মৌলভীবাজার: ততক্ষণে আঁধার নেমে এসেছে। সেই সঙ্গে শীতের আমেজ।
সন্ধ্যে ৬টার পর চা-প্রেমী ক্রেতারা আসতে থাকেন সবান্ধবে। কেউবা একা। কেউবা দ্বৈতভাবে। তারপর শুধুই অপেক্ষার প্রহর। একটি-দুটি কিংবা একাধিক চুমুকের জন্য।
পার্শ্ববর্তী চা বাগান আর হাওরবেষ্টিত এ এলাকায় কুয়াশার কোল ঘেঁসে ধেয়ে আসে শীতের তীব্রতা। এই শীত যেন চুমুকে চুমুকে সেই উষ্ণতা ছড়িয়ে দেবার কথাই বলে ওয়াহিদের প্রতিটি চায়ের কাপে।
ব্যতিক্রমী আয়োজনে সজ্জিত নানাজাতের ‘চা’। এ দোকানের কর্ণধার আবদুল ওয়াহিদ। মৌলভীবাজারের মোকামবাজারে প্রেমনগর চা বাগানের পথপাশে তার এই বাক্সকেন্দ্রিক ছোট্ট চায়ের দোকান। নাম- ‘আল্লাহর হাওলা টি স্টল’। এক সময়ের স্থানীয় বাউলশিল্পী তিনি। গান করতে যেতেন হবিগঞ্জ-মৌলভীবাজার জেলার নানান প্রান্তরে। তাতে আসতো কিছু অর্থকড়িও। কিন্তু সময় বদলেছে। এখন বাউলগানের অনুষ্ঠানগুলো হারিয়েছে চিরায়ত ঐতিহ্য। তাতে যুক্ত হয়েছে অপসংস্কৃতি। ফলে এখন আর আসরে গিয়ে গান করেন না ওয়াহিদ।
টিকে থাকার ভাবনা থেকেই এই ব্যতিক্রমী চায়ের দোকান। নানান ধরনের অদ্ভুত নামের সব চায়ের সংমিশ্রণ। সেসব চায়ের নামসহ দাম দেখলেই বোঝা যায় – এমন নাম ইতোপূর্বে কোথাও আর নেই। যেমন- গার্লফ্রেন্ড গোলাপি মালাই চা (১৫০ টাকা), ব্রেকাপ মধু মালাই চা (১২০ টাকা), স্মার্ট কুরমা মালাই চা (১০০ টাকা), ফ্যামেলি নরমাল মালাই চা (৮০ টাকা), স্পেশাল কিসমিস চা (৬০ টাকা), ভুট্টার কপি চা (৪০ টাকা), তিলের গুড়া চা (৩০ টাকা), নরমাল দুধ চা (২০ টাকা)।
তবে নারিকেল দুধ চা (৩০ টাকা), বাদামি দুধ চা (২০ টাকা) এবং রং চা (১০ টাকা) এই তিন চায়ের বিক্রি সবচেয়ে বেশি।
এমন সব চায়ের নামকরণ প্রসঙ্গে আবদুল ওয়াহিদ বাংলানিউজকে বলেন, আমি মূলত বাউল মানুষ। মাথায় অনেক কিছুই খেলে! চায়ে স্বাদ ও আকর্ষণ দুটোর দিকে মাথায় রেখেই এ নামকরণ। এখন যখন বাউল পরিবেশ নষ্ট হয়ে গেছে, তাই ভাবলাম এ ব্যবসাটাকেই যেকোনোভাবে দাঁড় করতে হবে। এসব হিসেব করেই নামকরণ। বলতে পারেন, নিজস্ব একটা পরিচিতি। অনেকে ভাবে আমি মনে হয় কারো কাছ থেকে এগুলো শিখেছি, আসলে তা নয়। এসবগুলোই আমার নিজের সব আইডিয়া। এখন তো যত দিন যায়, ভাবি আরো নতুন কিছু এখানে যুক্ত করতে।
সিলেট, শায়েস্তাগঞ্জ, নবীগঞ্জ, মিরপুর, হবিগঞ্জ বহুদূর থেকে মানুষ আমার এখানে চা খেতে আসেন। এমনকি ঢাকা-চিটাগাং থেকে শ্রীমঙ্গল বেড়াতে আসা বিভিন্ন রিসোর্ট-গেস্টহাউজের অতিথিরাও আমার দোকানের চা পান করতে এসে থাকেন। মানুষের মুখ থেকে শুনে শুনে মানুষের এই আগমন বলে জানান তিনি।
‘গার্লফ্রেন্ড গোলাপী মালাই চা’ আর ‘ব্রেকাপ মধু মালাই চা’ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, অনেক প্রবাসীরাও মাঝে মাঝে আসেন। তারা দামি চা খেতে চান। তাদের কথা মাথায় রেখেই ‘এমন চা’। এগুলোতে উপাদান বেশি। তবে আমার দোকানে সবচেয়ে বেশি চলে নারিকেল দুধ চা আর বাদামি দুধ চা।
