ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ফুটবল

মৃত্যুর তারিখও মিলিয়ে দিল কাস্ত্রো-ম্যারাডোনাকে

মোয়াজ্জেম হোসেন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট (স্পোর্টস) | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১৫৯ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৬, ২০২০
মৃত্যুর তারিখও মিলিয়ে দিল কাস্ত্রো-ম্যারাডোনাকে ম্যারাডোনা ও কাস্ত্রো/ছবি: সংগৃহীত

আর্জেন্টাইন ফুটবল কিংবদন্তি দিয়েগো ম্যারাডোনার মৃত্যুতে শোকের সাগরে ভাসছে ফুটবল বিশ্ব। বুধবার (২৫ নভেম্বর) হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা গেছেন এই ছিয়াশির মহানায়ক।

অবাক করা ব্যাপার হলো, চার বছর আগে ঠিক এই দিনেই পরপারে পাড়ি জমিয়েছেন তার প্রিয় বন্ধু ও কিউবার বিপ্লবী নেতা ফিদেল কাস্ত্রো।

ইতিহাসের 'সেরা' ফুটবলারের মৃত্যু নিশ্চিতভাবেই খেলাটির জন্য অপূরণীয় ক্ষতি। একরোখা, ক্ষ্যাপাটে, শিল্পী, নেতা, বিপ্লবী, ত্রাণকর্তা, মাদকসেবী, হতাশায় ন্যুব্জ যুবক এবং পুনরুত্থান ও পুনরায় পতন- এমন বর্ণাঢ্য ও বিতর্কিত ফুটবলার ইতিহাসে দ্বিতীয়টি নেই। প্রায় একক প্রচেষ্টায় নিজ দেশকে বিশ্বকাপ জেতানোর কীর্তির কারণে তিনি ছিলেন পূজনীয় 'ফুটবল ঈশ্বর'। যুদ্ধে ব্রিটিশদের কাছে ফকল্যান্ড দ্বীপ হারানোর হতাশায় ডুবতে বসা আর্জেন্টাইনদের জন্য রীতিমত ত্রাণকর্তা হয়ে এসেছিলেন তিনি।  

ব্রিটিশদের কাছে ফকল্যান্ড দ্বীপ হারানোর পর আর্থিকভাবেও বেশ খারাপ অবস্থায় ছিল আর্জেন্টিনা। ওই অবস্থায় মেক্সিকো বিশ্বকাপে ইংলিশদের হারিয়ে নিজ দেশের মানুষের মুখে হাসি ফিরিয়েছিলেন ওই সময়ের উঠতি তারকা ম্যারাডোনা। ওই এক ম্যাচেই শতাব্দীর সেরা গোল এবং 'হ্যান্ড অব গড' দুটোই দেখেছিল ফুটবলবিশ্ব। সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশদের মুখে এ ছিল এক সাক্ষাৎ চপেটাঘাত। সাম্রাজ্যবাদীদের হাতে নিষ্পেষিত মানুষ এটাকে নিজেদের জয় হিসেবেই দেখেছেন।

শুধু ফুটবল না, ম্যারাডোনা সমাজতন্ত্র আর বিপ্লবীদেরও ভালোবাসতেন। কিউবার বিপ্লবী নেতা ও প্রেসিডেন্ট ফিদেল কাস্ত্রোর সঙ্গে তার ছিল গভীর বন্ধুত্ব। ভেনেজুয়েলার সাবেক প্রেসিডেন্ট হুগো শাভেজ, বলিভিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট ইভো মোরালেস এবং ব্রাজিলের সাবেক প্রেসিডেন্ট লুলা দা সিলভার মতো বামপন্থী নেতাদের সঙ্গেও তার বন্ধুত্ব ছিল। সাম্রাজ্যবাদী শক্তি যেমন যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যের কট্টর সমালোচক ছিলেন ম্যারাডোনা। ছিলেন আর্জেন্টিনার বিপ্লবী নেতা চে গুয়েভারার ভক্ত।  

একবার তার রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে প্রশ্ন করা হলে ম্যারাডোনা বলেছিলেন, 'আমাদের কেনা অসম্ভব। আমরা বামপন্থী ("We cannot be bought, we are lefties on the feet, we are lefties on the hands, and we are lefties on the mind."-  Maradona: July 16, 2018)। ম্যারাডোনার রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং রাজনৈতিক অবস্থানের কারণে তার জনপ্রিয়তা তরুণদের মধ্যে ছিল আকাশচুম্বী। কারণ তিনি যখন টগবগে যুবক, তখন ছিল সমাজতন্ত্রের স্বর্ণযুগ। বিপ্লব তখন দেশে দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। কোটি কোটি তরুণের আদর্শ তখন চে গুয়েভারা, কাস্ত্রোরা। আর তাদের প্রতি ম্যারাডোনার নিবেদন দেখে বিপ্লবপ্রিয় তরুণরাও তাকে নিজেদের দলেরই একজন মনে করতো।

