ হিসেবে তিনি বলেন, উৎপাদন সামগ্রীর যোগান হলে ঠোঙা বানানো কাজটি ঘরে বসেই অবসর সময়ে করা যায়।

তিনি বলেন, ঠোঙা সাধারণত পাঁচ কেজি, আড়াই কেজি, দেড় কেজি আর ছোট আড়াইশত গ্রাম মালামাল নেওয়ার সাইজের তৈরি হয়। এর মধ্যে ছোট আকারের ঠোঙার দাম বেশি এবং মাঝারি আকারের ঠোঙার কদর বেশি।

তিনি বলেন, কয়েক বছর আগেও কাগজ কিনতাম ৩০-৩৫ টাকা কেজি দরে আর এখন কিনি ৫০-৫৫ টাকা দরে। বই কিনতাম ১০-১৫ টাকা কেজি দরে এখন কিনি ৩০-৩৫ টাকা দরে। সেইসঙ্গে বেড়েছে আটা ও তুঁতের দাম। ফলে আমাদের শ্রম বাদ দিলে প্রতি কেজি ঠোঙার পেছনে ৫০-৫৫ টাকার ওপরে খরচ হয়ে যায়। তাই আকারভেদে বড় ঠোঙাগুলি ৬৫ টাকা আর ছোট আকারের ঠোঙা ৭০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করা হয়।

তিনি বলেন, করোনার আগে যে ঠোঙার চাহিদা ছিল, এখন তাও নেই, তবে দোকান নির্ধারণ করে রাখায় এখনও বানানো ঠোঙা বাজারে বিক্রি করতে পারছি।  

তবে আগে যেভাবে মুদি, বেকারি ফল, হার্ডওয়ারের দোকানে ঠোঙার কদর ছিল এখন তেমনটা নেই জানিয়ে নতুনবাজার এলাকার ফল ব্যবসায়ী রুম্মান বলেন, ক্রেতাদের ঠোঙার প্রতি অনীহা বেশি। আগে যদি ফল মেপে তার ঠোঙায় ঢুকিয়ে দেই, তাতে কেউ ঠোঙায় নিতে চায় না। সবাই পলিথিন নয়তো নেটের ব্যাগের প্রতি দুর্বল।

একই কথা জানিয়েছেন বাজার রোডের ব্যবসায়ী সঞ্জয় কর্মকার। তিনি বলেন, ঠোঙার সঙ্গে মুদি ব্যবসার একটি আদি সম্পর্ক রয়েছে, যেটাকে বাংলার ঐতিহ্যও বলা যায়। তবে ঠোঙার ওজন বাদ দিয়ে সদাই মাপা হলেও এখন ক্রেতারা নানান কথা বলেন, তাই ঠোঙা ইচ্ছে থাকলেও ব্যবহার তেমন একটা করা যায় না। তবে পলিথিন থেকে ঠোঙায় মালামাল সতেজ ও ভালো থাকে সেটি ক্রেতারা বুঝতে চান না। পরিবেশবান্ধব কাগজের তৈরি ঠোঙার ব্যবহার বাড়াতে মানুষের আগ্রহই যথেষ্ট।

বাংলাদেশ সময়: ১০৩০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৬, ২০২৫
এমএস/এইচএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।