দৈনিক ব্যস্ততার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আগে ‘শ্বশুরবাড়ির জামাই আদর’ যে রকম করত তার থেকে বেশি সমাদর করতো একজন বাউলশিল্পীকে। এখন এগুলো কিছুই নাই। আমি এখন আর কোনো আসরে গান গাইতে যাই না। এখন এই দোকান নিয়েই পড়ে আছি। আগে শুধু রং চা বিক্রি করতাম। যখন-তখন গানের প্রোগ্রামের জন্য ডাক এলে দোকান বন্ধ করে চলে যেতাম। এখন দোকানটাকেই নিজের আইডিয়া দিয়ে বড় করে তুলেছি। এখানে আমার চায়ের দোকান সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত চলে। গ্রুপে গ্রুপে মানুষ চা পান করতে আসেন। আমার তো বিশ্রামের সময় নেই। আমার দুই ছেলেও এসে আমাকে সাহায্য করে।
ছোট ছেলে নূর ইসলাম তানজিম বলেন, আব্বুকে সাহায্য করতে আমি এবং বড়ভাই সন্ধ্যা থেকেই দোকানে থাকি। উনার নাম সাকু ইসলাম তামিম। আব্বুর পক্ষে একা এতো মানুষদেরকে চা তৈরি করে আবার সেই চা তাদের হাতে এগিয়ে দেয়া, তারপর কাপগুলো ভালোভাবে ধুয়া এগুলো একা কখনোই সম্ভব নয়। নানান উপকরণ দিয়ে আব্বু নিজেই প্রতিটা কাপের চা তৈরি করে থাকেন। ২০২৩ সাল থেকে চলছে আব্বুর এই বিরামহীন ব্যস্ততা। আগে যখন রং চা ছিল তখন তত ব্যস্ততা ছিল না।
‘সোনা বউ মালাই চা’ কী দারুণ নাম! এমন চা এর নাম তো কখনো শোনা হয়নি। এই চা সামনে আসছে বলে জানান তিনি। ‘স্বামী যদি বাসায় গিয়ে স্ত্রীর কাছে যদি এই চায়ের নাম ধরে একটু গল্প জুড়ে দিতে পারেন। তবেই স্ত্রী তার স্বামীকে সঙ্গে নিয়ে এখানে চা খেতে আসবেন’ এমন ধারণা থেকে আগামীতে আসবে সোনা বউ মালাই চা। দাম থাকবে ১০০ টাকা।
‘কাজ করতে করতে ক্লান্তি বা একঘেয়ে লাগা’র প্রসঙ্গেও তার অন্যরকম জবাব। তিনি বলেন, বরং এই চা বানানোর কাজ না করলে আমরা ভালোই লাগে না। কিছুক্ষণ বসে থাকলেই খারাপ লাগে। ব্যস্ত থাকতে খুবই ভালো লাগে আমার। রাত ১০টার পর এমনও হয় যে, সিটই পাওয়ার যায় না। সিরিয়াল পাওয়া যায় না। কাপের পর কাপ শুধু বানাতেই থাকি।
‘চা খাওয়া যাইবায়নি বা?’ – দুজন চায়ের দোকানের দরজায় এসেই সিলেটি ভাষায় প্রশ্ন করলেন চা ব্যবসায়ী ওয়াহিদ-কে। ‘১০ মিনিট লেইট হইবো’ -তৎক্ষণাৎ তার সোজাসাপ্টা জবাব। এমন জবাবে মনোক্ষুণ্ন হলেন না আগত ক্রেতাদ্বয়। কারণ, এমন করেই কথা বলতে অভ্যস্ত ওয়াহিদ। দোকানের বেঞ্চগুলো খালি থাকায় তারা দুজন ঝটপট বসে পড়লেন। তাদের একজনের নাম শাহজাহান। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, আমি নিয়মিত রং চা খেতে আসি। তার চা ভালো লাগে। তবে বিকেল ৪টাকে এ দোকানটা খোলা হলে তার কাস্টোমার এখানে আরো বাড়তো। বিকেলে যে কাস্টমারগুলো এখানে আসবেন, তারা রাত ৮টা/৯টার পর এখানে চা থেকে আসার মানুষ না।
চা সম্পর্কিত নানান আলোচনার ফাঁকে ধরা পড়লো না বলা কথা! প্রতিটি চায়ের কাপে কাপে ব্যবহার করা নানান ধরণের মিশ্রণ মেশিনের সাহায্যে তৈরি করতে প্রতিদিন ব্যয় হয় অনেকটা সময়। এর নেপথ্যে রয়েছেন ওয়াহিদের স্ত্রীর দৈনিক পরিশ্রম। সরাসরি আলোচনায় তার স্ত্রীর নাম উঠে না এলেও এমনভাবে আসলো যে, তাকে কোনোক্রমেই অস্বীকারের সুযোগ আর নেই!
সময়: ০৭২৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৭, ২০২৪
বিবিবি/এমএম