ম্যারাডোনার সঙ্গে সবচেয়ে বেশি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল কাস্ত্রোর। সেই সম্পর্ক এতটাই গভীর যে নিজের বাঁ পায়ে কিউবান কিংবদন্তি নেতার ট্যাটু এঁকেছিলেন সাবেক আর্জেন্টাইন অধিনায়ক। ২০১৬ সালে যখন কাস্ত্রো মারা গেলেন, নিজেকে কিছুতেই শান্ত করতে পারছিলেন না তিনি। প্রিয় বন্ধুর প্রতি তার ভালোবাসা এতটাই অকৃত্রিম যে কাস্ত্রোকে তিনি নিজের 'দ্বিতীয় পিতা' বলে অভিহিত করেছিলেন। ২০১৬ সালের ২৫ নভেম্বর মারা যান কাস্ত্রো। আর কাকতালীয়ভাবেই হোক আর তাদের বন্ধুত্বের গভীরতার কারণেই হোক, ঠিক চার বছর পর একইদিনে মারা গেলেন ম্যারাডোনাও।

কাস্ত্রো-ম্যারাডোনার বন্ধুত্ব
ফিদেল কাস্ত্রোর সঙ্গে ম্যারাডোনার প্রথম সাক্ষাৎ হয় ১৯৮৭ সালে। তার এক বছর আগেই বিশ্বকাপ জিতিয়ে তখন আর্জেন্টিনায় ম্যারাডোনা রীতিমত মহাতারকা বনে গেছেন। তবে কাস্ত্রোর সঙ্গে তার বন্ধুত্ব পূর্ণতা পায় একুশ শতকের শুরুর দিকে। এর শুরুটা হয় যখন অতিরিক্ত কোকেন আসক্তির কারণে ম্যারাডোনার হৃদযন্ত্রে সমস্যা দেখা দেয়। অল্পের জন্য সেবার বেঁচে যান তিনি।  

চিকিৎসা নিতে কিউবায় গিয়েছিলেন ম্যারাডোনা। ছিলেন চার বছর। ওই সময় আর্জেন্টিনার হাসপাতালগুলো তাকে ফিরিয়ে দিয়েছিল। কারণ তারা নিজেদের হাতে তার মৃত্যু হোক তা চায়নি। কিন্তু কাস্ত্রো তার জন্য কিউবার দরজা খুলে দেন। চিকিৎসার সুব্যবস্থাও করে দেন। শুধু কি তাই, প্রায়ই ম্যারাডোনাকে নিয়ে সকালে হাঁটতে বের হতেন কাস্ত্রো। দুজনে মিলে খেলাধুলা আর রাজনীতি নিয়ে দীর্ঘ সময় গল্প করতেন।

কাস্ত্রোর সঙ্গে ম্যারাডোনার বন্ধুত্বের আরও একটি কারণ ছিল দুজনেই ছিলেন প্রচণ্ড মার্কিনবিদ্বেষী। ১৯৯৪ বিশ্বকাপ আসরের মাঝপথেই ডোপ টেস্টে পজিটিভ হয়ে ফিরতে হয়েছিল ম্যারাডোনাকে। সেবারের আসর বসেছিল এই যুক্তরাষ্ট্রেই। ২০০৫ সালে একবার ফিদেল কাস্ত্রোর সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন ম্যারাডোনা। সেই সাক্ষাৎকারে দুজনেই যুক্তরাষ্ট্রের তীব্র সমালোচনা করেছিলেন। এরপরও অনেকবারই যুক্তরাষ্ট্র নিয়ে নিজের অবস্থান জানান দিয়েছেন ম্যারাডোনা। এমনকি বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে 'পুতুল' বলার কারণে তাকে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসাও দেওয়া হয়নি।  

যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের ইরাকে হামলার সিদ্ধান্তের পর ম্যারাডোনা তার সমালোচনায় বলেন, 'বুশ একজন খুনি। আমি বরং কাস্ত্রোর সঙ্গে বন্ধুত্বেই খুশি। ' এছাড়া সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের সমালোচনা করেছিলেন তিনি। শুধু তাই নয়, ফিফার মতো সংস্থার দুর্নীতি নিয়েও সরব ছিলেন ম্যারাডোনা। এমনকি নিজ দেশের ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের (এএফএ) বিরুদ্ধেও খোলামেলা সমালোচনা করতেন তিনি। তার এই বিপ্লবী চিন্তাভাবনাই তাকে কাস্ত্রোর কাছের বন্ধু বানিয়েছে।  

কাস্ত্রো নিজে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবী ছিলেন। সফল বিপ্লবের পর কিউবার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ১৯৫৯ থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত এবং প্রেসিডেন্ট হিসেবে ১৯৭৬ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেছেন। এই সময়ে তিনি ছিলেন সারাবিশ্বের বিপ্লবীদের মুখপাত্র, অগ্রজ। চে গুয়েভারার মতোই তিনি হয়ে উঠেছিলেন তুমুল জনপ্রিয়। কিউবার জনগণকে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন থেকে মুক্ত করে সাম্যবাদের দীক্ষা দিয়েছিলেন তিনি। যে দীক্ষা নিয়েছিলেন ম্যারাডোনাও। কে জানে, এখন পরপারে গিয়েও দুই বন্ধু হয়তো ফের বিপ্লব নিয়ে জম্পেশ আড্ডা দিচ্ছেন। হয়তো দুজনের হাতে থাকবে বিখ্যাত কিউবান চুরুট। ওপারে ভালো থাকুন দুই বিপ্লবী।

বাংলাদেশ সময়: ২১৫৯ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৬, ২০২০
এমএইচএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।